'ফাইনাল বিটউইন বাস ড্রাইভার্স অ্যান্ড ট্রাম কন্ডাক্টর্স ' !
কোয়েস্ট মলে বড় পর্দায় বিশ্বকাপ ফাইনাল দেখতে ভিড়। গালে পতাকা আঁকানোর ব্যবস্থা আছে। হয় ফ্রান্স, নয় ক্রোয়েশিয়া। যার যেমন ইচ্ছে।
এক তরুণ গম্ভীর মুখে ঢুকছিলেন হলে। গাল পতাকাহীন। জিজ্ঞেস করলাম, "কাকে সাপোর্ট করছেন?" উত্তর এল, "কাউকে না। ব্রাজিল নেই যখন, কাউকে সাপোর্টের প্রশ্নও নেই।"
থতমত খেয়ে নিজের গালে আঁকা ক্রোয়েশিয়ার পতাকাটা লুকিয়ে ফেলব ভাবছি, তারপর মনে হলো, স্রেফ রংয়ের ভিত্তিতে দেখতে গেলে তো এটা ফ্রান্সের পতাকাও হতে পারে। যাহা মুড়ি, তাহাই মিছরি। বড় পর্দায় ম্যাচ দেখা নিয়ে কথা। ফ্রান্স জিতলে ফ্রান্স, না জিতলে ক্রোয়েশিয়া। ব্রাজিল বিহীন ফাইনালে নিরপেক্ষ দর্শক হওয়ার মজাই আলাদা। পালকের মত হালকা মন।
ব্যানার উড়ছিল মেলবোর্নে সেদিন, ভারতের ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে থাকবে নিশ্চিত। ১৯৮৫-র বেনসন and হেজেস ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ ক্রিকেটের ফাইনাল। অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড-ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো ফেভারিটরা ছিটকে গেছে দৌড় থেকে। ফাইনাল খেলছে কারা? না, ভারত আর পাকিস্তান, যাদের কেউ হিসেবের মধ্যেই রাখেনি শুরুতে। ভাবা হয়েছিল, কতদূর আর যাবে উপমহাদেশের দুই দল, বড়জোর সেমিফাইনাল। সব হিসেব পাল্টে দিয়ে যখন ফাইনালে ভারত-পাক মুখোমুখি, হতাশা আর ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল গ্যালারির একাংশে অস্ট্রেলীয় জনতার মধ্যে, উড়েছিল কুরুচিকর ব্যানার, "বাস ড্রাইভার্স অ্যান্ড ট্রাম কন্ডাক্টর্স!" ঝড় উঠেছিল সমালোচনার।
বিশ্বকাপ ফাইনালের বিকেলে কলকাতা চষে ফেলেও অবশ্য এমন কোন বিদ্রুপাত্মক পোস্টার-ব্যানার চোখে পড়েনি ফ্রান্স-ক্রোয়েশিয়াকে নিয়ে। তবে চোখে পড়েছে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা বিহীন বিশ্বকাপ ফাইনাল নিয়ে হা-হুতাশ, আর 'কী হলে কী হতে পারত'-র নিষ্ফলা আক্ষেপ। ফুটবলের শহর ফাইনাল দেখার জন্য তৈরি হয়েছে সকাল থেকে, কিন্তু সে তৈরি-হওয়ায় প্রাণের স্পর্শ ছিল না, ছিল না উত্তেজনার বারুদ। যা অবধারিত থাকত ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনার কেউ ফাইনালে থাকলে। নীল-সাদা জার্সি নেই, হলুদ-সবুজ জার্সি নেই। তা হলে আর কী থাকল? এ তো শিবহীন যজ্ঞ! প্যান্ডেল থেকে ঠাকুর চলে গেছে সপ্তমীতেই। অষ্টমী-নবমীতে আর কীসের উচ্ছাস?
সিনেমা হলের পর্দায় খেলা দেখতে দেখতেও টের পেলাম সেই একই ভাব। উভয়ের গোলেই মোটামুটি সমান খুশি উপস্থিত শ'দুয়েক দর্শক। এবং পেছনে বসা কতিপয় কিশোর যখন মদ্রিচ এম্বাপের জন্য সমপরিমাণ উৎসাহ প্রদর্শনের ফাঁকে হঠাৎ 'ব্রাজিল! ব্রাজিল!' রব তুলল, তাদের দিকে সবাই সকৌতুকে তাকালেন বটে, কিন্তু অবাক হলেন না কেউই। আরে ফাইনালের একটা আবহ তৈরি হবে তো!
বিশ্বকাপের সময় ফুটবলপাগল বাঙালির আবেগ '৮৬ অবধি পাক খেয়ে এসেছে শুধু হলুদ-সবুজ ব্রাজিলকে ঘিরে। 'সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল' যেমন, তেমন 'সব টিমের সেরা বাঙালির তুমি ব্রাজিল'। ছিয়াশিতে শহরের একচেটিয়া ব্রাজিল-সমর্থনের মানচিত্রে ভাগ বসিয়েছিল নীল-সাদা আর্জেন্টিনা। সৌজন্য, জনৈক দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা, যাঁর অলৌকিক ফুটবলশিল্প রাতারাতি আর্জেন্টিনা অন্ত প্রাণে পরিণত করেছিল বাঙালির একটা বড় অংশকে।
তা বলে ব্রাজিলের সমর্থনে ভাটা পড়েছিল, এমন ভাবারও কারণ নেই কোন। শহর জুড়ে অসংখ্য ফুটবলপ্রেমীর কাছে এখনও বিশ্বকাপ মানেই ব্রাজিল। তবে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে আর্জেন্টিনা-অনুগামীরাও। এবারে বিশ্বকাপের শুরুতে উত্তর কলকাতার কোন কোন পাড়ায় ঢুকলে গুলিয়ে যাচ্ছিল, কলকাতা, না রিও? নেইমারের ছবি আর হলুদ-সবুজ পতাকার ছড়াছড়ি, যেদিকে চোখ যায়। আবার ভবানীপুরে অন্য ছবি, মেসির কাটআউট আর দেওয়ালে দেওয়ালে নীল-সাদা গ্র্যাফিটিতে আবেগের নাম আর্জেন্টিনা।
ফাইনালের সন্ধেয় এই পাড়াগুলোতে চক্কর দিলে মায়া হবে নিষ্ঠুরতম লোকেরও। টিভি চলছে ক্লাবে। লোকে দেখছে, যেন দেখতে হয় বলে। গোল হলে নাচ নেই। গোল মিস হলে আহা-উহু নেই। শরীর আছে, আত্মা নেই এ ফাইনাল-দর্শনে। বাজিও পুড়ছে কিছু, অন্য দেবতার ভোগ হিসেবে রাখা ছিল। নষ্ট হবে, উৎসর্গ করেই দিই বাঁহাতে।