বন্য দর্শক। উত্তেজিত ময়দান। সেখানেই দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন ৭ জন করে দুই দলের ১৪ জন ফুটবলার। রয়েছেন কয়েকজন কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবলাররাও, গোল করলেই সাইডলাইনের ধারে এসে যাঁরা টাকা সংগ্রহ করে বুটের মধ্যে মোজা খুলে ভরে রাখছেন।
এমন দৃশ্য কলকাতা ছাড়িয়ে গ্রাম-মফঃস্বলের চিরচেনা পরিচিত দৃশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভাড়া করা দেশি-বিদেশি ফুটবলারে বোঝাই করে দল নামিয়ে দেওয়া। কখনও সেভেন-আ-সাইড কখনও আবার নিয়ম মেনে এগারো জনের দল নামিয়ে দেওয়া- খেপ ফুটবলের সাম্রাজ্য দশকের পর দশকের অম্লান। ভারতীয় ফুটবলে আইএসএলের মত বৈপ্লবিক যুগসন্ধিক্ষণ ঘটে গিয়েছে। বিশ্বের নামি-দামি তারকাদের নিয়ে জৌলুসে ইন্ডিয়ান সুপার লিগ ফুটবল মানচিত্রে কৌলিন হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। তবে আইএসএলের জমানাতেও খেপ ফুটবলের রমরমা আগের মতই অটুট। গ্রামে-গঞ্জে খেপ ফুটবলের জনপ্রিয়তা এক বিন্দুও ম্লান হয়নি।
আরও পড়ুন: আগামী মরশুমে কে হচ্ছেন সবুজ মেরুন কোচ! বাগান শিবিরের বড় ঘোষণা লক্ষ্মীবারে
ফুটবলে নাকি টাকার অভাব! ফুৎকারে উড়িয়ে দিচ্ছেন খেপ ফুটবলের বিষয়ে নখদর্পণে থাকা এক ময়দানের ক্লাব কর্তা। তিনি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-কে বলছিলেন, "খেপ ফুটবলই আসল টাকার খনি। কলকাতা ফুটবল লিগ এবং শিল্ড বাদ দিলে বছরের বাকি ১০ মাস কার্যত বাড়িতে বসে কাটে ফুটবলারদের। আর্থিক সংস্থান ঘোচায় এই খেপ ফুটবল-ই।"
কীরকম? হিসাব মেলালে চক্ষু ছানাবড়া হয়ে যাওয়ার জোগাড়। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, খেপ খেলে লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জন করতে পারেন একজন ফুটবলার। তবে সবকিছু নির্ভর করছে সংশ্লিষ্ট ফুটবলারের পারফরম্যান্সের ওপর। কলকাতা লিগে খেললে তো সোনায় সোহাগা! সেক্ষেত্রে ফুটবলারদের 'রেট' সেনসেক্সের মত চড়চড় করে বাড়ে। ম্যাচ পিছু পাঁচ থেকে ত্রিশ এমনকি চল্লিশ হাজার পর্যন্ত পৌঁছে যায় ফুটবলারের দাম। দেশি হোক বা বিদেশি- গোল করার সংখ্যার সঙ্গে সমানুপাতিক হারে বাড়ে 'ইনসেন্টিভ'ও। যা খেলার বেতনের সঙ্গে পৃথকভাবে ফুটবলারদের 'উপহার' হিসাবে দেওয়া হয়।
কিন্তু কীভাবে আসে এত অর্থ? গ্রামে-গঞ্জে একাধিক এমন ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত থাকা এক ব্যক্তি বলছিলেন, "পাড়ার বাহুবলী, প্রোমোটার, প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এই সমস্ত খেপ টুর্নামেন্টে লক্ষ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করেন। প্রায় সমস্ত দলেরই পৃষ্ঠপোষকতা করেন এমন ব্যক্তিরা। যে টুর্নামেন্টে প্রাইজ মানি বেশি, সেই টুর্নামেন্টেই লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে দল নামিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়ে অল্প পরিশ্রমে হাজার হাজার টাকা উপার্জনের সহজ সিঁড়ি হয়ে দাঁড়িয়েছে এই খেপ টুর্নামেন্ট।" ময়দানি ফুটবলে বাহুবলি এই চক্রের পোশাকি নাম পের্কার্স। এই পেকার্সরাই নিয়ন্ত্রণ করেন গোটা এই খেপ দুনিয়া।
খেপ সাম্রাজ্য এখনও অমলিন (ছবি: ফেসবুক)
