-রবিউল ইসলাম বিদ্যুৎ, ঢাকা
বাংলাদেশ ফুটবলের জীবন্ত কিংবদন্তি তিনি। নিজ দেশের গন্ডি পেরিয়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন কলকাতার ময়দানেও। খেলেছেন সেখানকার শতবর্ষ প্রাচীন ক্লাব ইষ্টবেঙ্গলে। ফুটবল নিয়ে বাঙালিদের দু’ভাগ হয়ে যাওয়াটাও প্রত্যক্ষ দেখেছেন স্বচক্ষে। তিনি আর কেউ নন শেখ মোহাম্মদ আসলাম। বাংলাদেশের গোলমেশিন। শনিবার ইন্ডিয়ান সুপার লিগে ইস্টবেঙ্গল-মোহবাগানের মহা-ডার্বি। তার আগে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-র কাছে স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসলেন তিনি। টাইমমেশিনে চড়ে ফিরে গেলেন নব্বই দশকের গোড়ার দিকে।
আসলাম বলছিলেন, "ওই সময় চ্যাম্পিয়ন কাপ খেলতে বাংলাদেশে এসেছিল ইস্টবেঙ্গল। আমি আবাহনীর হয়ে খেলেছিলাম। ইস্টবেঙ্গলের বিপক্ষে ফাইনালে আমার দেওয়া একমাত্র গোলে আবাহনী চ্যাম্পিয়ন হয়। এরপর তখনকার ইস্টবেঙ্গলের সচিব সুপ্রকাশ গড়গড়ি দা’র নির্দেশে ডেকে পাঠানো হয়। রাতে হোটেলে গিয়ে দেখি গড়গড়িদা বিষণ্ণ। সঙ্গে আসা বৌদি কাঁদছেন। আমাকে দাদা বললেন- আসলাম তোমাকে নিয়ে যাব।”
আরও পড়ুন: ডার্বিতে মনে হয় না ইস্টবেঙ্গল পারবে! মহাযুদ্ধের আগেই ভবিষ্যৎবাণী মানোলোর
এখানেই না থেমে আসলাম বলে চলেন, "আব্বাকে ইস্টবেঙ্গলে যাওয়ার বিষয়টি বলার পর উনি বললেন, “যা খেলে আয়।” আমার ক্লাব আবাহনীও ‘না’ করেনি।এরপরে দাদাকে বুঝিয়ে বললাম, আমরা যদি এখান থেকে তিনজন যাই ভালো হবে। উনি মুন্না-রুমির ব্যাপারেও উনি সায় দিলেন।”
আইএসএলে এই মুহূর্তে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচ নিয়ে উত্তেজনার পারদ চড়ছে কলকাতায়। বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীরা কী আগের মতো অনুসরণ করেন ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ডার্বি? প্রশ্নটা শুনে আসলাম বলে গেলেন, "যারা ফুটবলপ্রেমী অবশ্যই এই ম্যাচের খোঁজ রাখেন। রেডিওতে শুনবে, নয়তো টিভিতে দেখবে। ইস্টবেঙ্গল এক অর্থে বাংলাদেশেরই দল। এদেশের আবেগ জড়িয়ে রয়েছে দলটির সঙ্গে। আর মোহনবাগান কলকাতার। এই দু’দলের ম্যাচ মানে বাঙালিদের দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যাওয়া।”
নিজের সময়কার ডার্বির কথা বলতে গিয়ে ফোনের ওপ্রান্তে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন আসলাম। ফেলে আসা স্মৃতি হাতড়ে তিনি এক নিঃশ্বাসে বলে চলেন, "বাংলাদেশে আবাহনী-মোহামেডানের যেমন ক্রেজ, কলকাতায় সেরকম ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচেও সেই উত্তেজনা। আমাদের এখানে একটু বেশি-ই থাকে রেষারেষি। মাঠের উত্তেজনায় ফুটবলাররা জড়িয়ে পড়ায় মারামারি লেগে যেত। কিন্তু ওখানে মারামারি হত না। তবে মাঝে মাঝে গ্যালারিতে উত্তেজনা তীব্র আকার ধারণ করত। ওরা ফুটবলকে পাগলের মতো ভালোবাসতে জানতো। ক্লাব থেকে শুরু করে সমর্থকরা আমাদের সবাই আপন করে নিয়েছিলেন। কখনও মনে হয়নি, বাংলাদেশের বাইরে খেলছি। এত আতিথেয়তা কোথাও পাইনি।"
