প্রথম পর্বে আমরা দেখেছিলাম, কীভাবে ইন্ডিয়ান সুপার লিগের (আইএসএল) চাকচিক্যের নিচে চাপা পড়ে যাচ্ছে আসল প্রশ্নগুলো। যে প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে সমাধানসূত্র বের করার মধ্যেই আসলে লুকিয়ে আছে ভারতীয় ফুটবলের উন্নতি, সেই প্রশ্নগুলো নিয়ে যে একেবারেই কেউ কথা বলছেন না এমন নয়। বিশেষ করে তারকা ফুটবলাররা বারবার এই নিয়ে কথা বলেছেন। ভারতীয় ফুটবলের আইকন বাইচুং ভুটিয়া এবং বর্তমান পুরুষদের জাতীয় দলের অধিনায়ক সুনীল ছেত্রীকে প্রচুর ইন্টারভিউতে বলতে শোনা গেছে এসব কথা। মাত্র এক বছর আগে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সুনীল বলেন, ভারতীয় ফুটবল যত দ্রুত উন্নতি করার কথা ততটা করতে পারছে না। মঞ্চে তখন আই-লিগের সিইও সুনন্দ ধর উপস্থিত। উপস্থিত আরো দুই তারকা ফুটবলার সুব্রত পাল এবং গুরপ্রীত সিং।
এর পরেই সুনন্দ ধর স্বীকার করে নেন, এআইএফএফ ফুটবলার তুলে আনার ব্যাপারে, ইউথ ডেভেলপমেন্টের ব্যাপারে বহুদিন পর্যন্ত কিছুই করে উঠতে পারেনি, সাম্প্রতিক কালে (পাঁচ-ছ'বছর ধরে) চেষ্টা শুরু হয়েছে। আগের পর্বে আমরা দেখেছিলাম, ১০-১২ বছর নাগাড়ে পরিকল্পনামাফিক চেষ্টা করলে একটা দেশের ফুটবল পরিকাঠামো ভালো হতে শুরু করে। কাজেই ছ'বছর খুব একটা কম সময় নয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, এসব কিছুই সেভাবে দানা বাঁধেনি। বরং প্রাক্তন ফুটবলারদের সাথে কথা বলে, ফুটবলকে জীবিকা হিসেবে ভাবতে চাওয়া মানুষদের সাথে কথা বললে, এর উল্টো ছবিই বেরিয়ে আসছে।
দক্ষিণ কলকাতার একেবারে শেষপ্রান্তে, টালিগঞ্জ করুণাময়ী ব্রিজের পাশে একদা এক বড়সড় খেলার মাঠ ছিলো। স্থানীয় রসা ইউনাইটেড ক্লাব এবং বিখ্যাত টালিগঞ্জ ক্লাবের যৌথ প্রকল্প হিসেবে ১৯৮৫ সালে সেখানে চালু হয় একটি ফুটবল কোচিং ক্যাম্প। চিফ কোচের দায়িত্ব নেন সুশীল ভট্টাচার্য্য, যিনি ভারতীয় ফুটবলের সোনার সময়ের পরিচিত নাম। কোচ হিসেবে প্রবাদপ্রতিম বাঘা সোমের সহকারী ছিলেন পিকে ব্যানার্জ্জি-প্রদ্যোৎ বর্মন-নিখিল নন্দী-প্রশান্ত সিনহা সমৃদ্ধ ইস্টার্ন রেলে। পরে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের প্রথম পেশাদার কোচ হন, প্রভূত সাফল্য পান। সেই পর্যায়ে সুভাষ ভৌমিক-কৃশানু দে-ভাস্কর গাঙ্গুলীরা তাঁর কোচিং-এ খেলেছেন। আরো পরে ভারতের মহিলা ফুটবল দলের একঝাঁক তারকা গড়ে ওঠেন সুশীল ভট্টাচার্য্যের হাতে। এঁদের মধ্যে শান্তি মল্লিক-মিনতি রায়-শুক্লা দত্ত-কুন্তলা ঘোষদস্তিদারের নাম সর্বজনবিদিত।
