Advertisment

কেকেআর কেন কেকে-হার?

ঘরের মাঠে নাইটদের বরাবরই অপ্রতিরোধ্য লেগেছে গত কয়েক বছর ধরে। এবার আর লাগছে না। কারণ সহজবোধ্য।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
ipl 2019 kkr andre russell

কতদিন আর একা কুম্ভ হয়ে গড় রক্ষা করবেন আন্দ্রে রাসেল? ছবি: কেকেআর-এর টুইটার পেজ থেকে

হারতে হারতে প্রায় 'হারাধন' অবস্থা শাহরুখ খানের টিমের। আইপিএল শেষ ল্যাপের দৌড় শুরু করেছে এবং কলকাতা নাইট রাইডার্স দশটা ম্যাচে ছ'টা হেরে লিগ টেবলে ছয় নম্বরে। প্লে অফে যাওয়ার স্বপ্ন জিইয়ে রাখতে গেলে বাকি চারটে ম্যাচের চারটেতেই জিততে হবে। যেটা দীনেশ কার্তিকের টিম করতে পারবে, এমন আশা ঘোর নাইট সমর্থকও করছেন না। এবার নাইটদের নতুন স্লোগান ছিল, 'আখরি দম তক, আখরি রান তক!' কোথায় কী! যেভাবে চলছে, পয়েন্টস টেবলে 'আখরি' জায়গায় না শেষ করতে হয়!

Advertisment

কেন এমন হল? কেন এমন হচ্ছে?

ঘরের মাঠে নাইটদের বরাবরই অপ্রতিরোধ্য লেগেছে গত কয়েক বছর ধরে। এবার আর লাগছে না। কারণ সহজবোধ্য। ইডেনের স্লো উইকেটে নাইটদের জেতার একটা সোজাসাপ্টা টেমপ্লেট ছিল। নারিন-কুলদীপ-পীযুষ চাওলাকে লেলিয়ে দাও। ধুমধাড়াক্কা মারা যাবে না যখন-তখন। হয় রান আটকে যাবে, নয় নিয়মিত উইকেট আসবে। এই ফর্মুলা এবার মুখ থুবড়ে পড়েছে। কারণ, গত বছর থেকেই ইডেনের বাইশ গজে উলটপুরাণ। স্লো টার্নার তো নয়ই, বরং ঘাসে ভরা সবুজ পিচ এখন পেসারদের যৌবনের উপবন।


ক্রিকেটে একটা কথা আছে। ’Horses for courses’, যুদ্ধক্ষেত্রের চরিত্র অনুযায়ী সৈন্যদল নামানো। নাইটদের টিম ম্যানেজমেন্ট নিলামে দল নির্বাচনের সময় এই ব্যাপারটাকে মাথায়ই রাখেনি। ঘরের মাঠের পিচের চরিত্র বদলকে হেলায় উপেক্ষা করেছে। পেসার বলতে ভরসা রেখেছে অনভিজ্ঞ প্রসিধ কৃষ্ণ এবং নেহাতই সাদামাটা দুই বিদেশি, লকি ফার্গুসন এবং হ্যারি গার্নির উপর। যাঁরা না পারছেন পাওয়ার প্লে-তে উইকেট তুলতে, না পারছেন ডেথ ওভারে রান আটকাতে। দোকানে আর 'মাল' নেই, তাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এঁদেরই খেলাতে হচ্ছে। এবং মাশুল দিতে হচ্ছে প্রতি ম্যাচেই।

