স্মৃতি ঝাপসা হয়ে গিয়েছে। অতীতের সমস্ত সোনাঝরা মুহূর্তরা এখন কেবল যেন প্রহেলিকা। অশক্ত কাঁপা কাঁপা হাত মাঝেমাঝে অবশ হয়ে আসে। ক্ষণিকের জন্য হয়ত বা ফিরে আসে স্মৃতি।
ময়দানের সবুজ গালিচার একসময়ের বাদশা মহম্মদ হাবিবের কাছে এখন অনন্ত প্রতীক্ষা। মিথ হয়ে হরিণ গতির সেই দৌড়, ড্রিবলিং, ডজ আজ ফেলে আসা সুখ স্বপ্নের মত। বার্ধক্যের থাবায় শয্যাশায়ী বড়ে মিঞা আসলে এখনও জানেন না তাঁর প্রাণাধিক সুভাষ ভৌমিক আর নেই!
আরও পড়ুন: ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে বড়ে মিঞা-র স্মৃতি! বেনজির সাহায্য নিয়ে হাত বাড়াল ইস্টবেঙ্গল
ইস্ট-মোহন থেকে বাংলার হয়ে সন্তোষ ট্রফি, দেশের জার্সিতে সতীর্থ-প্রতিপক্ষ হিসাবে অজস্র মণিমুক্তো ছড়িয়ে দিয়েছেন হাবিব-সুভাষ। কখনও সতীর্থ হিসাবে একে অন্যের পাস থেকে গোল করেছেন। কখনও আবার মাঠের রক্তক্ষয়ী প্রতিদ্বন্দ্বিতা শেষে আলিঙ্গনের চাদরে মুড়ে ফেলেছেন দুজনে। সেই বন্ধুত্বের রোম্যান্সে ছেদ পড়েছে শনিবার। বন্ধুর অজান্তেই ভোম্বল পাড়ি দিয়েছেন অনন্তলোকে।
হাবিবের স্ত্রী হায়দরাবাদ থেকে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-কে বলছিলেন, "উনি ভীষণ অসুস্থ। চিকিৎসায় পার্কিনসন্স, আলঝাইমার্স- দুই-ই ধরা পড়েছে। কাউকেই চিনতে পারেন না। স্রেফ আমাকে ছাড়া।"
আরও পড়ুন: বস, তুমি আজীবন আমার হৃদয়েই থাকবে!
আর ফুটবল? মুছতে থাকা স্মৃতির কোষে অবশ্য এখনও অটুট আজন্ম ফুটবল প্রেম। এখনও ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের নাম শুনলে চোখ চিকচিক করে। হয়ত বা মনের গহীনে হানা দেয় বসন্তমাখা সেই সব দুর্লঙ্ঘ সময়। পিছলে যায় সময়, সময়ের ট্র্যাপিজে। শুধু প্রিয়-সান্নিধ্য মাখা মুখগুলোই যা ঝাপসা হয়ে যায়!
শেষ ভরসার জিব্রাল্টার হয়ে আঁকড়ে রাখা স্ত্রী উজাড় করে বলছিলেন, "ভাবতেই পারছি না সুভাষদা নেই। আমরা কেউই জানিনা। এমন দুঃখের খবর হয়ত ওঁকে শারীরিক কারণেই জানানো সম্ভব হবে না।" এরপরেই হতাশামাখা গলায় বলে চলেন, "ওঁকে নাম বললে হয়ত চিনতেই পারবে না! হয়ত বুঝবে কেউ প্রিয় চলে গেল। এতে আরও দুঃখ পাবে। এর থেকে না বলাই ভালো।"
আরও পড়ুন: ৭৫-এর মহাকাব্য থেকে খসল আবেগের পাতা! বন্ধুর বিদায়ে শোকস্তব্ধ সেই ম্যাচের সৈনিকরা
সুভাষ-বিদায়ের বিষাদ যেন পৌঁছে যায় কলকাতা থেকে হায়দরাবাদ। হাবিব-পত্নীর গলায় যেন ঝরে পড়া শিউলির সুবাস, "ভৌমিকের সঙ্গে কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে আমাদের। খুব খারাপ লাগছে। উনি আমাকে বন্ধু হাবিবের মতই সম্মান দিতেন, শ্রদ্ধা জানাতেন। হাসি মুখে ভৌমিকের বউদি ডাক মনে রয়ে যাবে। ওঁর স্ত্রী-ও আমাকে পছন্দ করতেন।"
কত অনর্গল স্মৃতিচারণ। দূরত্ব মুছে কত অনায়াস ফেলে আসা দিনের উত্তাপ নেওয়া ! গল্পেই যেন রাত কাটিয়ে দেওয়ার আহ্বান। কলকাতায় কয়েক বছর আগেও এসেছেন ইস্টবেঙ্গলের শতবর্ষ উদযাপনে। যেখানে হাবিবের প্রিয় ভোম্বল-কে দেখা গিয়েছিল সযত্নে অসুস্থ বন্ধুকে আগলে রাখতে।
আরও পড়ুন: না ফেরার দেশে সুভাষ! ময়দানি ফুটবলের এক যুগের অবসান
হাবিবের বুক পকেটে ফোন। রিং হলেই হাবিবকে বিচলিত হতে না দিয়ে সুভাষ নিজে ফোন এটেন্ড করছেন। ইস্টবেঙ্গলের শতবর্ষের সেই মায়াময় ফ্রেম দ্রুত ছায়া হয়ে যাবে, দুই বন্ধুর সেটাই শেষবারের সাক্ষাৎ হবে, কে ভেবেছিল! ৭০-এ এশিয়ান গেমসের সেই অমর জুড়ির যে এমন মর্মান্তিক অপমৃত্যু হবে, কে আঁচ করতে পেরেছিল!
চোখ ভিজে যায় হাবিবের স্ত্রী-র। বলছিলেন, "বাচ্চাদের পায়ে ফুটবল দেখলে স্বর্গীয় সুখ পান। কয়েক বছর আগে মোহনবাগানের এক অনুষ্ঠানে শিশুদের পায়ে বল দেখে যে কি খুশি হয়েছিলেন। এখন অবশ্য কাউকেই চিনতে পারেন না। তবে শ্রীমানিদা ফোন করেন নিয়মিত। গতকালও ফোন করে খোঁজখবর নিয়েছেন।"
শুধু সুভাষের গলাই যে ফোনের ওপার থেকে আর যে কোনওদিন আসবে না হায়দরাবাদের বাড়িতে, সেটা কে জানাবেন মিঞা-কে?
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন