জুন ৯, ২০২২: কলকাতায় এশিয়ান কাপের কোয়ালিফায়ারে আফগানিস্তানের বিপক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে খেলতে নামার ঠিক ৪৮ ঘন্টা আগে। জাতীয় হেড কোচ ইগর স্টিম্যাচ বার্তা পাঠালেন ভুপেশ শর্মাকে। যিনি একজন জ্যোতিষী। তাঁর সঙ্গে কোচ স্টিম্যাচের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন ফেডারেশনের একজন শীর্ষ আধিকারিক।
যাইহোক, কিংস কাপের ম্যাচের আগে স্টিম্যাচের বার্তা, "হ্যালো বন্ধু, ১১ জুন ম্যাচের জন্য তুমি কি তালিকার প্রত্যেক প্লেয়ারের চার্ট দেখতে পারবে? ম্যাচ শুরুর সময় সাড়ে ৮ টা।" স্টিম্যাচের এই 'তালিকা'-র অর্থ ম্যাচের জন্য সম্ভাব্য ১১ বাছাই। মহাদেশীয় গুরুত্বপূর্ণ টুর্নামেন্টে টিকে থাকার জন্য চোট আঘাত জর্জরিত জাতীয় দলের জন্য এমনই পন্থা নিয়েছিলেন কোচ ইগর স্টিম্যাচ।
আর স্টিম্যাচ 'লিস্ট' পাঠানোর সঙ্গেই সেই জ্যোতিষী প্রত্যেক প্লেয়ারের পাশে মন্তব্য জুড়ে দেন। যেমন - 'ভালো', 'খুব ভালো খেলবে', 'আত্মবিশ্বাস বর্জন করতে হবে', 'গড়পড়তার থেকেও সাধারণ খেলবে, 'দারুণ খেলবে তবে বেশি আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারে', 'এই দিনের জন্য মোটেই সুপারিশকৃত নয়'।
সেই জ্যোতিষীর পরামর্শ মেনেই আফগানিস্তান ম্যাচের দল সাজানো হয়েছিল শেষ পর্যন্ত। যখন ভারতের দল ঘোষিত হয়, দেখা যায় জাতীয় দুই নির্ভরযোগ্য তারকাকে বাদ দিয়েই দল তৈরি করা হয়েছে।
জ্যোতিষীর সঙ্গে মোটেই একবার এরকম মেসেজ আদান-প্রদান হয়নি। এরকম বার্তা চালাচালি একশোর কাছে হয়েছে। এমনটাই জানতে পেরেছে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস। সেই সময়-পর্বে ভারত চারটে ম্যাচ খেলেছিল। জর্ডনের বিপক্ষে ফ্রেন্ডলি খেলার পাশাপাশি এশিয়ান কাপ কোয়ালিফায়ারে ভারত খেলেছিল কম্বোডিয়া, আফগানিস্তান এবং হংকংয়ের বিপক্ষে।
প্রতি ম্যাচের আগেই স্টিম্যাচ যোগাযোগ রেখেছিলেন জ্যোতিষীর সঙ্গে। এতে শুধুমাত্র দল গঠন প্রক্রিয়ার ওপরেই প্রশ্ন ফেলে না। বরং জাতীয় দলের গোপনীয়তাও ভঙ্গ হওয়ায় অভিযোগ উঠেছে।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের কাছে সমস্ত বার্তার প্রতিলিপি রয়েছে। ভবিষ্যৎবাণী করার সুনির্দিষ্ট প্যাটার্নও রয়েছে। ফুটবলারদের নাম উল্লেখ করা হল না:
*প্রত্যেক ম্যাচের আগে স্টিম্যাচ দলের স্কোয়াড, সম্ভাব্য একাদশ জানাতেন জ্যোতিষীকে। এমনকি পরিবর্ত হিসাবে কাদের ব্যবহার করা হবে, কাদের ইনজুরি রয়েছে সেটাও জানাতেন। সেই অনুযায়ী ইনপুট দিতেন সংশ্লিষ্ট জ্যোতিষী।
* এক বার্তায় স্টিম্যাচ লিখছেন, "প্রিয় ভুপে, তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে, ভবিষ্যতের কর্মপন্থা ঠিক করতে পেরে ভাল লাগছে। নিম্নের ফুটবলারদের সম্পর্কে একটু আপডেট দিন।" এরপরে স্টিম্যাচ চারজন ফুটবলারের জন্মদিন, জন্ম তারিখ, এবং জন্মের সময় উল্লেখ করেন। এই চার তারকার তিনজনই যুব বিশ্বকাপে জাতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন।
* জর্ডনের বিপক্ষে ফ্রেন্ডলি ম্যাচে স্টিম্যাচ একই কায়দায় স্কোয়াডের ২৪ জন ফুটবলারের সমস্ত তথ্য দেন জ্যোতিষীকে। ভুপেশ শর্মা নিজের মতামত জানানোর পর স্টিম্যাচ দওলের ইনজুরি আপডেটসও দেন।
*অন্য এক কথপোকথনে দেখা যাচ্ছে ভুপেশ শর্মা বলছেন, 'আজকের দিন মোটেই আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার ভাল খেলতে পারবে না।' এরপরেই স্টিম্যাচ সেই প্লেয়ারের গ্রহ নক্ষত্রের সঙ্গে বাকিদের তুলনা করতে বলেন। সঙ্গেসঙ্গেই রিপ্লাই দিয়েছিলেন শর্মা। স্টিম্যাচের পছন্দের তালিকায় তিন নম্বরে থাকা সেই প্লেয়ার আর প্ৰথম একাদশে জায়গা পাননি। দ্বিতীয়ার্ধে পরিবর্ত হিসাবে নামানো হয় তাঁকে।
* মে ২৮-এ ভারত হেরে যাওয়ার পর স্টিম্যাচ বেশ কয়েকজন তারকার ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স নিয়ে আলোচনা করেন। ইঙ্গিত দেন, এশিয়ান কাপের কোয়ালিফায়ারে দলে পরিবর্তন আনার। মন্তব্য করেন, 'জর্ডনের মত দলের বিপক্ষে ভাল ফর্ম থাকলেও শারীরিকভাবে দুর্বল ফুটবলারদের বিবেচনা করা যায় না।" এই বিষয়ে একমত হন শর্মা। জ্যোতিষী বলেন, "এরকম হাই এনার্জি ম্যাচে জাতিগত এবং শারীরিক গঠনগত পার্থক্য নিয়ে লড়াই করতে পারব না। এবং ফুটবলে ভারতের ইতিহাস শোচনীয়। এমনকি ক্রিকেটেও বর্তমান অবস্থায় পৌঁছনোর জন্য প্রায় একশতক লেগে গিয়েছে।"
* ৮ জুন থেকে ১৪ জুন কলকাতায় এশিয়ান কাপ কোয়ালিফায়ারের জন্য দুজন সাক্ষাৎ করেন ঠিক দু-দিন আগে।
* প্ৰথম কোয়ালিফায়ারের কম্বোডিয়ার বিপক্ষে খেলতে নামার আগে স্টিম্যাচ প্ৰথম একাদশের তালিকা পাঠান বেশ কয়েকজন রিজার্ভ প্লেয়ার সম্বলিত। তাঁর যুক্তি ছিল, তিন জন প্লেয়ার চোট থেকে সেরে উঠেছে। তাই দ্বিতীয় ম্যাচের কথা ভেবে তাঁদের বিশ্রাম দেওয়া হয়েছে।
* জুন ১২, দ্বিতীয় ম্যাচে আফগানিস্তানের বিপক্ষে খেলার ঠিক একদিন পরের ঘটনা। আফগানিস্তানের বিপক্ষে ভারত বেশ কষ্টসাধ্য ২-১ জয় পায়। শর্মা স্টিম্যাচকে মেসেজ করেন, "চার্ট অনুযায়ী প্লেয়াররা কেমন খেলেছে। ফ্রি হলে জানান।"
স্টিম্যাচের রিপ্লাই ছিল, "সবকিছুই ঠিকঠাক কাজ করেছে। সাক্ষাতে বিস্তারিত বলব।" পরের দিন স্টিম্যাচ এবং শর্মা একসঙ্গে দলগঠন নিয়ে বৈঠক করেন। হংকংয়ের বিরুদ্ধে জিতে ভারত এশিয়ান কাপের মূলপর্বে পৌঁছয়।
জ্যোতিষী শর্মাকে ফোন এবং মেসেজ করা হলেও রিপ্লাই পাওয়া যায়নি। সেই সময় ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন প্রফুল্ল প্যাটেল। তিনি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-কে বললেন, তিনি মোটেই এই বিষয়ে অবহিত নন। তৎকালীন ফেডারেশনের সচিব কুশল দাস স্বীকার করে নিয়েছেন ভুপেশ শর্মার সঙ্গে তিনিই স্টিম্যাচের আলাপ করিয়ে দেন। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-কে স্টিম্যাচ বলেন, "ওঁর সঙ্গে এক বৈঠকে আলাপ হয়। তিনি বড়বড় টেলিকম কোম্পানি এবং বলিউডি তারকাদের জন্য কাজ করেছেন। ওঁরা যা করেন তা হল, গ্রহ নক্ষত্রের সময় সূচি নির্ধারণ যাতে বর্তমান ফুটবলারদের বিবেচনায় সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়।"
"সেই সময় আমি ভারতের এশিয়ান কাপের মূলপর্বে পৌঁছনো নিয়ে যথেষ্ট চিন্তিত ছিলাম। সত্যি কথা বলতে ঈগরও ছিলেন। ব্যাপারটা মোটেই স্বস্তিকর ছিল না। ভারতের যোগ্যতা নির্ণয়ই ছিল সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমি ভুপেশ শর্মাকে বলি, কোচ যদি চান তাহলে আমি আলাপ করিয়ে দেব। যদি কোচ পছন্দ করেন, তাহলে উনি আমাকে জানাবেন। ঈগরের ভুপেশকে বেশ পছন্দ হয়েছিল। কলকাতায় দুজনে অনেকটা সময় কাটান।"
কেন ভুপেশের পরামর্শে দল সাজাতেন? স্টিম্যাচ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-কে বলেছেন, "ভুপেশের নাম আমার কাছে সুপারিশ করা হয়েছিল। আমি বাকিরা ক্রীড়া দুনিয়ায় জ্যোতিষের প্রভাব ফেলার বিষয়ে রাজি করিয়েছিলেন। এর বেশি কিছু নয়। একজন বিদেশি সহকারী চেয়েছিলাম। তবে সেই অনুরোধ রাখা হয়নি। ভুপেশের সঙ্গে চুক্তির অঙ্ক দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে যাই।"
কেমন ছিল সেই চুক্তি? স্টিম্যাচ জানাচ্ছেন, "ওঁর পেশাদারি মতামত গ্রহণ করা হয় মাত্র দু-মাসের জন্য। ১২-১৫ লক্ষ টাকা ওঁকে দেওয়া হয়েছিল। ভারত এশিয়ান কাপের মূলপর্বে পৌঁছে যাওয়ায় এই টাকার অঙ্ক কখনই বড় মনে হয়নি।"
কোচের সঙ্গে ভুপেশের কী কথাবার্তা হয়েছিল, তার বিস্তারিত অবশ্য জানেন না কুশল দাস। এমনটাই বলছেন তিনি। জানাচ্ছেন, "ফেডারেশনে ১২ বছর থাকাকালীন কখনই কোচ অথবা অন্য কারোর সঙ্গে দল নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করিনি।" গত বছর ফিফার তরফে নিষিদ্ধ হওয়ার পর টালমাটাল সেই পর্বের শেষে কুশল দাসের ফেডারেশনের মেয়াদ শেষ হয়। মেডিক্যাল কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেন কুশল দাস।
পুরো ইস্যুতে বর্রমান ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট কল্যাণ চৌবে বা সচিব শাজী প্রভাকরণ কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি। ভারত বর্তমানে ফিফার ক্রমতালিকায় উন্নতি করেই চলেছে। শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে টিম ইন্ডিয়ার নাছোড় পারফরম্যান্স সম্ভ্রম আদায় করে নিচ্ছে। এমন অবস্থায় এই ঘটনা নিঃসন্দেহে ভারতীয় ফুটবলে অস্বস্তি ডেকে আনবে।