পেসারদের দৈন্যদশা যাঁদের দিয়ে ঢেকে দেওয়ার দিবাস্বপ্ন দেখেছিল কেকেআর ম্যানেজমেন্ট,সেই স্পিন ত্রয়ীকে নখদন্তহীন লাগছে এবার। নারিন মানেই ইকোনমি রেট ওভারপিছু ছয় থেকে সাতের মধ্যে, ঝুলিতে অন্তত দুটো উইকেট, এই পরিচিত ছবিটা বদলে গেছে। এখনও টিমের সেরা স্পিনার, কিন্তু নারিনকে নিয়ে প্রতি ম্যাচেই বিপক্ষের আতঙ্কে ভোগার দিন শেষ হয়ে গেছে। ওভার পিছু সাত-আট করে দিচ্ছেন, উইকেট তোলার ক্ষেত্রেও খরা। কুলদীপ যাদব? ন'টা ম্যাচ খেলে চারটে উইকেট, তাঁর চায়নাম্যান খেলার 'মেড ইজি' যে ব্যাটসম্যানদের হাতে এসে গেছে, দিনের আলোর মতো স্পষ্ট চলতি আইপিএল-এ। আরসিবি ম্যাচে মইন এমন ঠেঙালেন যে হাঁটুতে মুখ গুঁজে কেঁদেই ফেললেন কুলদীপ। লেংথ-লাইন ছড়িয়ে ছিয়াত্তর, হয় শর্ট ফেলছেন, নয় ব্যাটসম্যানের জিভে জল আনা নির্বিষ ফ্লাইটেড।

আরও পড়ুন: ওয়ার্নার-বেয়ারস্টো ঝড়ে কেকেআরের টানা পঞ্চম হার

রইলেন বাকি পীযুষ চাওলা। অর্ধেক ম্যাচে চার ওভার বলই দেওয়া যাচ্ছে না। মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে এক দু'ওভার করছেন, বেধড়ক ধোলাই খেয়ে সেই মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে ফিরে যাচ্ছেন ফিল্ডিং পজিশনে। কেন টিমে আছেন, কেউ জানে না।

পেসারদের অসহায় দেখাচ্ছে, স্পিনাররা খাবি খাচ্ছে। এই বোলিং নিয়ে জেতার আশা করাটা অনুব্রত মণ্ডলের মুখে লাগাম পরানোর থেকেও অলীক কল্পনা।

যেমন অলীক কল্পনা একা আন্দ্রে রাসেলের দানবিক ব্যাটের উপর ভর দিয়ে প্রতি ম্যাচেই বৈতরণী পারের প্রার্থনা। চারটে জয়ের তিনটে দ্রে রাসের অতিমানবিক ব্যাটিংয়ের সৌজন্যে। বাকিরা কী রাজকার্য করতে টিমে আছেন তাহলে? ক্রিস লিন ধারাবাহিক নন। নারিনের ব্যাটিং ফাটকা, চললে পঞ্চানন, আর না চললে পাঁচু। রবিন উথাপ্পা আর কতটা খারাপ খেললে নাইটদের সংসার থেকে পাকাপাকি ঘাড়ধাক্কা খাবেন, সে নিয়ে তদন্ত কমিশন বসানোর সময় হয়েছে। মন্দের ভাল নীতিশ রানা। রান করেছেন। শুভমান গিলের মতো প্রতিভাকে নির্দিষ্ট একটা ব্যাটিং অর্ডার দিয়ে থিতু হওয়ার সুযোগই দিচ্ছে না থিঙ্কট্যাঙ্ক। অধিনায়ক কার্তিকের ব্যাটসম্যান হিসেবে ততটাই অবদান, যতটা হতে পারে চল্লিশ ডিগ্রি গরমে স্বস্তি দিতে হাতপাখার।

ipl 2019 kkr পেস, স্পিন, সবই নখদন্তহীন

অতএব রাসেল! আস্কিং রেট ১৮ বা ২০, এই অবস্থায় ধুঁকতে থাকা টিমকে যিনি অলৌকিক ব্যাটিং-তাণ্ডবে জয় এনে দেবেন নিয়ম করে, চাতকের প্রতীক্ষায় বাকি টিম। ২০ বলে ৬৫ চাই? ৩০ বলে ৯৩? রাসেল আছে, ঠিক বের করে দেবে, এই তো দাঁড়িয়ে গেছে ব্যাপারটা। অথচ এই রাসেলের ব্যাটিং অর্ডার নিয়ে যা করছে নাইটদের টিম ম্যানেজমেন্ট, সেটা চলতি আইপিএল-এর বৃহত্তম কেলেঙ্কারি। পাড়ার 'তরুণ সংঘ' বনাম 'ইউথ স্পোর্টিং ক্লাব'-এর টি টুয়েন্টি ম্যাচেও টিমের সেরা ব্যাটসম্যানকে যথাসম্ভব বেশি বল খেলার সুযোগ দেওয়া হয়। এই ফরম্যাটের একেবারে অ-আ-ক-খ এটা।

