আইপিএল মানেই চোখধাঁধানো ক্রিকেট, চার-ছয়ের বন্যা, একের পর এক বিতর্ক আর গোটা মরশুম জুড়েই বেশ কিছু মনে রাখার মত ঘটনা। কিন্তু ২০১৯ সালের দ্বাদশ আইপিএলের প্রথম এক সপ্তাহে প্রায় সব খেলাতেই কোন না কোন বিতর্কের জন্ম হয়েছে। এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে ঘটনা গড়িয়েছে এমসিসি পর্যন্ত।
মরশুমের প্রথম ম্যাচেই চেন্নাইতে মুখোমুখি হয়েছিলেন মহেন্দ্র সিং ধোনি এবং বিরাট কোহলি। দুই দলে ওয়াটসন, রায়না, ডি ভিলিয়ার্সের মত ব্যাটসম্যান থাকলেও চেন্নাইয়ের ধিমে গতির পিচে কেউই বিশেষ কিছু করে উঠতে পারেননি। বরং সুপার কিংসের দুই স্পিনার, অভিজ্ঞ হরভজন আর ইমরান তাহিরের দাপটে মাত্র ৭০ রানেই শেষ হয়ে যায় রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্সের ইনিংস। ব্যাট করতে নেমে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ১৮ ওভারে প্রয়োজনীয় রান তোলে চেন্নাই। ম্যাচের শেষে চেন্নাইয়ের অধিনায়ক ধোনি নিজেই পিচের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। অত্যন্ত ধীর অতির এই পিচে ৮০-৯০ রানের বেশী হওয়া কঠিন বলে মন্তব্য করেন তিনি, আশা প্রকাশ করেন যে পরের খেলায় পিচের উন্নতি হবে। আগামী রবিবারের চেন্নাইয়ের মাটিতে দ্বিতীয় ম্যাচে তাই পিচের দিকেই থাকবে সবার নজর।
ইডেনে প্রথম ম্যাচের শুরুতেই মাঠ মাতিয়ে দেন ডেভিড ওয়ার্নার। বল বিকৃতির অভিযোগে এক বছর সব ধরণের ক্রিকেট থেকে দূরে থাকার পর ফিরে এসেই ৫৩ বলে ৮৫ রানের ঝকঝকে ইনিংস খেলেন তিনি। কিন্তু বিতর্কের সূচনা হয় কলকাতার ইনিংসের ষোল নম্বর ওভারে। নীতীশ রাণার অর্ধ-শতরান আর রাসেলের পাওয়ার-হিটিং-এর ভরসায় জেতার স্বপ্ন দেখছিলেন নাইটফ্যানরা। কিন্তু খেলার মাঝখানেই হঠাৎ নিভে যায় একটি ফ্লাডলাইটের বেশ কিছু আলো। প্রায় চোদ্দ মিনিট পরে খেলা শুরু হলে প্রথম বলেই কলকাতা হারায় রাণাকে। রাসেলের অতিমানবিক ইনিংস কলকাতা জিতিয়ে দেওয়ায় সেভাবে হইচই হয়নি কিন্তু কলকাতা হারলে মোমেন্টাম নষ্টের দায় কাঠগড়ায় চড়তে হত ইডেন গার্ডেন্সের ফ্লাডলাইটকে।
তৃতীয় খেলায় ঋষভ পন্থের অসাধারন ইনিংসে ভর দিয়ে ওয়াংখেড়েতে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সকে হারায় নতুন নামের দিল্লী ক্যাপিটাল। ঐ ম্যাচে বিশেষ বিতর্ক না হলেও সব পুষিয়ে দেয় পরের ম্যাচ।
সোমবার সন্ধ্যায় জয়পুরে মুখোমুখি হয়েছিল রাজস্থান রয়্যালস এবং কিংস ইলেভেন পাঞ্জাব। ‘ইউনিভার্সাল বস’ ক্রিস গেইলের ঝড়ো ৭৯ রান এবং সরফরাজ খানের ৪৬ রানের দৌলতে ১৮৪ রান তোলে পাঞ্জাব। জবাবে জস বাটলারের ব্যাটে ভর দিয়ে ভালোই শুরু করেছিল রাজস্থান। ১২ ওভারে এক উইকেট হারিয়ে ১০৫ রান তুলে ফেলেছিল তারা। দশটা চার আর দুটো ছয় মেরে ৪১ বলে ৬৭ রানে অপরাজিত বাটলার। নিজের চতুর্থ ওভার বল করতে এলেন পাঞ্জাবের অধিনায়ক রবিচন্দ্র আশ্বিন। ওভারের পঞ্চম বল করতে এসে হঠাৎ নন-স্ট্রাইকার প্রান্তের উইকেট ভেঙে দেন আশ্বিন। বাটলারের ব্যাট তখন ক্রিজের কয়েক ইঞ্চি বাইরে। আইপিএলের প্রথম মানকাডিং