দুর্জয়কে জয় করার অদম্য নেশা। আর সেই নেশার টানেই একের পর এক পাহাড়চূড়া জয়। জীবনকে তুচ্ছ করে অ্যাডভেঞ্চারের টানেই সাত আগ্নেয়গিরি জয় করে সর্বকনিষ্ঠ ভারতীয় হিসাবে গড়লেন ইতিহাস। এর আগে সাত-সাতটি আগ্নেয়গিরির জয় করে নজির গড়েছিলেন বাংলারই সত্যরূপ সিদ্ধান্ত। আর এবার সত্যরূপের দেখানো পথেই বিশ্বের সর্বোচ্চ সাত-সাতটি আগ্নেয়গিরি জয় করে সর্বকনিষ্ঠ ভারতীয় হিসাবে নিজের নাম ইতিহাসের পাতায় তুলে দিলেন আরেক বাঙালি- বছর ৩৩-এর নীলাভিষেক মুখোপাধ্যায়।
প্রবল ঠাণ্ডা, আবহাওয়ার খামখেয়ালি, প্রতি মুহূর্তেই ওঁত পেতে থাকা বিপদ, সব কিছুকে হারিয়ে এ যেন বিশ্বজয়! ছোট থেকেই পাহাড় যেন ছাতছানি দিয়ে ডাকত নীলাভিষেককে। সেই থেকেই একের পর এক পাহাড় জয় করে চলেছেন তিনি। শেষমেশ স্বপ্নের ‘মাউন্ট সিডলি’ অভিযান। অ্যাডভেঞ্চারের রোমহর্ষক কাহিনী শুনে চমকে উঠেছেন সকলেই।
নীলাভিষেক বলেন, “এখনও পর্যন্ত সারা বিশ্বে মাত্র ৩০-৩৫ জনই আছেন যাঁরা এই কঠিন চ্যালেঞ্জ জয় করতে পেরেছেন, আর সত্যরূপ সিদ্ধান্তের পর আমি দ্বিতীয় ভারতীয়, যে এই চ্যালেঞ্জ জয় করল। আমিই সর্বকনিষ্ঠ ভারতীয় হিসাবে সেভেন ভলক্যানিক সামিট জয় করলাম, এটা আমার কাছে স্বপ্নের মত। চ্যালেঞ্জ রীতিমত কঠিন সেই সঙ্গে খরচ সাপেক্ষ”।

‘অদম্য’ মানসিকতা, অ্যাডভেঞ্চারের নেশা… নতুনের সন্ধানে সর্বকনিষ্ঠ ভারতীয় হিসাবে গড়লেন বিশ্বরেকর্ড। বরাবরই ‘পাখির চোখ’ আন্টার্কটিকা! স্বপ্ন দেখতেন ‘সেভেন ভলক্যানিক সামিট জয়’, অবশেষে গত জানুয়ারিতেই এল সাফল্য। আন্টার্কটিকার ‘মাউন্ট সিডলিতে’ সফলভাবে আরোহণ করেন বছর ৩৩-এর নীলাভিষেক। সত্যরূপ সিদ্ধান্তের পর তিনিই দ্বিতীয় বাঙালি হিসাবে ‘সেভেন ভলক্যানিক সামিট’ জয় করে তৈরি করেছেন ইতিহাস। অভিযানের প্রতি পদে পদে ছিল বিপদের হাতছানি, মৃত্যুভয় উপেক্ষা করেই লক্ষ্যে সফল নীলাভিষেক। পেশায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। ২০১৭ তে প্রথম সাফল্যের সিঁড়িতে পা দেওয়া। জয় করেন মাউন্ট কিলিমাঞ্জারো।
এরপর একে একে আল্পস মাউন্টেন রেঞ্জ, মাউন্ট এলবাস, মাউন্ট গিলুয়ে, ইরানের মাউন্ট ডামাভান্ট, উত্তর আমেরিকার পিকো ডি অরিজাবা অভিযানে সফল হয়েছেন। শেষমেশ স্বপ্নের মাউন্ট সিডলি অভিযান। মাউন্ট সিডলি জয়ের খবর আসার সঙ্গে সঙ্গেই উৎসব শুরু হয় সারা ভারতের পর্বতপ্রেমী মহলে। উৎসব শুরু হয় বন্ধু ও সহকর্মীদের মধ্যে।
মাউন্ট সিডলি অভিযানের জন্য জার্মানি থেকে চিলি এরপর আন্টার্কটিকা! নিজের স্বপ্নের ‘মাউন্ট সিডলি’ অভিযান প্রসঙ্গে নীলাভিষেক বলেন, “ অ্যাডভান্স বেসক্যাম্পে পৌঁছানোর আগেই আবহাওয়া ক্রমশ খারাপ হতে শুরু করে। প্রবল ঠাণ্ডা তাপমাত্রা মাইনাস ১০ থেকে মাইনাস ৩০ ডিগ্রি’র মধ্যে। আবহাওয়ার উন্নতির জন্য কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হয়। প্রতি পদে ঝুঁকি আর অদম্য চ্যালেঞ্জ। আবহাওয়া কিছুটা ভাল হতেই চ্যাটার্ড বিমানে বেসক্যাম্প থেকে অ্যাডভান্স বেসক্যাম্পে গিয়ে পৌঁছালাম ১৮ জানুয়ারি। এর পরের দিন আবহাওয়া ভাল থাকায় সামিটে বেরিয়ে পড়ি। অবশেষে আসে সাফল্য”।
তিনি আরও বলেন, “আমার কাছে মাউন্ট সিডলি সব থেকে ঠাণ্ডা পাহাড়, সেই সঙ্গে কিছুটা অতিরিক্ত চ্যালেঞ্জ ফেস করতে হয়েছে আমাকে। তবে সব চেয়ে কঠিন অভিযান ছিল, চিলির মাউন্ট ওজোস ডেল সালাডো। আমার এই সামিটে আমার সংস্থা কিছুটা স্পনসর করেছে। বাকিটা নিজের উদ্যোগেই”। একই সঙ্গে পাইলট হওয়ারও প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন তিনি। আরও এক স্বপ্নে বিভোর এই তরুণ বাঙালি। লক্ষ্য এখন বিমান চালিয়ে উত্তর-দক্ষিণ মেরু অতিক্রম করা।

সল্টলেকের বাসিন্দা হলেও নীলাভিষেকের আদি বাড়ি পুরুলিয়ার নীলকুঠিডাঙ্গায়। সেখানেই কেটেছে শৈশবের দিনগুলি। বড় হওয়া, পর্বতারোহণে হাতেখড়ি। পড়াশোনার পাশাপাশি পর্বতারোহঁ তাঁর কাছে ছিল এক নেশার মতই। অ্যাডভেঞ্চারের টানে নতুন নতুন পাহাড় জয়ের অদম্য ইচ্ছা ও জেদ যেন জাপটে ধরে তাঁকে। সেই থেকেই একের পর এক পর্বতশৃঙ্গ জয়। পেশায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হলেও বিপদের হাতছানি, মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে পাহাড় জয়ের নেশায় বিভোর এই তরুণ বাঙালি।