যাই হোক, সুশীল ভট্টাচার্য্যের কথা বিশদে এই লেখায় আঁটানো সম্ভব নয়। সুশীলবাবুর তত্ত্ববধানে চারজন ফিল্ড কোচ নিয়ে শুরু হয় রসা ইউনাইটেড ক্লাবের ফুটবল কোচিং ক্যাম্প। এই চারজন ছিলেন নারায়ণ দে, হিরণ্ময় মিশ্র, শম্ভু মিত্র, এবং সুব্রত গুহ। এঁরা সকলেই সেই সময়ের ব্যস্ত ফুটবলার। টালিগঞ্জ অগ্রগামী, রেল, এরিয়ান প্রভৃতি ব্যস্ত ও জমজমাট ফুটবল ক্লাবের হয়ে সুপার ডিভিশন খেলা এই চারজনের সঙ্গে পরবর্তীকালে যোগ দেন অভিজিৎ বসু (মিলন সমিতি)। মাঝে মাঝে কুন্তলা ঘোষদস্তিদার এবং শান্তি মল্লিকও ঐ মাঠেই প্র্যাক্টিস করেছেন, তাঁদেরও তখন ব্যস্ত ক্রীড়াসূচী। উৎসাহ দিতে এসেছেন সাহু মেওয়ালালের মত তারকা। প্রশাসনিক কাজ দেখাশোনা করতেন (এখনও করেন ) অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন: ভারতীয় ফুটবলের অসুখসমূহ: পর্ব - ১
প্রশিক্ষণের মান খুব উঁচু তারে বাঁধা ছিলো, ছাত্ররা প্রায় সবাই নিম্ন-মধ্যবিত্ত ঘরের, অনেকেরই খেলাধুলো ছাড়া কেরিয়ার করার অন্য উপায় ছিল না। এই ক্যাম্প থেকেই এক সময় উঠে এসেছেন স্নেহাশিস চক্রবর্তী (মোহনবাগান)। এই রসা ইউনাইটেড ক্লাবের বার্ষিক ফুটবল প্রতিযোগিতায় বিভিন্ন দলের হয়ে খেলেছেন তুষার রক্ষিত, সুখেন সেনগুপ্ত, চিবুজার। এবং এটিই ঐ অঞ্চলের একমাত্র ফুটবল কোচিং ক্যাম্প ছিল না। আশেপাশে এরকম আরো একাধিক ক্যাম্প ছিল, সেখান থেকে শান্তি মজুমদারের মত গোলকীপার পেয়েছে ময়দান।
এত কথা বলার উদ্দেশ্য, এরকম ছোট, সরকারি অনুদান ছাড়া চলা, মূলত স্বেচ্ছাশ্রমে ভর করে এগোনো উদ্যোগ থেকেও কি পরিমাণ খেলোয়াড় সাপ্লাই হয় সেটা বোঝানোর জন্য। সর্বভারতীয় পর্যায়ে ফুটবল খেলেছেন এমন অভিজ্ঞ কোচেদের জন্য বরাদ্দ ছিলো শুধু টিফিন অ্যালাওয়েন্স। ছাত্রদের মধ্যে কেউ একটু অবস্থাপন্ন ঘরের হলে তাঁরা দুটাকা চাঁদা দিতেন স্বেচ্ছাপ্রবৃত্ত হয়ে, তার থেকে একটা ফান্ড হতো, যা দিয়ে বল সারাই বা ফার্স্ট এডের জিনিস কেনা হত। ১৯৮৭-১৯৯৬ সাল ঐ ক্লাবের হয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়ার সময় কিছু পরিচিতি হয় আমার। সেই অভিজ্ঞতা থেকে এবং পরবর্তীকালে কোচিং স্টাফেদের সঙ্গে কথা বলে আরও কিছু তথ্য হাতে আসে।
সেই সময় অলিখিতভাবে তিনটি বিভাগ ছিলো। সবথেকে বড়রা খেলত ময়দানের কোন ছোটখাটো ক্লাবে, তাদের তখন আরো বড় ক্লাবে খেলার চেষ্টা শুরু হয়েছে। পরের বিভাগে তারা যাদের স্কিল যথেষ্ট উন্নত, মাজাঘষা চলছে যাতে অবিলম্বে স্কুল বা কলেজ ফুটবলে নজর কাড়তে পারে। আর একেবারে ছোটদের জন্য নার্সারি বিভাগ, সেখানে বল নিয়ন্ত্রণ ও শরীরের সক্ষমতা বাড়িয়ে তোলা, এন্ডিওরেন্স, এইসব শেখানো হতো। বলা বাহুল্য, খুব কড়া শরীরচর্চা করতে হতো অন্য দুই বিভাগের ছেলেদেরও। মেয়েদের জন্য কোন আলাদা ব্যবস্থা ছিল না। একেবারে সিনিয়র লেভেলের দু-একজন (কুন্তলাদি, শান্তিদি) আসতেন, আর একেবারে ছোটদের মধ্যে এক-দুজন।
