গত ৩০ নভেম্বরের ঘটনা। জাপানের রাজধানী টোকিওতে বসেছিল ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটির এক্সকিউটিভ বোর্ডের বৈঠক। সেখানেই নেওয়া হল এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। অলিম্পিকের পরিবারে স্বাগত জানাল হল নতুন সদস্যকে। আইওসি-র ছাড়পত্র পেয়ে গেল কিকবক্সিং। বিংশ শতাব্দীর পাঁচের দশকে এই জাপানেই ভূমিষ্ঠ হয়েছিল স্ট্যান্ড-আপ কমব্যাট স্পোর্টস। কিকিং আর পাঞ্চিংয়ের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হওয়া এই খেলা ক্যারাটে আর মিক্সড বক্সিং থেকেই বিকশিত হয়েছিল- ইতিহাস এমনটাই বলছে।
ঘটনাচক্রে আইওসি-র স্বীকৃতি পাওয়ার পরে খাস খেলাপাগল শহর কলকাতাতেই বসছে ২৫তম সিনিয়র জাতীয় কিকবক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপ। এটাও একটা ইতিহাস। গত রবিবার থেকে ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রে শুরু হওয়া এই ইভেন্ট চলবে আগামী বুধবার পর্যন্ত। কিকবক্সিং অ্যাসোসিয়েশন অফ ওয়েস্ট বেঙ্গলের সঙ্গে বেঙ্গল অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের যৌথ উদ্যেগে আয়োজিত হচ্ছে কিকবক্সিংয়ের ২৫তম জাতীয় সিনিয়র ইভেন্ট। ভারতের ২০টি রাজ্য়এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে এবার। রয়েছেন বাংলার ৫৬ জন খেলোয়াড়।
আরও পড়ুন: বোরখা না থাকায় তেহরানে আটকে যান শক্তিধারা, বাবার ইচ্ছায় বিমান চালিয়েছেন বাসন্তী
ওয়ার্ল্ড অ্যাসোসিয়েশন অফ কিকবক্সিং অর্গানাইজেশনস (ডব্লিউএকেও) অনুমোদিত ডব্লিউএকেও ইন্ডিয়া কিকবক্সিং ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট সন্তোষ কুমার আগরওয়ালকে সোমবার পাওয়া গেল ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রে। অলিম্পিকের ছাড়পত্র পাওয়ার পর তিনি স্বভাবতই আনন্দিত। বলছেন, “দেখুন ২৫ বছর ধরে ভারতে খেলাটা চলছে। বহু বছর অপেক্ষার পর আমরা এই স্বীকৃতি পেয়েছি। বলতে পারেন দীর্ঘ সংগ্রামের পর এই জয়।”
সন্তোষবাবুই জানালেন আগামী দিনে কিক-বক্সিং নিয়ে তাঁদের ভাবনার কথা। ক্রিকেট-ফুটবলের দেশে কিভাবে এই খেলা আলাদা একটা জায়গা করে নিতে পারে তার নীলনকশাও তৈরি রয়েছে তাঁদের। আগামী ২২ ডিসেম্বর ডব্লিউএকেও ইন্ডিয়া কিকবক্সিং ফেডারেশনের বার্ষিক সাধারণ সভা। সেখানেই তাঁরা ভবিষ্য়তের একটা রূপরেখা করে রাখতে চাইছেন। সন্তোষবাবু বলছেন, “দেখুন, আপাতত ওয়াডা ও ফেয়ার-প্লের মতো বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে হবে। খেলার পরিকাঠামো আরও উন্নত করতে হবে। আমরা চাইছি ২০২০ সালে একটা কিকবক্সিং লিগ চালু করতে। কেন্দ্রীয় ক্রীড়ামন্ত্রী রাজ্যবর্ধন রাঠোরের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত বৈঠক হয়েছে। উনি আশ্বাস দিয়েছেন যে, স্পোর্টস ক্যালেন্ডারের মধ্যে কিকবক্সিংকে অন্তর্ভুক্ত করবেন।”
