Ramesh Yadav para cricketer from Bengal: আচার্য দ্রোণকে গুরুদক্ষিণা দিতে গিয়ে ডান হাতের বুড়ো আঙুল কেটে দিয়েছিলেন একলব্য। সেদিন নিজের ডান হাতের বুড়ো আঙুল হারিয়েও ভেঙে পড়েননি। হারিয়ে যেতে দেননি স্বপ্নকে। আবার নতুন করে অনুশীলন শুরু করেছিলেন… বাঁ হাত দিয়ে তির ছোঁড়ার, ডান হাতের বুড়ো আঙুলের বদলে তর্জনী আর মধ্যমাকে ব্যবহার করে তির ছোঁড়ার। এবং আগের মত অত ভালো তীরন্দাজ না হলেও, একলব্য যে একজন বীর যোদ্ধা হয়ে উঠেছিলেন, মহাভারতে তার বার বার উল্লেখ করা রয়েছে। প্রবল ইচ্ছাশক্তির কাছে কোনও বাধাই আর বাধা থাকে না। অদম্য জেদ আর ইচ্ছেশক্তির উপর ভর করেই যে কোনও লড়াই জেতা সম্ভব।
সেই পৌরাণিক ঘটনার-ই যেন চাক্ষুষ প্রমাণ হাওড়া সালকিয়ার রমেশ যাদব। একলব্যের মতন রমেশও নিজের লক্ষ্যে অবিচল।
২৯ বছরের এই যুবক বাংলা এবং ভারতীয় বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ক্রিকেট দলের সদস্য। তাঁর একটি পা অকেজো। তাতে কি হয়েছে! রমেশের ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্নের কাছে হার মেনেছে সমস্ত প্রতিবন্ধকতা। এক পায়ে ভর করেই জাতীয় অথবা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমস্ত খেলায় অংশগ্রহণ করছেন। বাংলার বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন দলের একজন নিয়মিত খেলোয়াড়। ভারতীয় বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন দলেরও সদস্য, শারীরিক অক্ষমতা দমিয়ে রাখতে পারেনি রমেশকে। মনের অদম্য শক্তিতে জয় করেছেন সব বাঁধা।
প্র্যাকটিস শেষে ময়দানে বসেই ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-কে রমেশ জানাচ্ছিলেন নিজের লড়াইয়ের গল্প- জন্মের ছ'মাস পরে পোলিয়োয় ডান পা পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল। ছোট থেকেই ক্রিকেটই ছিল তাঁর ধ্যান জ্ঞান। ডান পা পুরো অকেজো লাঠি উপর ভর করে হাঁটতে চলতে হয়। শক্ত কাঠের লাঠিটাই তার হাঁটার অবলম্বন। ছোট থেকেই বাড়ির আসে পাশে ক্রিকেট খেলা দেখলেই খেলার ইচ্ছে হত। কিন্তু এমন প্রতিবন্ধী ছেলেকে কে ক্রিকেট খেলায় নেবে!
আরও পড়ুন: কলকাতার বাঙালিই এবার অলিম্পিকে! বেহালার খুদে অঙ্কিতই মান রাখছে গোটা ভারতের
এ কারণে ইচ্ছে থাকলেও ছেলেবেলায় ক্রিকেট খেলতে পারতেন না সেভাবে। খেলা বলতে বাড়ির সামনে ক্যাম্বিস বলের গলি ক্রিকেট পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। এরপর ২০১৬ সালে জানতে পারেন লক্ষ্মীরতন শুক্লার ফ্রি ক্রিকেট একাডেমির কথা। ব্যাস, হাতে লাঠির ওপর ভর করে ক্রিকেট ক্যাম্পে গিয়ে হাজির। বাকিটা স্বপ্নপূরণের গল্প।
রমেশের কথায়, "আমি লক্ষ্মী রতন শুক্লার একাডেমিতে গিয়ে প্রথম লেদার বল হাতে ধরলাম। লক্ষ্মীরতন শুক্লাই আমাকে প্রথম বলেন, 'হ্যাঁ তুমি খেলতে পারবে। তোমার মধ্যে একজন খেলোয়াড়ের সমস্ত গুণ রয়েছে।' ওনার থেকেই জানতে পারলাম আমাদের মতন বিশেষ চাহিদা সম্পন্নদের নিয়ে বাংলার ক্রিকেট দল আছে। তার নাম 'ওয়েস্ট বেঙ্গল ক্রিকেট এ্যাসোসিয়েশন ফর দ্যা ডিফারেন্টলি অ্যাবলড'। ওখানেই আমার সঙ্গে আলাপ কোচ উৎপল মজুমদারের সঙ্গে। এরপর ওঁর তত্ত্বাবধানে বেঙ্গল, ন্যাশনাল, ২০১৯ সালে ইংল্যান্ডে আয়োজিত টি-২০ ওয়ার্ল্ড সিরিজ, ইন্ডিয়া এ টিম, বি টিম এখনও খেলে যাচ্ছি।"