পাঠক আশা করি বুঝতে পারছেন, এই বিশাল কর্মযজ্ঞ স্রেফ স্বেচ্ছা শ্রমে চালানোর জন্য প্রয়োজন ফুটবলের প্রতি নিখাদ ভালোবাসা। এবং আজকের সায়েন্টিফিক স্পোর্টস ম্যানুয়ালে যে সমস্ত স্ট্র্যাটেজির কথা বলা থাকে, ছোটদের খেলা শেখানোর যেসব টেকনিকের কথা আলোচিত হয়, সেসব তখনকার কোচেদের অজানা ছিল না। মোটের ওপর বেশ সুষ্ঠুভাবে চলছিল ক্যাম্প। এরপরেই অবশ্য কয়েকটি সমস্যা তৈরী হয়। যে মাঠটিতে এই ক্যাম্প চলছিল, তার পুরোটাই রাজ্য সরকার অধিগ্রহণ করে নেয়। সেখানে তপন সিনহা মেমোরিয়াল হাসপাতাল তৈরী হয়েছে। ইতিমধ্যে ক্রিকেট কোচিং ক্যাম্পও চালু হয়েছিল (এখান থেকে অশোক দিন্দা উঠে এসেছেন) যা প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয় (এখন শুধু একটা নেট প্র্যাক্টিস করার জায়গা রয়েছে, আক্ষরিক অর্থেই এক চিলতে জমি)। ফুটবল ক্যাম্পের জন্য পরবর্তীকালে বরাদ্দ হয় পাশের ছোট একটি জায়গা, অসমান, ঘাসবিহীন সেই ধুলোর মাঠে রসা ইউনাইটেড ক্লাবের ফুটবল ক্যাম্প টিমটিম করে চলছে।
আরও পড়ুন: ফুটবলায়নের দিনগুলি - পৃথিবীজোড়া ফুটবল চর্চার ইতিহাস
১৯৮৫ সাল থেকে চালু হওয়া এই ক্যাম্পে আজ পর্যন্ত কোন সরকারি অনুদানের খবর নেই, যদিও রাজ্য সরকারের তরফ থেকে রাজ্যের তিনটি বড় ক্লাবকে আর্থিক অনুদান দেওয়া হয়েছে সম্প্রতি। কোচেরা কোনদিন বেতনভুক ছিলেন না, এখনও তাঁরা স্বেচ্ছা শ্রমই দেন। সুদূর অতীতের সেই সম্ভাবনাময় খেলোয়াড়েরা এখন সবাই হাল ছেড়ে দিয়ে নানাবিধ রোজগারের জন্য ব্যস্ত হয়েছেন। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০১৮ অবধি একমাত্র উল্লেখযোগ্য সংযোজন জুনিয়র ইস্টবেঙ্গল খেলা বিশ্বজিৎ নট্ট। ২০০৭ সালে ইস্টবেঙ্গলের হয়ে অনূর্দ্ধ-১৫ প্রিমিয়ার কাপে ফ্রিকিকে দর্শনীয় গোল করে চমকে দেওয়া বিশ্বজিত বাদে গত বাইশ বছরে তেমন কোন প্রতিভা বেরোলো না, এর উত্তর লুকিয়ে আছে সামগ্রিকভাবে একটা অঞ্চলের ফুটবল সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দেওয়ার মধ্যে।
একথা অনস্বীকার্য, যে ক্যাম্পের সুবর্ণ যুগেও সবকিছু নিখুঁত ছিল না। নিউট্রিশনিস্ট ছিল না, খেলার সূক্ষ্ম দার্শনিক দিকগুলো কোনওদিন সেভাবে আলোচিত হয়নি, যা বিদেশের এমনকি কলেজ ইউনিভার্সিটির অ্যামেচার খেলাধুলোতেও হয়। কোনও জিম ছিল না, দুঃস্থ খেলোয়াড়দের জন্য ছিল না সরঞ্জামের ব্যবস্থা (মনে আছে, একজন অনূর্দ্ধ-১৯ খেলোয়াড় বুট ধার করে টুর্নামেন্ট খেলতে যাচ্ছে)। কিন্তু সেইসব ছোটখাটো গলদ মেরামত করে নেওয়ার বদলে যেটুকু ছিল, সেটাকেও নষ্ট করে ফেলা হয়েছে - এটাই আক্ষেপ।