সন্তোষবাবু জানাচ্ছেন যে, ভারতে এই খেলা ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। মহারাষ্ট্র, পশ্চিমবঙ্গ, হরিয়ানা, মেঘালয় ও কেরালার মতো রাজ্য থেকেই অধিকাংশ খেলোয়াড়রা উঠে আসছেন। মূলত আত্মরক্ষার তাগিদেই মহিলারা এই খেলাটা বেছে নিচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু বলিউডের বঙ্গললনা বিপাশা বসুর মতো অনেকেই চূড়ান্ত ফিট থাকতে কিকবক্সিংয়ের হাত ধরেছেন। সন্তোষবাবুর মতে সাত রকমের ইভেন্ট বিশিষ্ট এই খেলায় জৌলুসেরও কোনও ঘাটতি নেই। রঙচঙে পোশাক আশাকও একটা অন্যতম কারণ। এখানেই শেষ নয়, সন্তোষবাবু এও মনে করিয়ে দিলেন যে, ২০১৬ সালে বক্সিংয়ের গল্প নিয়ে তৈরি হওয়া হিট হিন্দি ছবি ‘সালা খাড়ুস’-এর কথা। তিনি বলছেন, “মাধবনের সঙ্গে যে রীতিকা মোহন সিংকে আমরা পর্দায় দেখেছি, সে কিন্তু আমাদেরই মেয়ে। ২০০৯ সালে এশিয়ান ইন্ডোর গেমসে ভারতের হয়েই কিকবক্সিংয়ে অংশ নিয়েছিল রীতিকা। এখন ও সিনেমা করছে।” তিনি এও জানিয়েছেন যে, একাধিক কর্পোরেট সংস্থা এই খেলা অর্থ বিনিয়োগ করতে ইচ্ছাপ্রকাশ করেছে। যেটা তাঁরা অত্যন্ত ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন।
সন্তোষবাবু যেমন দেশের কিকবক্সিংয়ের সামগ্রিক চিত্রটা তুলে ধরলেন, ঠিক তেমনই এই রাজ্যে এই খেলার পরিস্থিতি নিয়ে আলোকপাত করলেন কিকবক্সিং অ্যাসোসিয়েশন অফ ওয়েস্ট বেঙ্গলের প্রতিষ্ঠাতা ও সাধারণ সচিব মন্টু দাস। কিকবক্সিং অলিম্পিকের স্বীকৃতি পাওয়ায় তিনিও বেজায় খুশি। বলছেন, “২০১৪ থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাইলট প্রজেক্ট সুকন্যা চলছে কলকাতা পুলিশের সহযোগিতায়। মেয়েদের স্কুলে স্কুলে আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণের জন্যই এই প্রকল্প। আমি আজও হাওড়া পুলিশ কমিশনারেটে এই প্রজেক্টের এক্সটেনশেনর জন্য বৈঠকে যোগ দিয়েছিলাম। সুকন্যার আওতায় এখন ৫১টি স্কুল রয়েছে। এর মধ্যে ৩০টি স্কুলেই শেখানো হচ্ছে কিকবক্সিং। ভবিষ্য়তে স্কুলের সংখ্যা বাড়বে। এখান থেকেই ছেলেমেয়েরা উঠে আসছে। তারা আরও ট্রেনিং নিয়ে রাজ্য ও জাতীয়স্তরে প্রতিনিধিত্ব করছে। তাহলে বুঝতেই পারছেন পশ্চিমবঙ্গে কিভাবে ক্রমে জনপ্রিয় হয়ে উঠঠে কিকবক্সিং। সেল্ফ-ডিফেন্সের জন্য এর চেয়ে ভাল খেলা আর হতে পারে না। এখন দরকার স্কুলে স্কুলে এই খেলার প্রসার। সম্ভব হলে স্কলারশিপ। তাহলেই আর কিকবক্সিং নিয়ে ভাবতে হবে না”
বাংলারই দুই কিকবক্সার শুভজিৎ দাস ও রত্না ভেলা ইভেন্টের মাঝেই কথা বললেন। দু’জনের ঝুলিতেই রয়েছে আন্তঃস্কুল ও রাজ্য স্তরের একাধিক পুরস্কার। বছর কুড়ির শুভজিৎ বলছেন, “সেল্ফ ডিফেন্সের এটা বিশাল প্ল্যাটফর্ম। আগের থেকে খেলাটা অনেক বেশি জনপ্রিয় হয়েছে। আমি তিন বছর থেকে শিখছি খেলাটা। ফলে ফারাকটা বুঝতে পারছি। কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী রত্না বলছেন, “সুকন্যার প্রজেক্ট থেকেই আমি আজ জাতীয় পর্যায়ে এসেছি। আমি মেয়েদের বলব, আত্মরক্ষার জন্য এর থেকে ভাল কিছু হতে পারে না। শুধু শরীর নয়. এতে মনও ভাল থাকে।’’