ভারতীয় ফুটবলে নক্ষত্রপতন। প্রয়াত হলেন কিংবদন্তি ফুটবলার মহম্মদ হাবিব। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। অন্ধ্রপ্রদেশে (বর্তমান তেলেঙ্গানায়) তাঁর জন্ম হলেও মহম্মদ হাবিবের ফুটবলার জীবনের উত্থান ভারতীয় ফুটবলের মক্কা কলকাতায়। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান থেকে মহামেডান, কলকাতার বড় দলে চুটিয়ে খেলা এই কিংবদন্তি ফুটবলার বাংলার হয়ে সন্তোষ ট্রফিতেও খেলেছেন। ১৯৮০ সালে পেয়েছিলেন অর্জুন পুরস্কার। ২০১৫ সালে পেয়েছেন ভারত গৌরব পুরস্কার।
কলকাতা ময়দান তাঁকে চিনত 'বড়ে মিয়াঁ' নামে। তাঁর ভাই আকবরও খেলেছেন কলকাতা ময়দানে। তিনি ছিলেন 'ছোটে মিয়াঁ' নামে পরিচিত। বেশ কিছুদিন ধরেই ভুগছিলেন দুরারোগ্য অ্যালঝাইমার্সে। তার মধ্যেই ২০১৯ সালে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের শতবর্ষের অনুষ্ঠানেও যোগ দিয়েছিলেন। মঙ্গলবার (১৫ আগস্ট) হায়দরাবাদে নিজের বাসভবনেই তিনি প্রয়াত হন।
মহম্মদ হাবিবের জন্ম ১৯৪৯ সালের ১৭ জুলাই। হাবিবরা পাঁচ ভাই। খেলোয়াড় পরিবারেই জন্ম। তাঁর ভাইদের মধ্যে একাধিকজন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে খেলেছেন। হাবিব নিজে তো জাতীয় দলের খেলোয়াড় ছিলেনই। কিশোরবেলায় তিনি খেলতেন হায়দরাবাদের সিটি কলেজ অ্যান্ড বয়েজে। তারপর যোগ দিয়েছিলেন বর্তমানে বিলুপ্ত হায়দরাবাদ টেলিফোনে। সালটা ১৯৬৬, চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মোহনবাগান সেই সময় লাল-হলুদ শিবির থেকে তুলে নিয়েছে অসীম মৌলিক, চন্দ্রেশ্বর প্রসাদদের মতো গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়দের।
সেই সময় লাল-হলুদ শিবিরের হর্তা-কর্তা-বিধাতা ছিলেন কিংবদন্তি কর্মকর্তা জ্যোতিষ গুহ। ময়দানে যিনি জেসি গুহ নামেও পরিচিত। হায়দরাবাদের হয়ে সন্তোষ ট্রফিতে খেলতে গিয়েই জ্যোতিষ গুহর নজরে পড়ে গিয়েছিলেন মহম্মদ হাবিব। অসীম মৌলিক মৌলিক, চন্দ্রেশ্বর প্রসাদদের হারানোর ক্ষতি পূরণ করতে জ্যোতিষ গুহ এরপর কলকাতা ময়দানে টেনে আনেন মহম্মদ হাবিব, শ্যাম থাপা, সৈয়দ নইমুদ্দিন, আফজলদের।
হাবিবের সৌজন্যে ইস্টবেঙ্গল আইএফএ লিগ, আইএফএ শিল্ড, রোভার্স থেকে ডুরান্ড- বহু ট্রফি জিতেছে। দুই মরশুম ইস্টবেঙ্গলে কাটিয়ে হাবিব ১৯৬৮ সালে মোহনবাগানে যোগ দেন। সেই বছরই অবসর নিয়েছিলেন মোহনবাগান রত্ন চুনী গোস্বামী। মোহনবাগানের হয়েও তিনি রোভার্স, লিগ, শিল্ড জয়ের সাক্ষী হন। ১৯৬৯ সালে সেন্টার ফরোয়ার্ড হাবিবকে প্রথমবার স্কিমারের ভূমিকায় বড় অবদান রাখতে দেখে কলকাতা ময়দান। ইস্টবেঙ্গলকে শিল্ড ফাইনালে মোহনবাগান হারায় ৩-১ গোলে।
১৯৭০ সালে হাবিব ফেরেন ইস্টবেঙ্গলে। ডুরান্ড ফাইনালে ইস্টবেঙ্গল ২-০ গোলে হারায় মোহনবাগানকে। দুটি গোলই ছিল হাবিবের। ১৯৭০ সালে ইরানের বিখ্যাত পাস ক্লাবকে শিল্ড ফাইনালে হারিয়েছিল ইস্টবেঙ্গল। ম্যাচে হাবিবের পরিবর্ত পরিমল দে গোল করলেও চোট পেয়ে মাঠ ছাড়ার আগে পর্যন্ত সুযোগ পেলেই প্রতিটি মুহূর্তে দলের জন্য লড়াই করেছিলেন হাবিব। ১৯৭০ সালের এশিয়ান গেমসে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে দুর্দান্ত খেলেছিলেন হাবিব। বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি হলেন স্বাভাবিক নেতা। প্রথম ম্যাচে থাইল্যান্ডের বিরুদ্ধে ২-০ পিছিয়ে ছিল ভারত। এরপরই মাঠে দলকে উদ্দীপ্ত করেন হাবিব। তাঁর সহায়তায় সুভাষ ভৌমিক থাইল্যান্ডকে ২ গোল দেন। এরপর দক্ষিণ ভিয়েতনামকে ২-০ গোলে, ইন্দোনেশিয়াকে ৩-০ গোলে পরাজিত করে ভারত। এমনকী, জাপানকেও ভারত হারিয়েছিল। এশিয়ান গেমসে জিতেছিল ব্রোঞ্জ। ১৯৭১ সালে সিঙ্গাপুরে দক্ষিণ ভিয়েতনামের সঙ্গে যৌথভাবে পেস্তা সুকান কাপ জিতেছিল ভারত।
আরও পড়ুন- টার্কিশ লিগের সেরা ক্লাবকে দলবদলে টেক্কা ISL ক্লাবের, গ্রিক সুপারস্টার ভারতীয় ফুটবলে
কয়েক বছর ইস্টবেঙ্গলকে কাটানোর পর ১৯৭৫ সালে হাবিব মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু, তেমন ভালো কিছু করে দেখাতে পারেননি। এরপর ১৯৭৬ সালেই ফেরেন মোহনবাগানে। ১৯৭৭ সালে মোহনবাগান আইএফএ লিগে ২৭ ম্যাচে রেকর্ডসংখ্যক ৮২ গোল দিয়েছিল। সব মিলিয়ে তাঁর ফুটবলার জীবনে ৫০টি ট্রফি জয়ের সাক্ষী থেকেছেন কিংবদন্তি এই ফুটবলার।