Advertisment

কৃশানুর সেই ছেঁড়া কার্টিলেজ এখনও রেখেছেন সঙ্গে, প্রেমদিবসে নস্ট্যালজিক স্ত্রী পনি

ভারতীয় ফুটবলের মিথ তিনি। কিংবদন্তি হিসাবে লোকগাঁথায় জায়গা করে নিয়েছেন। কৃশানু দে নামই এখনও শিহরণ জাগায় ফুটবল মহলে।

author-image
Subhasish Hazra
New Update
NULL

কৃশানুর সেই কার্টিলেজ এখনও রেখে দিয়েছেন স্ত্রী পনি (সংগৃহীত, সোহম দে)

কাচের সেই বয়াম এখনও সযত্নে রাখা আছে বাড়িতে। সেই বয়ামেই যে এখনও অবিকৃত অবস্থায় রয়ে গিয়েছে ভালবাসার মানুষটার ছেঁড়া কার্টিলেজের টুকরো। কোনও পড়ন্ত বিকেলে বা মধ্যরাতে স্মৃতিরা যখন জোনাকির মতো জ্বলে নেভে জ্বলে, তখন তিনি আলতো করে ছুঁয়ে দেখেন সেই কাচের বয়াম। টাইমমেশিনের সাহায্য না নিয়েই বেমালুম পিছনে ফিরে যান কৃশানু দে-র স্ত্রী পনি। তাঁর চোখের সামনে ভেসে ওঠে চিকিৎসক এমএস ঘোষ হাতে তুলে দিচ্ছেন ছোট্ট সেই মাংস পেশি। ডক্টর ঘোষের কণ্ঠস্বর এখনও অনুরণিত হয়, ''ওষুধের মধ্যে দিয়ে দিয়েছি। এটা দেখবে। আর ওঁকে বলবে শরীরের মধ্যে তাকত আনতে হবে।"

Advertisment

তার পর থেকেই সেই কার্টিলেজ সর্বক্ষণের সঙ্গী স্ত্রী পনি দে-র।

publive-image
সেই ছেঁড়া কার্টিলেজ (সংগৃহীত, সোহম দে)

১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইন্স ডে। ভালবাসার দিন। এই দিনেই জন্ম এক বাঁ পায়ের শিল্পীর। যে শিল্পী বাঁ পা দিয়ে বলকে কথা বলান। ছুরির মতো ধারালো সেই বাঁ পা ফালাফালা করে দিত বিপক্ষের রক্ষণকে। নব্বই মিনিটের আগেই বহু ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারণ করে দিয়েছে ওই বাঁ পা। সেই তিনিই অকালে চলে গিয়েছেন সবাইকে অঝোর ধারায় কাঁদিয়ে। কৃশানু দে এক আবেগের নাম। ভালবাসার নাম। আজও ময়দান কাঁদে কৃশানুর জন্য। আফশোস করে ওরকম একটা বাঁ পা আর পেল না দেশ।

publive-image
ভারতীয় ফুটবলের মারাদোনা কৃশানু দে (সংগৃহীত, সোহম দে)

ভালবাসার দিনে প্রিয় রন্টুর জন্য মন উথাল পাতাল করে করে স্ত্রী পনির আজ-ও। অফিস ফেরত ক্লান্ত, ধ্বস্ত মুহূর্তে যিনি ঘন দীর্ঘশ্বাস মাখা গলায় ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-কে ফোনে বলে চলেন, "সোহমকে (পুত্র) বলছিলাম, সবাই যে বলছিল লতার মৃত্যুর পরে নাকি কন্ঠ খুলে নেওয়া হবে, পারেনি তো! আমি কিন্তু ওঁর কার্টিলেজ রেখে দিয়েছি।"

দিন পেরিয়ে, মাস গড়িয়ে বছর, দশক ফুরিয়ে গিয়েছে। তবে ভালবাসার সাক্ষী হয়ে পনির কাছে রয়ে গিয়েছে ছোট সেই কার্টিলেজ। ফোনের ওপ্রান্তে বাষ্প জড়ো হচ্ছিল, "ভাল মানুষদের ঈশ্বর তাড়াতাড়ি ডেকে নেন। ওঁর তো যাওয়ার বয়স হয়নি। তবু চলে গেল!"