এর শিকার হলেন বাটলার। কিন্তু যেকোন মানকাডিং ঘটনার মতই এই নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। মাঠের মধ্যে তর্কাতর্কিতে জড়িয়ে পড়েন আশ্বিন এবং বাটলার আর মাঠের বাইরে এই ঘটনা নিয়ে দুই ভাগ হয়ে যায় পুরো বিশ্ব-ক্রিকেট। একদিকে হর্ষ ভোগলে, ডিন জোন্স আর আকাশ চোপড়া সমর্থন করেন কারণ ক্রিকেটের নিয়ম অনুযায়ী ‘মানকাডিং’ একেবারেই সঠিক। অন্যদিকে শ্যেন ওয়ার্ন, মাইকেল ভন বা ডেল স্টেনরা প্রশ্ন তোলেন ‘স্পোর্টসম্যান স্পিরিট’ বা ‘ক্রিকেট ভদ্রলোকের খেলা’ সেই নিয়ে। দিনের শেষে এই নিয়ে মতভেদ থাকবেই। শুধু বোলারের দিকে না দেখে ব্যাটসম্যান ক্রিজ থেকে বেরিয়ে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করছে কিনা সেটাও দেখা দরকার। বাটলারের এর আগে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এইভাবে আউট হয়েছিলেন শ্রীলংকার বিরুদ্ধে। তাই আরো একটু সাবধানতা নেওয়ার হয়তো দরকার ছিল। এমনকি শেষ পর্যন্ত এমসিসির কর্তারাও বক্তব্য রেখেছেন এই ঘটনা নিয়ে। রাজস্থানের শেষ অবধি হেরে যাওয়াও আগুনে ঘি ঢেলেছে কিছুটা।
ইডেনের পরের ম্যাচেও আন্দ্রে রাসেলের ব্যাটিং ঝড়ে ভর দিয়ে জেতে নাইটরা। কিন্তু নিজের পঞ্চম বলে মহম্মদ শামির অসাধারণ ইয়র্কারে বোল্ড হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। পুরো ইডেনের কেকেআর ফ্যানদের দীর্ঘশ্বাসের মধ্যে দিয়ে যখন ফিরে যাচ্ছেন রাসেল তখনই হঠাৎ আম্পায়ার নো-বল ডেকে ফিরিয়ে আনেন রাসেলকে। দেখা যায় যে ৩০-গজ বৃত্তের মধ্যে মাত্র তিনজন পাঞ্জাব খেলোয়াড় ফিল্ডিং করছেন যেখানে সংখ্যাটা হওয়ার উচিত চার। জীবন পেয়ে আর ফিরে তাকাতে হয়নি রাসেলকে। এক সময় টানা ৮ বলে পাঁচটি ছয় এবং তিনটি চার মারেন তিনি। শেষ করেন ১৮ বলে ৪৮ রান করে।
বেঙ্গালুরুর প্রথম ম্যাচেও উত্তেজনার কমতি ছিল না। ভারতীয় দলের অধিনায়ক এবং সহ-অধিনায়ক বিরাট এবং রোহিত একে অপরের মুখোমুখি হয়েছিলেন। ফ্যানদের উৎসাহের সঙ্গে তাল মিলিয়ে খেলাও জমে উঠেছিল। এবি ডি ভিলিয়ার্সের চেষ্টা সত্বেও রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্সের মিডল অর্ডারের ব্যর্থতায় শেষ বলে সাত রানের প্রয়োজন ছিল তাদের। তরুণ খেলোয়াড় শিবম দুবে কোন রান নিতে না পারায় ছয় রানে জিতে যায় মুম্বাই। কিন্তু এর পরে রিপ্লেতে দেখা যায় মুম্বাইয়ের মালিঙ্গা শেষ বলটিতে ক্রিজের বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। সেই হিসেবে ওটি একটি নো-বল এবং পরের বলে একটি ফ্রি-হিট দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আম্পায়ারের ব্যর্থতায় সেই সুযোগ হারায় বিরাট কোহলির দল। দৃশ্যতই বিরক্ত ছিলেন বিরাট, ম্যাচের শেষের সাক্ষাৎকারেও নিজের ক্ষোভ চেপে রাখেননি তিনি। এমনকি জয়ী দলের অধিনায়ক রোহিতও এই ঘটনার সমালোচনা করতে ছাড়েননি।
সব মিলিয়ে প্রথম সপ্তাহতেই জমে উঠেছে ২০১৯ সালের ভারতীয় প্রিমিয়ার লিগ। দেখা যাক, পরের সপ্তাহে আবার ক্রিকেট ফ্যানদের জন্য কী ধরনের চমক অপেক্ষা করে আছে!