রাসেল ওপেনার নন। কিন্তু চার নম্বরে নামার পক্ষে যে নাইটদের সেরা বাজি, কেকেআর যে এই মরশুমে 'কলকাতা রাসেল রাইডার্স', সেটা ময়দানের লজেন্স বিক্রেতাও জানে। জানেন না শুধু দীনেশ কার্তিক আর ডাগ আউটে গম্ভীর মুখে বসে থাকা জাক কালিস। যে লোকটা কুড়িটা বল খেলার সুযোগ পেলে ৪৫-৫০ করতে পারে অনায়াসে, তাঁকে অন্তত পঁয়ত্রিশ-চল্লিশটা বল খেলার সুযোগ দেওয়া হবে না? রবিবারের সানরাইজার্স ম্যাচে রাসেলের আগে ব্যাট করতে এলেন কিনা রিঙ্কু সিং! দ্রে রাস নামলেন সাতে, যখন সাকুল্যে বাকি গোটা পঁচিশেক বল।

কী দাঁড়াচ্ছে? আপনার হাতে একে-৪৭ থাকা সত্ত্বেও বাঁশের লাঠি নিয়ে নেমে যাচ্ছেন যুদ্ধ করতে! এবং মাথা মুড়িয়ে ফিরে আসছেন অবধারিত। কারা ঠিক করে এই অদ্ভুতুড়ে কাণ্ডজ্ঞানহীন ব্যাটিং অর্ডার?

কারা আবার? দীনেশ কার্তিক, জাক কালিস, সাইমন কাটিচ, মেন্টর অভিষেক নায়ার (অভিষেক নায়ারটা আবার কে? সে কী করে মেন্টর হলো? এই প্রশ্নটা করবেন না। উত্তর জানা নেই), ভাইস ক্যাপ্টেন রবিন উথাপ্পা... টিম ম্যানেজমেন্ট বলতে তো এই। অভিষেক নায়ার-টায়ার বা সাইমন কাটিচ ছেড়ে দিন, কালিসেরও কি বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ পেল? কোচ হিসেবে বছর বছর লক্ষ লক্ষ ডলার পকেটে নিয়ে বাড়ি চলে যাচ্ছেন, অথচ একটা যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাটিং অর্ডার ঠিক করে উঠতে পারলেন না এতগুলো ম্যাচ পরেও। কোচ এবং তাঁর সাপোর্ট স্টাফদের টার্মিনেশন লেটার টাইপ করার নির্দেশ দেওয়ার কাজটা শাহরুখকেই করতে হবে সিজন শেষে। এই ম্যানেজমেন্ট দিয়ে হয় না। হবে না।

এই ক্যাপ্টেনকে দিয়েও হবে না। ব্যাটসম্যান হিসেবে চূড়ান্ত ব্যর্থ, নিজে দায়িত্ব নিয়ে ব্যাটিং অর্ডারে উপরে উঠে আসার সাহসও নেই দীনেশ কার্তিকের। অধিনায়ক হিসেবেও চরম রক্ষণাত্মক মানসিকতার। যতটা না জেতার জন্য, তার থেকেও বেশি খেলেন না-হারার জন্য। এখানেই প্রাক্তন অধিনায়ক গম্ভীরের সঙ্গে তফাৎ। গম্ভীর আগ্রাসী ক্যাপ্টেন্সি করতেন, সবসময় প্ল্যান বি রেডি থাকত। কখনও জিততেন, কখনও পারতেন না। কিন্তু নেতৃত্ব দিতেন সামনে থেকে, হাল-না-ছাড়া মনোভাব নিয়ে। কার্তিকের নেতৃত্বে না আছে উদ্ভাবনী ভাবনার ছাপ, না আছে টিমকে তাতিয়ে তোলার ক্ষমতা। গম্ভীর মিছরি হলে কার্তিক নেহাতই মুড়ি। দুইয়ের এক দর যে হয় না, বোঝা তো যাচ্ছেই।

সুতরাং করছে, লড়ছে, হারছে রে!

Advertisment