বেহালা থেকে প্রতিদিন সকাল সাতটার মধ্যে ময়দানে চলে আসেন তিনি। ক্যালকাটা রেফারি অ্যাসোসিয়েশনের মাঠে গেলেই দেখতে পাওয়া যাবে বছর ছাপ্পান্নর এই ‘যুবতী’কে। সেখানেই ফুটবল খেলেন তিনি। পাশাপাশি শরীরচর্চাওও করেন নিয়মিত। আর এখান থেকেই চলে যান অফিসে। এটাই রোজনামচা কুন্তলা ঘোষ দস্তিদারের। ভারতীয় ফুটবলে তাঁর আলাদা একটা জায়গা আছে। বিরল কৃতিত্বের অধিকারী কুন্তলা। ভারতীয় ফুটবলের কোনও পুরুষ যা করে দেখাতে পারেননি তা করে দেখিয়েছেন তিনি। ১৯৮২ সালে মেয়েদের ফুটবল বিশ্বকাপে ক্যাপ্টেন’স আর্মব্যান্ড উঠেছিল তাঁর হাতে। সেবার ১২ নম্বরে শেষ করেছিল কুন্তলার টিম ইন্ডিয়া।
১১ বছর বয়স থেকে কুন্তলার পায়ে ফুটবল। খেলা ছাড়া কিছুই বোঝেন না ফ্রান্স (১৯৯৮) ও জার্মানি (২০০৬) বিশ্বকাপ দেখে আসা কুন্তলা। বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গা পুজো যার কাছে ফুটবলের পরে। সেই বলতে পারেন, “আগে মাঠ পরে অঞ্জলি। মাঠ আমার ব্রেড অ্যান্ড বাটার। আমাকে সব দিয়েছে। তাকে বাদ দিয়ে কোনও কিছু নয়।” কুন্তলাকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়েই আজ এই রাজ্য তথা বাংলার মেয়েরা ফুটবলে ঝুঁকেছে। আর কুন্তলা নিজেকে সঁপে দিয়েছেন ফুটবলের উন্নয়নে। মা দুর্গার মতোই দশ হাতে সামলান ফুটবলের একাধিক সেক্টর। এই মুহূর্তে পূর্ব রেলওয়েতে কর্মরত তিনি। ভারতীয় রেলের হেড কোচ তিনি। সর্ব ভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের ডি লাইসেন্সধারী প্রশিক্ষকও তিনি। তৈরি করছেন আগামীর কোচেদের। ইংলিশ প্রিমিয়র লিগের অধীন প্রিমিয়র স্কিলস ফুটবলেও যুক্ত কুন্তলা।
আরও পড়ুন: আমার দুর্গা: দ্য উইনার্স
মা দুর্গা, দশভূজা, রক্তমাংসের প্রতিমা। এই শব্দগুলোকে এক সুতোয় বেঁধে দিয়েছেন তিনি। কোনও রাখঢাক না-করেই বলছেন, “মা দুর্গা হতে গেলে ডেডিকেশন লাগে। আমরা অসম্ভব অসৎ আর ফাঁকিবাজ হয়ে গেছি। পয়সা আর গ্ল্যামার আমাদের মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছে। অন্তর থেকে কাজ করতেই ভুলে গেছি। এসব করলে আর মা দুগ্গা হওয়া যায় না।” বাংলার মেয়েরাই সাক্ষাৎ দুর্গার রূপ। একথা তিনি মানেন। কিন্তু বলছেন এই দুর্গাদের আর কে আগলাচ্ছে! কুন্তলার সংযোজন, “আগে আমরা মুষ্টিমেয় কয়েকজন মেয়ে ফুটবল খেলতাম। এখন প্রচুর মেয়ে ফুটবল খেলে। কিন্তু আমাদের পরিকাঠামোই নেই। দু’মুঠো খাবার দিতে পারি না। পুষ্টি না-পেলে কী করে চলবে!”
শ্লীলতাহানি ও ধর্ষণের মতো অপরাধ ক্রমেই বেড়ে চলেছে সমাজে। কুন্তলা মনে করছেন, এসবই ইউরোপিয় সংস্কৃতি মনস্ক হয়ে ওঠার কুফল। দেশের সংস্কৃতি ও শিকড় থেকে সরে যাওয়ার প্রভাব পড়ছে সমাজে। কুন্তলা এ প্রসঙ্গে বললেন,”ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে হাঁটার সময় নিরাপদ বোধ করি না। মেয়েরা সর্বত্র নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। কিন্তু এবার সময় এসেছে, মেয়েরা নিজেদের দুর্গা রূপটা দেখাক। সেটা সব অর্থে। ন্য়ায়-অন্যায়ের ফারাকটা বুঝিয়ে দিক তাঁরা। প্রতিবাদের ভাষাটা ভুলে গেল চলবে না।” কথা বলার ফাঁকেই তাঁর ভিতরের মা দুর্গার রূপটা বেরিয়ে আসে। তিনি বলেন, “আজও ভাবতে গর্ব বোধ হয়, এশিয়ান অলস্টার টিমে তিনজন বাঙালি মেয়ে। আমি, শান্তি মল্লিক আর শুক্লা দত্ত। ক’জন পুরুষ ফুটবলার আছে সেখানে! হাতে গোনা।”