আরও পড়ুন: ডার্বির আগেই মহা-চমক! CFL-এর সেরা স্ট্রাইকারকে সই করাল ইস্টবেঙ্গল
"কোচ মইনুদ্দিন আমাদের ভীষণ আদর করতেন। তিনি ছিলেন ফুটবল পাগল মানুষ। ছিলেন আমাদের অভিভাবক। সুখ-দুঃখ সবকিছু আমাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করতেন।
বাংলাদেশে আবাহনী-মোহামেডান বহু ম্যাচ উত্তেজনায় পন্ড হয়েছে। ওখানে এই জিনিসটা হয়নি। সবসময় ফুটবলেরই জয় হয়েছে।”
এখনও কলকাতার ফুটবলাররা রয়েছেন আসলামের হৃদয়জুড়ে। তিনি বলছিলেন, "কতজনের নাম বলব। অনেকের কথা মনে আসছে। কৃশানু দে, বিকাশ পাঁজি মিডফিল্ডে খেলতেন, মোহনবাগানের অলোক দে, বাবু মনি, সুব্রত ভট্টাচার্যের কথা মনে পড়ে এখনও। প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, চুনি গোস্বামীরা ছিলেন খুব উঁচুমানের ফুটবলার। এখন ওই মাপের ফুটবলার আর নেই।”
ইস্টবেঙ্গলে খেলেছেন বলে আসলামের সেই আবেগ আগের মতোই রয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয় দলের প্রাক্তন অধিনায়ক মামুনুল ইসলামও অ্যাটলেটিকো ডি কলকাতায় সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনি বাস্তবতা মেনে বলছেন, "একটা সময় বাংলাদেশি প্লেয়াররা কলকাতার লিগ, ভারতের লিগ খেলত। ফলো করার কারণও রয়েছে। ইস্টবেঙ্গল প্রতিষ্ঠা হয়েছে বাঙালদের হাত ধরে। সেই ইতিহাস আজ থেকে এক যুগ আগের মানুষও জানতো। এখন কেউ জানে না। এই ইতিহাস না জানার কারণও আছে-ভারতে কেউ খেলতে যায় না, মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলে বাংলাদেশের প্লেয়াররাও খেলছে না।”
শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাবের হয়ে কলকাতায় আইএফএ শিল্ডে খেলেছেন মামুনুল। সেই অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলছিলেন,“ আমি ওখানে শেখ জামালের হয়ে ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগানের বিপক্ষে খেলেছি। গ্রুপে মোহনবাগান আর সেমিফাইনালে ইস্টবেঙ্গলকে হারিয়ে ফাইনালে চলে যাই। সেরা দুটো টিমকে হারানোর পর সব ফোকাস আমাদের দিকে ঘুরে যায়।”
যদিও ফাইনালে কলকাতা মোহামেডানের নিকট পেনাল্টিতে ২-৪ ব্যবধানে হেরে যায় শেখ জামাল।
তবে ডার্বিতে মামুনুল এগিয়ে রাখলেন মোহনবাগানকেই। তাঁর বক্তব্য, "সব দিক বিবেচনায় ইস্টবেঙ্গলের থেকে মোহনবাগানই এগিয়ে থাকবে। আইএসএলে শীর্ষ দলগুলোর মাঝে মোহনবাগানের নামও রয়েছে। এই ম্যাচকে ঘিরে বাঙালীরা বিভক্ত হবে, নিজ নিজ দলকে তারা সমর্থন করবে এবং একই সঙ্গে সুন্দর একটা পরিবেশ তৈরি হবে গোয়ার স্টেডিয়ামে। যা দেখতেও ভালো লাগে।”
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন