আট বছর আগে, হার্দিক পান্ডিয়া তাঁর বুকে লুকিয়ে রাখা খিদে আর ঠান্ডা মাথা নিয়ে মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের বিখ্যাত ড্রেসিংরুমে প্রবেশ করেছিলেন। তিনি এবার ফের সেই পুরোনো জায়গায় এলেন, যেখানে এখনও দলের সেরা অলরাউন্ডার হিসেবে তাঁর নাম লেখা আছে। ২০১৫ সালের গ্রীষ্ম এবং ২০২৩ সালের শীতের মধ্যে, পান্ডিয়া বিশ্বের সবচেয়ে দক্ষ অলরাউন্ডারদের একজন হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেছেন। নিজেকে সাজিয়ে তুলেছেন সাফল্যের একের পর এক ভূষণে। মাঝে মধ্যে যে তাঁকে নিয়ে বিতর্ক হয়নি, তা নয়। তবে, একজন সফল এবং বিতর্কিত এই ব্যক্তিত্ব কিন্তু সবসময়ই একজন বর্ণময় রূপে দলের কাছে ধরা দিয়েছেন। গুজরাট টাইটানসের সঙ্গে দুই বছর সফলভাবে ঘর করার পরে, এবার তিনি মুম্বই ইন্ডিয়ান্সে এলেন কোনও উচ্ছৃঙ্খল পুত্র হিসেবে নয়। একজন প্রমাণিত ব্যক্তিত্ব হিসেবে।
সাফল্যের উচ্চতা, আভা এবং ক্লাব কীভাবে কাজ করে, সেই ব্যাপারে ভিতর থেকে জ্ঞান রয়েছে। রোহিত শর্মার স্থলাভিষিক্ত হওয়ার জন্য এর চেয়ে উপযুক্ত প্রার্থী মুম্বই ইন্ডিয়ান্স পেতেই পারত না। হার্দিকের ড্রেসিংরুমের সঙ্গে বা তাঁর সঙ্গে ড্রেসিংরুমের পরিচিত হওয়ার কোনও দরকার নেই। এই ড্রেসিংরুম যেন সেই অস্থাবর আসবাবপত্র, যা হার্দিক তাঁর প্রতিবেশীকে বিয়ের জন্য ধার দিয়েছিলেন। অথবা, এমনটাও মনে করা যেতে পারে যে হার্দিক অন্য ফ্র্যাঞ্চাইজিতে গিয়ে তাঁর নেতৃত্বের নৈপুণ্যকে পালিশ করার জন্য সময় ব্যয় করেননি। পরিবর্তে লম্বা চোট-আঘাত থেকে ফিরে আসছেন।
এমনকি টাইটানস গ্রুপে তিনি মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের আলাদা ইমেজ তৈরি করেছেন। অধিনায়কত্বের রোহিত ব্র্যান্ডেও যার পরশ ছিল। তারুণ্যের প্রতি তাঁর অধ্যবসায়, তাঁর বাছাই করা খেলোয়াড়দের প্রতি আস্থা রাখা, হাতে-কলমে সেই খেলোয়াড়দের সঙ্গে মাঠে জয়ের লক্ষ্যে ছোটা, একই ঘরানার গুণীজনের মত, যেখানে রোহিতেরও ছায়া ছিল। হার্দিক যে রোহিত-ক্লোন, এমন নয়। তবে, মিলও নেহাত কম না। বলতে গেলে হার্দিক যেন একজন ঠান্ডা মাথার রোহিত। কিন্তু, এবার দু'জনেই একই দলে। যার জেরে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, রোহিতের উপস্থিতি কি হার্দিকের আগুনকে বরফ করে দিতে পারে?
তবে, অনুরাগীদের আশা, তেমন আশঙ্কার কিছু ঘটবে না। এবারে হার্দিকের মুম্বই ইন্ডিয়ান্স যাত্রায় সম্ভবত, রোহিতের সঙ্গে কোনও খোঁটাখুঁটি লাগবে না। রোহিত বা তিনি, কেউই দলে একসঙ্গে থাকায় অস্বস্তি বোধ করবেন না। এমএস ধোনির সঙ্গে যৌথভাবে সবচেয়ে বেশি আইপিএল-খেতাব জয়ী অধিনায়ক রোহিতের সাফল্যের বোঝা হার্দিককে চূর্ণ করবে না। কারণ, অতীত দেখিয়েছে যে হার্দিককে দায়িত্ব বিরক্ত করে না। বরং, তাঁর থেকে সেরাটি বেরিয়ে আসে। পিতৃত্ব এবং অধিনায়কত্ব (কফি উইথ করণ-এ যেমনটা তিনি বলেছেন) তাঁকে আরও পরিপক্ক এবং অভিজ্ঞ করে তুলেছে। একইভাবে, রোহিতও খুব পেশাদার। তিনি আবেগ সংযত রাখতে জানেন। আর, এটাই খেলার সত্যতা-যে কেউ চিরকাল অধিনায়ক থাকেন না। রোহিত তো আইপিএলে হরভজন সিং, লাসিথ মালিঙ্গা এবং কাইরন পোলার্ডদেরই উত্তরসূরি।
আরও পড়ুন- মুম্বইয়ে গৃহযুদ্ধ! রোহিতকে ছেঁটে ফেলতেই বুমরার পরে মুখ খুলে বিষ্ফোরণ সূর্যকুমারের
সিএসকে যখন ধোনিকে বাছাই করেছিল, তখন তিনি কেবল সদ্য চালু হওয়া টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে ভারতের অধিনায়ক ছিলেন। শীঘ্রই অবশ্য তিনি অন্যান্য ফরম্যাটে নিজেকে মেলে ধরেন। আর, ভারতের অন্যতম সেরা ক্রিকেট অধিনায়ক হয়ে ওঠেন। আইপিএলে সাফল্যের ওজন এবং যোগ্যতার ভিত্তিতে অধিনায়ক হয়েছিলেন রোহিত। হার্দিক যে রোহিত বা ধোনির মত সফল হতে পারবেন, এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। তবে, তাঁর ওপর আস্থা রাখা যেতেই পারে। এমনকী এই সিদ্ধান্ত, রোহিত এবং হার্দিক উভয়ের জন্যই লাভদায়ক হতে পারে।
কারণ, রোহিতের বয়স এখন ৩৬। কেরিয়ার শেষের দিকে। তিনি দেশের সর্ব-ফরম্যাটের অধিনায়ক। যার ফলে, বছরব্যাপী খেলা তাঁর ওপর মানসিক এবং শারীরিক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। আইপিএলে অধিনায়কত্ব কেড়ে নেওয়া এক্ষেত্রে রোহিতকে ভারমুক্ত করবে। তার সুবাদে তিনি নিজের ব্যাটিংয়ে আরও বেশি মনোনিবেশ করতে পারবেন। বিধ্বংসী রোহিতকে নতুন করে পেতে পারে ক্রিকেট দুনিয়া। একথা বলার কারণ, গত দুই আইপিএলে রোহিত ৩০ ইনিংসে মাত্র ৬০০ রান করেছেন। গড়ে ২০, যা তাঁর সামগ্রিক গড় রান ২৯-এর নীচে। স্ট্রাইক রেট ১২৫। অথচ, তাঁর কেরিয়ারে স্ট্রাইক রেট ১৩০।
আর, হার্দিকের বয়স এখন মাত্র ৩০। এমন বয়স, যা পরিপক্কতা এবং সর্বোচ্চ ফর্মকে একসঙ্গে মেলে ধরতে পারে। শুধু হার্দিক বলে না। এই বয়সটা এমনই, যে কেউ একইসঙ্গে তরুণ এবং অভিজ্ঞ। মুম্বই ইন্ডিয়ান্স দলটি টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে কিংবদন্তি। এখানে অভিজ্ঞদের পাশাপাশি, তরুণদেরও নিজেদের মেলে ধরার সুযোগ থাকে। যেমন ৩৬ বছর বয়সি কাইরন পোলার্ডের ৬৩৭টি ম্যাচ আর ২২ বছর বয়সি নেহাল ওয়াধেরার ১৪টি ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতার সাক্ষী এই দল। আর, সেই কারণেই রোহিতের প্রাসঙ্গিকতা এখানে কমবে না। তিনিই হবেন প্রথম ব্যক্তি, যাঁর সঙ্গে হার্দিক পরিকল্পনা করবেন। আর, কৌশলের জন্য পরামর্শ করবেন। রোহিতই হবেন প্রথম মুখ, হার্দিক যাঁকে মাঠে খুঁজবেন। তাঁর কথাকে আলাদা মূল্য দেবেন। সম্মান করে আদেশের মত পালন করবেন।
সবচেয়ে বড় কথা, খেলাধুলার মঞ্চে পরিবর্তন একটি অনিবার্য বিষয়। কয়েক বছর আগেও কোহলি ও রোহিতের নেতৃত্বে ছিলেন ধোনি। এরপর ধোনি ও রোহিতকে নেতৃত্ব দেন কোহলি। এখন, রোহিতই কোহলির অধিনায়কত্ব করছেন। আর, উভয়ে প্রায় ভারতকে তার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্বকাপ জয়ের দিকে নিয়ে গিয়েছেন। অনেক ধোনিবাদ এবং কোহলিজম এখনও ভারতীয় দলে রয়ে গেছে। ঠিক যেমন রোহিতের আদর্শ হার্দিকের দলেও উজ্জ্বলভাবে জ্বলবে। সেটাই হবে হার্দিকের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। রোহিতের উত্তরাধিকার রক্ষা করা এবং নিজের উত্তরাধিকারও তৈরি করা।