শুভপম সাহা
বিশ্বকাপ উপলক্ষ্যে কাট-আউট-ব্যানার আর ফ্লেক্সেই মুখ ঢেকেছে পাড়াগুলো। উত্তর থেকে দক্ষিণ, সব জায়গায় চিত্রটা কম-বেশি একই। উত্তরের বাগবাজারের ছবিটা কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় সাম্প্রতিক ব্রাজিল বনাম আর্জেন্তিনার কাদা ছোঁড়াছুঁড়ির বিপরীত পথেই হাঁটছে। নীল-সাদা পতাকার সঙ্গেই উড়ছে হলুদ-সবুজ। নেইমার-কুটিনহোদের উল্টো দিকেই দিব্যি দাঁড়িয়ে মেসি-দিবালা। ফ্যানেদের ভালবাসায় সেখানে লেখা 'ভক্তের ভগবান'।
FIFA Football World Cup 2018: বিশ্বকাপ বন্দনায় বাগবাজার। ছবি: শশী ঘোষ।
বাগবাজার বাটা থেকে বাগবাজার লঞ্চ ঘাট আসার পথে ইতিউতি ব্রাজলি-আর্জেন্তিনার সমর্থন চোখে পড়বে ঠিকই। কিন্তু গিরীশ মঞ্চের কাছে রাস্তার দু’প্রান্তের দৃশ্য আপনার চোখ টানতে বাধ্য। নেইমার-মেসিরা যেন আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছেন। একেবারে রাশিয়ান ফ্লেভার। মনে হতেই পারে যে আর দু’পা হাঁটলে বাগবাজার সর্বজনীনের দুর্গাপুজোর মাঠ নয়, অপেক্ষা করে আছে লুঝনিকি স্টেডিয়ামই। পাড়ার ক্লাব সংহতি সংঘের সদস্যদেরই বিশ্বকাপ নিয়ে এই মাতামাতি। সারাদিনের কর্মব্যস্ততার শেষে ওই ক্লাব ঘরেই তাঁরা ঢুকে পড়েন প্রিয় দলের হয়ে গলা ফাটাতে। এখানে ব্রাজিলের জার্সিধারীর কাঁধে হাত রেখেই ম্যাচ দেখে আর্জেন্তিনার ডাইহার্ড ফ্যান।
FIFA Football World Cup: বিশ্বকাপ বন্দনায় বাগবাজার। ছবি: শশী ঘোষ।
উত্তর কলকাতার অলিতে-গলিতে চুঁইয়ে পড়ে আবেগ। শ্যামবাজার, বাগবাজার, শোভাবাজার ও আহিরীটোলা নিছকই কোনও জায়গার নাম নয়। ওখানকার দেওয়ালে কান পাতলে আজও আদি কলকাতার গল্প শোনা যায়। সিটি অফ জয়ের নস্ট্যালজিক ক্যাপিটাল বলতে শহরের উত্তর প্রান্তের কথাই মাথায় আসে সবার আগে। বায়োস্কোপ থেকে বড় পর্দা। বনেদিয়ানার উত্তর আজও যেন ইতিহাসের চলমান দলিল।
FIFA Football World Cup: বিশ্বকাপ বন্দনায় বাগবাজার। ছবি: শশী ঘোষ।
আবেগের পাসপোর্ট নেই, নীল-সাদা বা হলুদ-সবুজ জার্সি চাপিয়ে চেনা ইস্ট-মোহন সমর্থক হয়ে যান ব্রাজিলীয় বা আর্জেন্তাইন।এটাই কলকাতা। ফুটবলকে ভালবেসেই অন্য কোনও দেশকে সে নিজের দ্বিতীয় দেশ বানিয়ে নেয়। বলে ওঠে ‘অরডেম এ প্রোগ্রেসো’ বা ‘লা আলবিসেলেস্তে’। মেসি পেনাল্টি মিস করলে তাঁরা হতাশায় ডুবে যান, আবার নেইমারকে ফাউল করার প্রতিবাদে ফেসবুকে ইভেন্ট তৈরি হয় 'নেইমারকে বারবার ট্যাকেল করার প্রতিবাদে নবান্ন ঘেরাও'। এরকম আবেগ আর কোন শহরই বা দেখাতে পারে?
FIFA Football World Cup: বিশ্বকাপ বন্দনায় বাগবাজার। ছবি: শশী ঘোষ।
আরও পড়ুন: চা, রুটি বানানোর ফাঁকে হাল্কা ড্রিবলিং, সঞ্জীবও বলতে পারেন, রোনাল্ডোও
ফিরে আসি বাগবাজারে। সরকারি কর্মী প্রবীর ঘোষ প্রতি রাতেই ক্লাবে চলে আসেন খেলা দেখতে, বরবারই পাড়ার সঙ্গে আলাদা একটা টান অনুভব করেন ব্রাজিলের এই অন্ধ সমর্থক। বন্ধুতার হাত ধরে ব্রাজিল-আর্জেন্তিনা ডুয়েলটা রীতিমতো উপভোগ করেন তিনি। বলছেন, "চার বছর অন্তর এমনটা হয়। দারুণ লাগে ব্যাপারটা। আমরা গোল খেলে দু:খ হয় ঠিকই, কিন্তু ওরা গোল খেলে আবার মজাও পাই। খেলার সময় কোনও বন্ধুত্ব নেই। সে যতই পাশে বসি খেলা দেখি না কেন!" মেসির জন্য গলা ফাটান স্বরূপ মণ্ডল। পেশায় ব্যবসায়ী। তিনি জানালেন, "সব সাপোর্টাররা যে একসঙ্গে বসে খেলা দেখি এটাই সবচেয়ে ভাল লাগে। আর্জেন্তিনা-ব্রাজিলের বিরোধীতা থাকবেই। আমরা খেলাটা উপভোগ করি, লড়াইটাও।"
FIFA Football World Cup: বিশ্বকাপ বন্দনায় বাগবাজার। ছবি: শশী ঘোষ।
প্রতিবেদনের গল্পটা বা চিত্রগুলো হতে পারে বাগবাজারের। কিন্তু উত্তর থেকে দক্ষিণ সর্বত্রই হয়তো এরকম খণ্ডচিত্র দেখা যাবে। যেগুলোকে একসঙ্গে জুড়ে একটা কোলাজ বানানো হলে, একটাই ছবি আসবে। সেখানে শুধুই ফুটে উঠবে এ শহরের ফুটবল প্রেম। যা আদি ও অনন্ত। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত! এভাবেই কলকাতার পাড়াগুলো বিশ্বকাপের গল্প শুনিয়ে যাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। মর্ডানাইজেশনের মোড়কে তাকে বাঁধা যাবে না কখনই।