যে সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি বাংলা তো বটেই ভিন রাজ্যের কেরালা কিংবা পড়শি বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে স্বমহিমায়। কেরালায় তো এই টুর্নামেন্ট 'সেভেন্স' নামে আলাদা পরিচিতি পেয়ে গিয়েছে। খেপের দাপটে ময়দানের অনেক ছোট ক্লাবেই অলিখিত নিয়ম চালু- সোম থেকে শুক্র- ক্লাবের সঙ্গে অনুশীলন, শনিবার, রবিবার খেপের ময়দানে খেলার জন্য ছুটি! এপার বাংলা থেকে ওপার বাংলাতেও সীমান্ত পেরিয়ে অবৈধভাবে খেপ খেলতে যাওয়ার ঘটনা আকছার ঘটে। কয়েকমাস আগেই এভাবে বাংলাদেশে খেপ খেলতে যাওয়ার পথে বিএসএফ-এর হাতে ধরা পড়েছিলেন দুই ফুটবলার।
আইএফএ সচিব জয়দীপ মুখোপাধ্যায় ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে অসহায় গলায় বলছিলেন, "খেপ ফুটবল টুর্নামেন্টের উপর স্থানীয় ফুটবলারদের রুটি-রুজির বিষয়টি জড়িয়ে। নিয়ম মেনে সমস্ত টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হোক, এটা আইএফএ সবসময় চায়। তবে সীমিত পরিকাঠামো নিয়ে গ্রামে-গঞ্জে কোথায় কী হচ্ছে, তা নজরদারি করা সম্ভব নয়। বহু প্রাক্তন ফুটবলার এমন টুর্নামেন্টে আমন্ত্রিত থাকেন। তাঁদেরকেও উদ্যোগ নিয়ে আয়োজকদের বোঝাতে হবে ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজনের জন্য কিছু শর্তাবলী মেনে চলা প্রয়োজন। আইএফএ-র অনুমতি পাওয়ার জন্য নামমাত্র খরচে মাত্র ১০০০ টাকায় এমন টুর্নামেন্ট আয়োজন করা যেতে পারে। এই বিষয়ে সকলকেই উদ্যোগ নিতে হবে।"
খেপ ফুটবলের রমরমা দুই বাংলা-তেই। (ছবি ফেসবুক)
মারকাটারি উত্তেজনা। আর প্রতিটি দলেরই লক্ষ লক্ষ টাকা বাজেট। স্বাভাবিকভাবেই দেদার বেটিং চক্রের রমরমাও দেখা যায় টুর্নামেন্ট চলাকালীন। পুলিশ থেকে প্রশাসনের নাকের ডগায় চলে এই খেপ। লক্ষ লক্ষ টাকা উড়লেও ব্রাত্যই থেকে যায় ফুটবলারের নিরাপত্তার বিষয়টি।
সম্প্রতি কৃষ্ণনগরের এমনই এক টুর্নামেন্ট চলাকালীন ধকল সইতে না পেরে মাঠেই মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েছিলেন রেলওয়ে এফসির ফুটবলার দেবজ্যোতি ঘোষ। বডি কন্ট্যাক্ট গেম হওয়া সত্ত্বেও এম্বুলেন্স তো বটেই কোনও পৃথক গাড়ির বন্দোবস্ত থাকে না এসব টুর্নামেন্টে। দেবজ্যোতির মৃত্যু আয়োজকদের সেই গাফিলতিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।
খেপের ময়দানে বলি দেবজ্যোতির মত উঠতি প্রতিভার (ছবি- ফেসবুক)
ময়দানি ফুটবলের পরিচিত মুখ ইউনাইটেড স্পোর্টসের কর্তা নবাব ভট্টাচার্য বলছিলেন, "ফুটবল পরিশ্রমের খেলা। অগুনতি ম্যাচ খেলা, টাকার জন্যে খেলা, পরিবারের অভাবের জন্যে খেলা, সতেরো বছর বয়সে বিয়ে করে নিয়ে সংসারের জন্যে খেলা, অবিবাহিত বোনটা-র বিয়ের ব্যবস্থা করবার জন্য খেলা, খেলার নেশায় খেলা, আবার খেপের মাসিদের ধরিয়ে দেওয়া নেশার জন্যে খেলা। খেলার পিছনে প্রচুর কারণ রয়েছে। নিয়মিত অনুশীলনের ব্যাপার নেই, নিয়মিত শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনযাপনের ব্যাপার নেই, নিয়মিত জিম করবার ব্যাপার নেই। গ্রামে গ্রামে, যে সব টুর্নামেন্ট হয়, সেগুলো রেজিস্টার্ড টুর্নামেন্ট নয়, সুতরাং মেডিক্যাল ব্যবস্থা অপ্রতুল থাকবে সেটা নিয়ে আর সন্দেহ কি!"
আরও পড়ুন: CSK-র নেতৃত্ব ছাড়লেন ধোনি, নয়া ক্যাপ্টেন বেছে নিলেন নিজেই
ওডাফা, চিডি থেকে হালের প্লাজা, ক্রোমা- খেপ খেলেই কেরিয়ার শুরু। তারপরে ময়দানে তারকা খ্যাতি। দেশিদের ক্ষেত্রেও একই বিষয়। ময়দানে পরিচিত খুব কম ফুটবলারই রয়েছেন, যাঁরা খেপের মাঠে নাম লেখাননি। সেই খেপ স্বমহিমায় বিরাজমান। অন্তত গ্রাম-বাংলার ফুটবল তাই বলছে।