“রেফারি হবি?”
এই একটা প্রশ্ন বদলে দেয় কণিকার জীবনের রূপরেখা। কণিকা বর্মণ, বর্তমানে ভারতের দুজন মহিলা ফিফা প্যানেলভুক্ত রেফারির একজন, অন্যজন মণিপুরের রঞ্জিতা দেবী। শিলিগুড়ির শালুগাড়া এলাকার ২৬ বছর বয়সী ছোটখাটো চেহারার এই বঙ্গতনয়া আপাতত তৈরি হচ্ছেন জুন মাসে পরীক্ষা দিয়ে এশিয়ান ফুটবল ফেডারেশনে প্রবেশ করার লক্ষ্যে। পাশাপাশি রয়েছে কলকাতা পুলিশের র্যাপিড অ্যাকশন ফোর্সে সিভিক ভলান্টিয়ারের কাজও।
অথচ শুরুতে আদপেই বোঝা যায় নি যে ফুটবলের রেফারি হিসেবেই ইতিহাস লিখতে চলেছেন কণিকা। শালুগাড়ার এক সাধারণ পরিবারে জন্ম, ৯ নভেম্বর, ১৯৯৩ সালে। সাত বছর বয়স থেকে অ্যাথলেটিক্সের দিকে ঝোঁক। ভাই দীপু খেলত ফুটবল। ছেলেমেয়েকে সবরকম ভাবে উৎসাহ দিতেন বাবা সরেন বর্মণ, যিনি নিজে চেয়েও পারিবারিক কারণে ক্রীড়া জগতে কেরিয়ার গড়ে তুলতে পারেন নি। তাই অধরা স্বপ্ন সফল করবে তাঁর পুত্রকন্যা, এই আশা ছিল বরাবর।
তবে অ্যাথলেটিক্সে বেশ কিছু বছর কাটানোর পর কণিকা বুঝলেন, এ বড় কঠিন ঠাঁই। “যত চেষ্টাই করি, কিছুতেই সফল হতে পারছিলাম না,” অকপটে বলেন কণিকা। তার একটা কারণ, পক্ষপাতিত্ব। তবে এ বিষয়ে কোনোরকম গ্লানি মনে স্থান দেন নি তিনি। বরং ১৬ বছর বয়সে মনোনিবেশ করলেন ফুটবলে, নতুন কেরিয়ার গড়ার লক্ষ্যে।
ফলও মিলল হাতেনাতে। সহজাত প্রতিভা এবং অ্যাথলেটিক্সের প্রশিক্ষণ তাঁকে দ্রুত এগিয়ে যেতে সাহায্য করল। অচিরেই জুটে গেল বারাসাত যুবক সংঘের মহিলা দলের হয়ে খেলার সুযোগ। এর পরে তালিকায় যুক্ত হলো আরও একাধিক ক্লাব, সঙ্গে ছড়িয়ে গেল তাঁর দক্ষতার খ্যাতিও।
২০১১ সালের শেষে শিলিগুড়িতে আয়োজিত উত্তরবঙ্গ উৎসবে এক ফুটবল টুর্নামেন্টে নিজের দলের জয় নিশ্চিত করেন কণিকা, মনোনীত হন ‘প্লেয়ার অফ দ্য টুর্নামেন্ট’ হিসেবে। সেই সময়েই শিলিগুড়ির কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়ামে চলছিল আই-লীগের দ্বিতীয় ডিভিশনের খেলা। এবং এখানেই তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন পশ্চিমবঙ্গ ফুটবল রেফারিজ অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি উদয়ন হালদারের।
একটাই প্রশ্ন ছিল উদয়নবাবুর – “রেফারি হবি?”
সেই শুরু। রেফারি ট্রায়ালের জন্য নির্বাচিত হলেন কণিকা। এদিকে ২০১২-য় যোগ দিলেন কলকাতা পুলিশেও। পাশাপাশি অবশ্য তখনও চলতে থাকল কলকাতার আশেপাশে বিভিন্ন লীগে ফুটবল খেলা। এরপর শুরু হলো নিয়মিত রেফারিগিরি, পরিচালনা করতে লাগলেন একের পর এক ম্যাচ, পুরুষ এবং মহিলা, উভয়েরই। মাঝে শারীরিক অসুস্থতার কারণে বছর দুয়েকের বিরতি নিতে হয়, যা কাটিয়ে ফের ময়দানে নেমে পড়েছেন কণিকা।
যাত্রাপথ বড় মসৃণ ছিল না। “প্রথম প্রথম ঠাট্টা করত অনেকেই। মুখের ওপরেই বলত, এ তো একটা বাচ্চা মেয়ে, এ রেফারি? পারবে নাকি?” হাসতে হাসতেই বলেন কণিকা। “পরে ধীরে ধীরে সবাই বুঝতে শুরু করল, যে না, এ পারবে।” সেই ‘পারা’র মধ্যেই অবশ্য লুকিয়ে থাকে অসংখ্য চ্যালেঞ্জ। মাঠে মারামারি হলে কী করেন? “থামাই। গায়ের জোরে নয়, কিন্তু গায়ের জোর লাগেও না। এই পেশায় মেয়ে হওয়ার অসুবিধে যেমন আছে, তেমনি সুবিধেও তো আছে। আমি মেয়ে বলেই চট করে কোনও প্লেয়ার গায়ে হাত তুলতে পারবে না, ধাক্কাধাক্কি করতে পারবে না। আমার জায়গায় কোনও পুরুষ থাকলে হয়তো মার খেয়ে যাবে!”
কলকাতার প্রিমিয়ার ডিভিশনের ম্যাচ শুধু নয়, কণিকার রেফারির বাঁশি শোনা গেছে সাউথ এশিয়ান ফুটবল গেমসেও। এবং চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে এসেছে ফিফার স্বীকৃতি, যার ফলে উচ্ছ্বসিত তাঁর ছোটবেলার শহর। আগামীতে তাঁর পাখির চোখ হয়ে থাকবে ফিফা-র ‘এলিট প্যানেল’।
“দেখুন, আমি তো রেফারি হব ভেবে ফুটবলে আসি নি, খেলতেই এসেছিলাম। কিন্তু আমার চিরকালের স্বপ্ন যে আমি এমন কিছু একটা করব, যাতে সকলে আমার নাম জানবে, মনে রাখবে। সেই স্বপ্ন যদি ফুটবলের রেফারি হিসেবেই পূরণ হয়, তাতে ক্ষতিটা কী?” সহজ প্রশ্ন কণিকার।