publive-image
পুত্র সোহমের সঙ্গে কিংবদন্তি (সংগৃহীত, সোহম দে)

প্রিয় মানুষ চলে গিয়েছেন, রয়ে গিয়েছে অজস্র স্মৃতি। সেই স্মৃতির চাদরে ঢেকে আজও উত্তাপ গায়ে মাখেন পনি। একবুক বিষণ্নতা নিয়ে তিনি বলছিলেন, "রন্টু লুচি খেতে ভালবাসত। আর সিমুইয়ের পায়েস। জন্মদিনে ওঁকে এগুলো রেঁধে দিতাম। ও নিজে লুচি বেলা পছন্দ করত।" জন্মদিনে খাওয়ায় সংযম হারালেও মাঠে ফেরার জন্য কড়া ডায়েটের অনুশাসনে নিজেকে বেঁধে রাখতেন বছর ভর। প্র্যাকটিসে নামার আগে মধু দিয়ে দুটো রুটি, একটা মিষ্টি খেতেন সকালে। অনুশীলন সেরে মাঠেই লাঞ্চ সারতেন স্যুপ দিয়ে।

আর সবুজ ঘাসের গালচেতে যে রূপকথা লিখে গিয়েছেন, তা পড়লে, স্মরণ করলে শরীরে কাঁটা দেয় ফুটবলপ্রেমীদের। বাঙালি নস্ট্যালজিক। কৃশানুর প্রসঙ্গ উঠলে অনেকের কানে হয়তো এখনও বাজে অজয় বসুর সেই মধু মাখানো কণ্ঠস্বর বলে চলেছে, ''কৃশানুর বাঁ পায়ের শট ঝড়া পাতার মতো এঁকেবেঁকে গোলে ঢুকে গেল।''

publive-image
চিমা ওকোরির সঙ্গে কৃশানু দে (সংগৃহীত, সোহম দে

প্রতি ক্ষণে ক্ষণে তাড়া করে জ্বলন্ত সমস্ত স্মৃতি। সেই স্মৃতির কুয়াশা সরিয়ে কৃশানু পত্নী বলে চলেন, "প্রত্যেক বছরে শত শত সমর্থক ১৪ ফেব্রুয়ারি আমাদের নাকতলার বাড়ি চলে আসতেন। এখন তো বাড়ি বদল হয়ে গিয়েছে। অনেকে জানেন না নতুন ঠিকানা।"

publive-image
নক্ষত্রখচিত সেই আড্ডা আজ অতীত (সংগৃহীত, সোহম দে)

নাকতলা থেকে এখন পনি দের নতুন ঠিকানা ব্রহ্মপুর। এই নাকতলাতেই তো লেখা হয়েছিল জীবনের এক উপন্যাস। কালীপুজোর এক সকালে কয়েকটা ছেলে পনিদের বাড়িতে এসেছিল চাঁদা চাইতে। তাদের একজন ছোটখাটো চেহারার। ঠোঁটের উপরে হালকা গোঁফের রেখা। চুলটা বেশ স্টাইল করে আছড়ানো। পনি দের বাবাকে সেই ছেলেটিই বলে উঠেছিলেন, আমার নাম রন্টু।

publive-image
এই লকেট পরে মাঠে ফুটবল নিয়ে শিল্প আঁকতেন (সংগৃহীত, সোহম দে)

প্রভাত সংঘ ক্লাবের জন্য চাঁদা চাইতে এসেছিলাম। সেই ছেলেই পরে জড়িয়ে পড়েছিলেন পনি দের জীবনের সঙ্গে। অনেক সুখ-দুঃখ-আনন্দের ঢেউয়ে ভাসিয়ে আচম্বিতেই হারিয়ে যান। নাকতলা নামটা উচ্চারণ হলেই এক নিঃশ্বাসে সবাই বলে ওঠেন, ''আরে এখানেই তো কৃশানু দে থাকতেন।''

publive-image
বন্ধু সুদীপ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কৃশানু দে (সংগৃহীত, সোহম দে)

ভারতের মারাদোনা বলে ডাকা হত কৃশানুকে। সবুজ ঘাসের প্রেমিক হয়ে নাড়িয়ে দিয়েছেন একটা গোটা ফুটবল প্রজন্মকে। বাঙালি স্মৃতিতে তিন দশক পরেও অমলিন সেই ড্রিবল, ঠিকানা লেখা পাস। যাঁকে কুর্নিশ জানিয়েছে নিউ ইয়র্ক টাইমস, কিংবা ইউরোপ থেকে এসেছে সসম্মানে খেলার প্রস্তাব। তাঁকে স্বীকৃতি প্রদর্শনে এখনও কার্পণ্য কেন?

আহত গলায় পনি বলে দিচ্ছেন, "এখন তো দু-এক বছর খেলার পরেই ফুটবলাররা অর্জুন পেয়ে যান। আসলে এটা অর্জুনের দুর্ভাগ্য যে কৃশানুর কাছে যেতে পারল না। এটা নিয়ে আক্ষেপ, খারাপলাগা তো থাকবেই। তবে রাজ্য সরকার আমাদের অনেক সম্মান জানিয়েছেন। ২০১৩-য় সম্মান দিয়েছে রাজ্য সরকার। স্ট্যাচু, উদ্যান তো বটেই এমনকি রাস্তার নামকরণ করেছে রাজ্য সরকার।"

publive-image
মাঠে বল পায়ে বিস্ফোরণ (সংগৃহীত, সোহম দে)

কৃশানু দের নশ্বর দেহ বিলীন হয়ে গিয়েছে ঠিকই কিন্তু কে ভুলতে পারে পিএসভি আইন্ডহোভেনের মতো দলের বিদেশি ফুটবলারদের এক ঝটকায় মাটিতে শুইয়ে দেওয়ার ছবি। খেলার শেষে ববি রবসন প্রশংসা করে বলেছিলেন, ''নাম্বার এইটের খেলা ভাল লেগেছে।'' এমন প্রশংসা তো পুরস্কারের থেকেও দুর্মূল্য। পনি বলছিলেন, ''পুরস্কার না পেলেও এখনও যে অগণিত মানুষ ঈশ্বরতুল্য মনে করেন ওঁকে, সেটাও কি কম পাওনা! এই তো সেদিন সোহম এক বিয়ে বাড়িতে আমন্ত্রিত ছিল। সেখানে দুজন সোহমকে স্পর্শ করে। সোহমকে ছুঁয়েই কৃশানু-স্পর্শের জন্য যে এই আকুলতা, সেটাও তো অনেক পাওয়া।"

কৃশানু অকালে চলে যাওয়ার পরে সংসারের নাবিক হতে হয় পনিকে। একরত্তি পুত্রকে নিয়ে সংসারের জোয়াল টানতে হিমশিম খাচ্ছিলেন এক সময়ে। চাকরি সামলে পুত্রের ফুটবল অনুশীলন, পড়াশুনা, তাকে দেখভাল করা- বেশ সমস্যায় পড়েছিলেন। পুত্র সোহম এখন বড় হয়েছেন। বেছে নিয়েছেন সাংবাদিকতা।

publive-image
তখন ফুটবল ট্রান্সফারে ছিল টোকেন সিস্টেম (সংগৃহীত, সোহম দে)

কৃশানু দে বেঁচে থাকলে আজ ৬০-এ পা দিতেন। কর্মজীবন থেকে অবসর নিতেন এই বছরেই। ১৯৬২-তে জন্ম। ফোনের ওপার থেকে রীতিমত অঙ্ক কষে বলে চলেছিলেন পনি। হয়ত রিটায়ারমেন্টের পার্টি জমকালো হত। সেখানে আমন্ত্রিত থাকতেন ফুটবল জগতের হুজ হু-রা! হয়তো আরও অনেক কিছুই হতো। তা তো আর দেখা হল না। রাজপুত্র যে আগেই চলে গেলেন। ফুটবলপিপাসুদের কানে বাজে, কৃশানুর শট ঝড়া পাতার মতো এঁকেবেঁকে গোলে ঢুকে গেল।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

Eastbengal Mohunbagan East Bengal indian football team Indian Football ATK Mohun Bagan AIFF East Bangal atk-mohun-bagan East Bengal Club
Advertisment