মা বাবা আর চার ভাই বোনের সংসার। রমেশ বড়। তার কাঁধেই রয়েছে পরিবারের দায়িত্ব। সংসার চালানোর জন্যে ছোট চায়ের দোকানই ভরসা। দেশের হয়ে খেলেও অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি। ম্যাচ খেলে যতটুকু আর্থিক সাহায্যে পাওয়া যায় সেটা ছাড়া আরও কোন সাহায্যেই ভারতীয় বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন দলের খেলোয়াড়রা পায়না। চায়ের দোকান থেকে কোনও রকমে সংসার চালিয়ে খেলাধুলার খরচ বহন করতে হয় নিজেকেই।
"এমন অনেক ঘটনা রোজ ঘটে আমার সাথে যার কথা ভাবলে খুব কষ্ট হয়। আমার এখানে চা খেতে এসে বহু ব্যক্তি কিংবা অনেক সময় প্র্যাকটিস যাওয়ার সময় অনেকে আমায় দেখে উপহাসের সুরে বলেন 'এই ল্যাংড়াটা কী করে ক্রিকেট খেলবে!' আমাদের এখানে খেলোয়াড়দের সেভাবে সাপোর্ট করা হয়না। আমাদের দিকে যদি সঠিকভাবে নজর দেওয়া হত তবে আমারাও অনেক কিছু করতে পারতাম। সিএবির তরফ থেকে মাঠ, বল দেওয়া হচ্ছে। আইসিসি বা বিসিসিআইয়ের তরফে যদি নূন্যতম সাহায্য মিলত, তাহলে স্পনসরশিপ পাওয়া যেত। ভাল ক্রিকেট কিট ব্যবহার করতে পারতাম। একটা বিশেষ চাহিদা সম্পন্নদের নিয়ে যদি একটা ক্রিকেট প্রিমিয়ার লিগের আয়োজন করা যেত তবে আমার মতন আরও অনেক খেলোয়াড় উঠে আসত।"
মাঠে বসেই মনের কথাগুলো বলছিলেন রমেশ। এই দেশে এমন অনেক বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন খেলোয়াড়রা রয়েছে যারা সঠিক পরিকাঠামোর নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে পারেন না। হারিয়ে যান। কোথাও একটু সুযোগ-সুবিধা পেলে ভাল কিছু করার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন এই 'বিশেষ' ক্রিকেটাররা। এই খেলোয়াড়দের আগ্রহের কোনও কমতি নেই। ঘাটতি হল অর্থের। নিয়মিত অনুশীলনের জন্য ভালো পরিকাঠামোর।
রমেশের মতন খেলোয়াড়দের আসল সম্বল জেদ। যে জেদ ওদের স্বপ্ন দেখায় কিছু করে দেখানোর। আর পাঁচটা মানুষের মতন ওরাও সব কিছু করতে পারে। ঈশ্বর যতটুকু ছিনিয়ে নিয়েছে তার থেকে বেশী তারা প্রতিদিন লড়াই করে অর্জন করে নেয়। এক পায়ে ক্রিকেট খেলা কোনও স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে সম্ভব না হলেও সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন রমেশ যাদবের মতন খেলোয়াড়। এক পায়ে ভর করে ক্রিকেট খেলতে যে শারীরিক ও মানসিক একাগ্রতা লাগে তার সবটাই রয়েছে এই যুবকের। ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্নই রমেশের মতন খেলোয়াড়দের বাঁচিয়ে রাখে। যাঁরা প্রতিনিয়ত বিশ্বাস করেন, একদিন সব খেলোয়াড়দের সমানভাবে দেখা হবে। তখন এই প্রতিবন্ধী শব্দটাই আর কেউ কোনদিন ব্যবহার করবেন না।