ঠিক কীভাবে নষ্ট করা হয়েছে সম্ভাবনা? আগেই বলা হয়েছে মাঠ দখল হয়ে যাওয়ার কথা। প্রাথমিকভাবে প্রোমোটারদের দখলে বেশিরভাগ মাঠ চলে যেতে শুরু করায় টালিগঞ্জ স্পোর্টস কাউন্সিল থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, এই খেলার মাঠ কোনওদিন অন্য কাজে ব্যবহার করা যাবে না। তৎকালীন মন্ত্রী প্রশান্ত শূর এবং তারাপদ চক্রবর্তীর এই বিষয়ে প্রচুর উদ্যোগ ছিল, অন্তত নথিপত্র তাই বলে। টালিগঞ্জ ক্লাবের বব রাইটও এই বিষয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, সরকার পরিবর্তনের পরে এমন কী ঘটল, যে সেই খেলার মাঠই এখন নেই? দ্বিতীয়ত, এই মুহূর্তে ভারতে ক্রিকেট বাদে অন্য খেলাধুলো করে কেরিয়ার করা খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। সবথেকে বাজে অবস্থা ফুটবল বা হকির মত টিম গেমের, যেখানে সাফল্য একজনের হাতে নেই। এর প্রধান কারণ, অফিস টিমগুলোর একে একে উঠে যাওয়া, ছোট ক্লাবগুলোর শোচনীয় অর্থনৈতিক হাল, এবং খেলাধুলো করে সরকারি চাকরি পাওয়ার অসুবিধে। রেলের কিছু পোস্ট বাদ দিলে কেন্দ্র সরকারের স্পোর্টস কোটার রিক্রুটমেন্ট বিরল। অন্যদিকে রাজ্য সরকারের চাকরি পাওয়া, সদ্য প্রাক্তন ফুটবলারেরা বলছেন, বন্ধ হয়ে গেছে।
তাহলে প্রশ্ন হলো, ফুটবল কেন কেউ খেলবে? যাঁদের সামর্থ্য আছে, তারা এমনিতেও হয় পড়াশোনা করবে, নয়ত ক্রিকেট খেলবে, যেখান থেকে আইপিএলের মত মঞ্চ আছে টাকার থলে নিয়ে। মনে রাখতে হবে, ন্যাশনাল খেলা ফুটবলারদের জন্যও দশম শ্রেণী উত্তীর্ণ হওয়া জরুরি - অন্তত কেন্দ্র সরকারের বেঁধে দেওয়া যোগ্যতামান এরকমই। অথচ যাঁরা খেলাধুলো করেছেন তাঁরাই জানেন, বহু ছেলেমেয়ে, যাঁরা তুখোড় খেলোয়াড়, স্কুলের গন্ডি পেরোতে পারেননি। অনেক প্রতিভা আমি নিজেই দেখেছি যাঁরা এইট পাশ করেন নি, তাঁদের এক ও একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল ভালো ফুটবলার হওয়া। এইসব মানুষ এখন ছোটখাট ব্যবসা বা চাকরিতে দিন গুজরান করেন। আই লিগ (প্রথম ডিভিশন) ও আইএসএলে মগ্ন, বছরের বাকি সময় জুড়ে লা লিগা, সেরি আ, প্রিমিয়ার লিগ বা বুন্দেশলিগায় ব্যস্ত ভারতের ফুটবলপ্রেমী যেমন এইসব মানুষের খবর রাখেন না, তেমনি এঁদের নিয়ে রাজ্য স্তরের বা সর্বভারতীয় কর্তাদেরও কোন হেলদোল নেই।
আরও পড়ুন: ফুটবলায়নের দিনগুলি (দ্বিতীয় পর্ব)
এআইএফএফের নিজেদের ওয়েবসাইটেই আছে তৃণমূল স্তর থেকে ফুটবলার তৈরীর ম্যানুয়াল, এবং অতীব আশ্চর্যের কথা, এতগুলো বছর পেরিয়েও সেখানে কোন রিসোর্স অ্যালোকেশনের কথা নেই। সর্বত্র স্বেচ্ছাশ্রমভিত্তিক কর্মসূচীর কথা বলা হয়েছে। স্মল সাইডেড গেম (এসএসজি) নিয়ে সাতকাহন আছে, কত বয়সের বাচ্চারা কী কী শিখবে সেসব আছে (যেগুলো বেসিক কোচিং কোর্স করা কোচেরা এমনিতেই জানেন) কিন্তু কোথাও বলা নেই, দিন আনা দিন খাওয়া বাড়ির বাচ্চা খেলতে এলে সে পুষ্টিকর খাবার, খেলার সরঞ্জাম এইসব পাবে কিনা, বা কীভাবে পাবে। বলা নেই, যেসব বাচ্চা স্কুলেই যেতে পারে না কারণ তাদের ক্ষেতে কাজ করতে হয়, তারা কোন অলৌকিক স্বপ্নে বলীয়ান হয়ে ফুটবল খেলতে আসবে? কী পাবে তারা ফুটবল খেলে?
পাওয়ার কথাই যদি হয়, এআইএফএফ কী পায় সেটা আমরা জানি। গত কয়েকটি আই-লিগে একে একে পয়সার অভাবে নিভে গেছে চিরাগ ইউনাইটেড, মাহিন্দ্রা ইউনাইটেড, পৈলান অ্যারোজ। কোন এক অদ্ভুৎ নিয়মে টিভি সম্প্রচার এবং টিকিট বিক্রির টাকা পায় এআইএফএফ, যুযুধান দলগুলি তার কোন অংশই পায় না। বর্তমানে এআইএফএফের বোর্ড অফ ডিরেক্টরে তিনজন। প্রেসিডেন্ট প্রফুল্ল প্যাটেল, জেনারেল সেক্রেটারি কুশল দাস এবং আই-লিগ সিইও সুনন্দ ধর। এঁদের মধ্যে একমাত্র প্রফুল্ল প্যাটেল সম্পর্কে এআইএফএফের ওয়েবসাইটে সামান্য কিছু জানা যায় আর উইকিপিডিয়ায় একটি পেজ আছে। সেখানকার তথ্য অনুযায়ী, প্যাটেল খুবই দক্ষ ও সফল প্রশাসক। যদিও ঠিক কীভাবে তিনি ভারতীয় ফুটবলের সংস্পর্শে এলেন সেকথা জানা যায় না। এই মুহূর্তে প্যাটেল এএফসি বা এশিয়ান ফুটবল ফেডারেশনের সাফ অঞ্চলেরও ভাইস প্রেসিডেন্ট। বাকি দুজনের সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। অথচ অন্যান্য দেশের ফুটবল কর্তাদের সম্পর্কে আমরা অনেক কিছুই মাউসের একটা ক্লিকেই জেনে যাই।
এআইএফএফের একটি টেকনিকাল কমিটিও আছে, সেখানে আছেন শ্যাম থাপার মত প্রাক্তন তারকা। একই সঙ্গে আছেন সুন্দর রমন, যিনি এক সময় আইপিএলের চিফ অপারেটিং অফিসার (সিওও) ছিলেন ২০০৮ থেকে ২০১৫ অবধি। সবথেকে আশ্চর্যের, এই সুন্দর রমনের সঙ্গে আইপিএল ম্যাচ গড়াপেটার সম্পর্ক এখনও তদন্তাধীন বিষয়। একথা দ্বিধাহীন ভাবে বলা যায়, গজদন্তমিনারে বসে থাকা এই প্রশাসনিক দল এখনও পর্যন্ত যাই করে থাকুন, দেশের ফুটবল পরিকাঠামোর উন্নতির জন্য তা পর্যাপ্ত নয়। এর ফলেই এক সময়ের সুব্রত কাপ খেলা, বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের প্রতিভারা, যাঁদের জাতীয় দলের সম্পদ হয়ে ওঠার কথা ছিলো - তাঁরা এখন সবজি বেচে, অটো চালিয়ে বা গাড়ির গ্যারেজে কাজ করে কোনমতে দিন কাটাচ্ছেন। সেইসঙ্গে একের পর এক খেলার মাঠ চলে যাচ্ছে আগ্রাসী কনস্ট্রাকশন প্রোজেক্টের গর্ভে।
ফুটবল খেলতে গেলে একটা প্রমাণ সাইজের মাঠ লাগে, কয়েকজন আগ্রহী খেলোয়াড় লাগে, এই তুচ্ছ কথাটাও এখন মনে করিয়ে দিতে হচ্ছে। তৃতীয় ও শেষ পর্বে আমরা এমন একজন একদা প্রতিভাবান ফুটবলারের কথা শুনব, যাঁকে অনায়াসে কয়েক প্রজন্ম ধরে বয়ে চলা উদ্দেশ্যভ্রষ্ট ফুটবল ম্যানেজমেন্টের ফসল বলা যায়। যে অসংখ্য স্বপ্নের বলি দিয়ে সেই মঞ্চে এখন আইএসেলের রাজসূয় যজ্ঞ হচ্ছে, তাঁদের একজনের গল্প সম্ভবত ছবিটা স্পষ্ট করবে।