বব নিক্সন। এই নামটি প্রায় কোনও ভারতীয়ের কাছেই পরিচিত নয়। কিন্তু আজকের দিনটিতে তাঁকে অন্তত একবার স্মরণ করা সকলেরই উচিত। তানজানিয়ার নাগরিক নিক্সন ছিলেন দাঁতের ডাক্তার, অবসর সময় লীগ ক্রিকেটার ও মঞ্চাভিনেতা। এবং নিয়তির খেয়ালে একটি ক্রিকেটীয় রূপকথার একমাত্র ধারাভাষ্যকার হয়ে রয়ে গিয়েছেন তিনি। এমন এক অবিশ্বাস্য একদিনের ইনিংস, যা চাক্ষুষ করতে পেরেছিলেন স্রেফ কয়েকশো দর্শক।
ইংল্যান্ডের টানব্রিজ ওয়েলস স্টেডিয়ামের নেভিল গ্রাউন্ডে ১৮ জুন, ১৯৮৩ সালে ১৩৮ বলে ১৭৫ রানের একটি অপরাজিত ঘূর্ণিঝড়ের মতো ইনিংস খেলেন ভারতের অধিনায়ক কপিল দেব। কিন্তু বিবিসি-র কর্মীরা সেদিন ধর্মঘট করাতে টেলিভিশনে দেখানো হয় নি বিশ্বকাপের সেই ম্যাচ। আজ পর্যন্ত যে আফসোস ঘোচে নি ভারতের ক্রিকেট অনুরাগীদের। মোবাইল, ভিডিও ক্যামেরা বর্জিত জমানায় ম্যাচ রেকর্ড করা সম্ভব হয়ে ওঠে নি কারোর পক্ষেই।
রূপকথার ইনিংস
এই ম্যাচ থেকে উঠে আসা দুটি সংখ্যা চিরকাল মনে থাকবে: ১৭/৫ (যশপাল শর্মা আউট হওয়ার পর ভারতের স্কোর), এবং ১৭৫* (কপিলের একার স্কোর, যা তৎকালীন বিশ্বরেকর্ড ছিল)। টুর্নামেন্টে তখন পর্যন্ত চারটি ম্যাচ খেলে ভারতের স্কোর ২-২। কিন্তু বিশ্বকাপে নবাগত টিম জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে খেলতে নেমেই সব হিসেব গড়বড়।
ভারতীয় উইকেটের পতন
০/১: সুনীল গাওস্কর
৬/২: কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্ত
৬/৩: মোহিন্দর অমরনাথ
৯/৪: সন্দীপ পাটিল
১৭/৫: যশপাল শর্মা
৭৭/৬: রজার বিনি
৭৮/৭: রবি শাস্ত্রী
১৪০/৮: মদন লাল
২৬৬/৮: ইনিংস শেষ (কপিল দেব ১৭৫*, সৈয়দ কিরমানি ২৪*)
নয় রানে চার উইকেট পড়ে যাওয়ার পর মাঠে নামেন কপিল। তার অল্পক্ষণ পরেই যশপাল আউট হয়ে যাওয়ায় নামেন রজার বিনি। অবশেষে শুরু হয় ইনিংস পুনর্নির্মাণের খেলা। ষষ্ঠ উইকেটে ৬০ রান যোগ করেন কপিল এবং বিনি। তারপর ফের ঝটাপট দুটি উইকেট পড়ে, এবং ফের একবার মদন লালের সঙ্গে একটি ছোট্ট পার্টনারশিপ গড়ে ওঠে। তবে নয় নম্বরে যখন নামছেন উইকেটকিপার সৈয়দ কিরমানি, তখনও কেউ ঘুণাক্ষরেও জানে না, কী ঝড় আসতে চলেছে।
???? Runs: 175* (138)
???? Fours: 16
???? Sixes: 6#OnThisDay against Zimbabwe in 1983, Kapil Dev smashed the first century in ODIs for ???????? in the men's @cricketworldcup ???? pic.twitter.com/2r2Mu7l26j— ICC (@ICC) June 18, 2020
ইনিংসের শেষভাগে আক্ষরিক অর্থেই উন্মত্তের মতো ব্যাট করেন কপিল। এই পর্বের ৮০ শতাংশ রান আসে তাঁর ব্যাট থেকে। অবশ্য উল্টোদিকে বীরবিক্রমে নিজের দুর্গ রক্ষা করে যান কিরমানি। ১৭৫ রানের ইনিংসে ছিল ১৬টি চার এবং ছ'টি ছক্কা। শুধু যে একা হাতে দলের স্কোরকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যান তাই নয়, সেই বিশ্বকাপে ভারতকে টিকিয়েও রাখেন কপিল। তার পরের ইতিহাস তো সকলেরই জানা। ফাইনালে ভিভ রিচার্ডসের ক্যাচ নিয়ে খেলার মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া, এবং অবশেষে লর্ডস-এর ব্যালকনিতে বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে নেওয়ার সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত।
ধূলিসাৎ যত রেকর্ড
# নিক্সন তাঁর ধারাভাষ্যে যেমন বলেছিলেন, তখন পর্যন্ত বিশ্ব ক্রিকেটে একটি একদিনের ইনিংসে অত রান কেউ করেন নি। পরের বছর ১৮৯ করে কপিলের রেকর্ড ভাঙেন খোদ ভিভ রিচার্ডস। সে ছিল আরও এক স্বপ্নের ইনিংস
# ব্যাটিং অর্ডারে ছয় নম্বর বা তার নীচে ব্যাট করে সেঞ্চুরির এটি ছিল স্রেফ দ্বিতীয় নিদর্শন। এবং আজ পর্যন্ত একদিনের ক্রিকেটে ছয় নম্বর বা তার নীচে ব্যাট করে কেউ এত রান করতে পারেন নি
# বিশ্বকাপের ইতিহাসে ছয় নম্বরে ব্যাট করে ১৫০-র বেশি রান করার আর কোনও নজির আজ পর্যন্ত নেই
# কিরমানির সঙ্গে ১২৬ রানের অপরাজিত পার্টনারশিপও গড়ে দেয় বিশ্বকাপের আরও একটি রেকর্ড - নবম উইকেটে ১০০-র বেশি রানের পার্টনারশিপ দেখে নি কোনও বিশ্বকাপ। এবং একদিনের ক্রিকেটেও নবম উইকেটে সর্বোচ্চ পার্টনারশিপের তালিকায় এটির স্থান দ্বিতীয়
সুনীল গাওস্কর পরে বলেছিলেন, "এর চেয়ে ভালো ওডিআই সেঞ্চুরি আমি দেখি নি। কপিলের মধ্যে সাংঘাতিক একটা পজিটিভ ব্যাপার ছিল, মনে হতো, কিছুই অসম্ভব নয়। ওই ইনিংসটা শুধু যে সেদিনের ম্যাচ ঘুরিয়ে দিয়েছিল তাই নয়, বদলে দিয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেটের গোটা ধারাটাই।" একটি মজার ভিডিওতে গাওস্কর এও শুনিয়েছেন, কীভাবে ইনিংসের পরে বিরতির সময় কপিলের চোখ এড়িয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছিলেন তাঁর সতীর্থরা।
আসন্ন হিন্দি ছবি '১৯৮৩'-র লঞ্চে উপস্থিত রজার বিনি বলেন, "কফি খাওয়াও শেষ হয় নি আমাদের, ১৭ রানে পাঁচ উইকেট পড়ে গেল। আমি যখন নামলাম, তখন মাথায় কিছু নেই আর। কপিল পিচের মাঝখানে এসে বলে গেল, 'অনেক ওভার আছে হাতে (সেসময় ৫০ নয়, ৬০ ওভারের খেলা হতো), সময় নিয়ে খেলি। কয়েকটা বল দেখে নিই, এক রান করে নাও, বাউন্ডারি মারতে যেও না।' তারপর আমরা দুজন ৭৭ পর্যন্ত নিয়ে যাই স্কোর, এবং আমি আউট হয়ে যাই।"
ছাদ ভাঙা ছক্কা!
গত বছর বিশ্বকাপের সময় কপিলের ইনিংসের আরও একটি দিক প্রকাশ্যে আনেন ষাটোর্ধ এক বৃদ্ধ, যিনি স্টেডিয়ামের কাছেই থাকেন। সংবাদ সংস্থা পিটিআই-কে তিনি জানান, "আমাদের বাড়ির ছাদে এসে পড়ে একটি বল। ওই ছোকরা কপিল দেবের গায়ে ভালো জোর ছিল তো। বাড়ির মালিক যখন বাড়িটা আমাদের কাছে বেচে দিচ্ছেন (১৯৮৩-র পরে), তিনি আমাদের বিশেষভাবে জানান যে কপিলের মারা একটি ছক্কা সোজা তাঁর বাড়ির ছাদে এসে পড়েছিল। খুব গর্ব করে বলেছিলেন একথা।"
এখানে এমন একজনের বক্তব্য দেওয়া জরুরি, যিনি সেদিনের ম্যাচের সম্ভবত শ্রেষ্ঠ আসনটিতে বসে ছিলেন - জিম্বাবোয়ের উইকেটকিপার এবং পরবর্তীতে অধিনায়ক, ডেভ হটন। বিবিসি-তে প্রচারিত 'স্টাম্পড' সিরিজে তিনি বলেছেন, "৪০ ওভারের পর লাঞ্চের বিরতি হয়। তখন ভারতের স্কোর ৯০-১০০, সাত উইকেট পড়ে গেছে। ম্যাচের কন্ট্রোল আমাদের হাতে। কিন্তু কপিল এরপর স্রেফ গিয়ার চেঞ্জ করে ফেলল। মনে আছে, ব্যাট বদলে একটু বড় একটা ব্যাট নিলো, এবং তারপর শটের পর শট। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, একটা শটও বেফাঁস মারে নি। চারগুলো যাচ্ছিল বুলেটের মতো, আর ছক্কাগুলো মিসাইলের মতো। এমনও নয় যে আমরা ওর ক্যাচ ফেলি বা কান ঘেঁষে বেঁচে যায়। চান্সই দেয় নি কোনও।
"আজও হতাশ লাগে যে ম্যাচটা ওভাবে হাতছাড়া হয়ে যায়। কিন্তু অমন ইনিংস দেখা সৌভাগ্যের ব্যাপার। আর মাঠের সবচেয়ে ভালো আসনে ছিলাম আমি। যতই আমাদের মেরে ক্ষতবিক্ষত করে দিক কপিল, ইনিংসটা দেখার মতো ছিল।"
অবশেষে রইল সেদিনের নায়কের নিজের জবানি, যা নেওয়া হয়েছে '1983: India’s World Cup' শীর্ষক তথ্যচিত্র থেকে, "প্রত্যেক ক্রিকেটারের কেরিয়ারে এমন এক একটা দিন আসে, যখন মাঠে নেমে মনে হয়... আজ আমার দিন, ঈশ্বর নিজের হাতে তৈরি করে আমাকে দিয়েছেন। যাই করে নিই, ভুল হবে না। হয়তো সেদিনের ইনিংসটা আমার জন্য এরকমই ছিল।"
" width="640" height="360" frameborder="0" allowfullscreen="allowfullscreen" data-mce-fragment="1">
গাওস্কর একবার দুঃখ করে বলেছিলেন, ওই ইনিংসটার রেকর্ডিং থাকলে ভালো হতো। কিন্তু হয়তো তা না হয়ে ভালোই হয়েছে। রূপকথার ছোঁয়া মলিন হবে না কোনোদিন। যতদিন ক্রিকেট খেলা হবে, ততদিন আলোচনার বিষয় হয়ে থাকবে ওই ইনিংস।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন