এই তৃতীয় ও শেষ পর্বে আমরা দেখে নেব খাস কলকাতার বুকে ফুটবল প্রতিভারা এখন কেমন আছেন। গত পর্বে রসা ইউনাইটেড ক্লাবের ফুটবল কোচিং ক্যাম্প নিয়ে বিস্তারিত বলা হয়েছে। ১৯৮৮-৮৯ সাল নাগাদ সেই ক্যাম্পে কিশোর বিভাগে যারা খেলতে এসেছিলো তাদের মধ্যে অনেকের খেলা বেশ সম্ভাবনাময় ছিলো। তৎকালীন চিফ কোচ সুশীল ভট্টাচার্য এমনটাই মনে করতেন। এলাকায় যাঁরা একটু আধটু খেলাধুলো করেছেন তাঁরাও তাই মনে করতেন। করুণাময়ী ব্রিজের নিচ দিয়ে একদা বয়ে যেত টালিনালা, যা এখন বদ্ধ জলার মত দেখায়। সেই নালার একধারে বহু নিম্নবিত্ত পরিবারের বসতি। সেখান থেকেই একঝাঁক ছেলে খেলতে আসতো। ব্রিজ পেরিয়ে সোদপুর, হরিদেবপুর, রংকলের মাঠ এইসব এলাকা থেকেও অনেকে আসতো। অনূর্ধ্ব ১৪ কিশোরদের আই এফ এ আয়োজিত স্যার দুখীরামের নামাঙ্কিত প্রতিযোগিতায় খেলতে গিয়ে প্রথম এগারো বাছতে গিয়ে কোচেরা হিমসিম খাচ্ছেন, এমন অবস্থা। সেদিনের সেই অনূর্ধ্ব ১৪'র কিশোরেরা তখন কেমন খেলছিলো আর তাদের ভবিষ্যৎ কী হয়েছে, দেখা যাক। মনে রাখতে হবে এসবই হয়েছে যখন এলাকায় ফুটবল নিয়ে আগ্রহ এখনকার থেকে বেশি, বাচ্চারা অনেক বেশি খেলাধুলো করছে এখনকার তুলনায়, খেলার মাঠটাও বিলীন হয়ে যায়নি।
অসংখ্য নাম। দুই যমজ ভাই অরুণ-বরুণকে দিয়ে শুরু করা যাক। তারা দুজন ফরোয়ার্ডে খেলতো। মূলত ড্রিবলার, স্কোরার। কোচেরা ওদের পরে হাফে খেলানো শুরু করেন তবে একইরকম খেলার স্টাইল হওয়ায় দুজনের মধ্যে যে সামান্য গতিশীল সে বেশি সুযোগ পেতে থাকে। স্টপারে খেলা রঞ্জিতকে সুশীল ভট্টাচার্য্য দরাজ সার্টিফিকেট দিতেন। স্ট্রাইকারে প্রথম দলে সব সময়েই থাকতো জয়ন্ত ও কৌশিক বলে দুজন। গোলে যে খেলতো সেই ছেলেটির ভালো নাম কী ছিলো আজ মনে নেই, কিন্তু তার ডাকনাম ছিলো নূপুর। সেকেন্ড গোলকিপার মানস। রাইট আউটে ধনঞ্জয়, লেফট আউটে লাল্টু। এবং এই প্রত্যেকটা পজিশনেই আরো দু তিনজন করে প্লেয়ার ছিলো সেই অনূর্ধ্ব ১৪ ইউনিটে। কিশোর, শংকর, রাজা, রাজু এরকম বহু নাম মনে আছে, বহু নাম ভুলেও গেছি।
আরও পড়ুন, ভারতীয় ফুটবলের অসুখসমূহ: পর্ব – ২
২০১৮'র গ্রীষ্ম। রাশিয়ায় বিশ্বকাপের খেলা জমে উঠেছে। বিশ্বকাপ নিয়ে কলম লিখতে গিয়ে ইচ্ছে হলো সুদূর অতীত খুঁড়ে এইসব নামগুলো নিয়ে জানার - তারা কে কেমন আছে। বলা বাহুল্য সবার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। ওপরের নামগুলোর মধ্যে একমাত্র যাদের শিকড় টালিনালার দুপাশের জনপদগুলোয় ছড়িয়ে আছে, যা আমারও বাসস্থান, শুধু সেখানকার কয়েকজনের কথাই জানা গেল। প্রিয় পাঠক, জেনে বিস্মিত হবেন, সেদিনের সেই খুদে প্রতিভাদের একজনও ঠিক করে ফুটবল খেলে বড়ো হতে পারেনি। ওপরে যে নামগুলো লিখলাম তাদের মধ্যে কেউ চায়ের দোকান চালান, কেউ স্থানীয় টালিগঞ্জ ক্লাবে সামান্য কোন কাজ করেন, কেউ বাস চালান, তো কেউ অটো। কয়েকজনের কর্ম সংস্থান হয়েছে স্টুডিওতে।
এদেরই একজন, একদা যাকে খুব সম্ভাবনাময় মিডিও হিসেবে মনে করা হতো, সেই শংকরের সঙ্গে দেখা ও কথা হলো। শংকর এখন টালিগঞ্জ ট্রামডিপো থেকে হরিদেবপুর রুটে অটো চালায়। যে মাঠে এক সময় আমরা বল নিয়ে দৌড়োদৌড়ি করতাম তা এখন হাসপাতাল। সেই হাসপাতালের ধারে, একটা চায়ের দোকানে রোজ সন্ধ্যায় আড্ডা দেয় সে ঘন্টাখানেকের জন্য। একটা বেসরকারি বাস ৪৭/১ ছাড়ে ওখান থেকে। দাঁড়িয়ে থাকা প্রায়ান্ধকার সেরকম একটা বাসে বসেই কথা হলো। আমার মূলত জানার ছিলো মাঝের কয়েক বছরের কথা, কী কারণে এতগুলো সম্ভাবনাময় প্রতিভা হারিয়ে গেল সেটা জানার ছিলো। যা শুনলাম হুবহু লিখছি।
শংকর ক্যাম্পে যোগ দেয় ১৯৯০ সালে। আমি যখন ১৯৯৬ সাল নাগাদ ক্যাম্প ছেড়ে দিই তখনও সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিলো। ১৯৯৮ সাল নাগাদ শংকরকে স্পট করে পঞ্চম ডিভিশনের দল জানবাজার এ সি। এক বছরের মধ্যেই সে সেখানকার প্রথম একাদশের নিয়মিত সদস্য হয়। এই সময়ে তাকে রোজ সকালে ময়দানে প্র্যাক্টিসে যেতে হতো। বলা বাহুল্য বাসভাড়া পর্যন্ত দেওয়া হয়নি তাকে কোনদিন। ২০০০ সালে জানবাজার শংকরকে চুক্তিতে সই করাতে চায়, যদিও কোন টাকাপয়সার কথা হয়নি। শংকর সই করতে অস্বীকার করে। এর পরের বছর সে দ্বিতীয় ডিভিশনের ক্লাব মিলন সমিতিতে সই করে। ২০০১-২০০২ সালের মধ্যে কোন একসময় তার বাবা হঠাৎ মারা যান, সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ে শংকরের ওপর। এসব সত্ত্বেও খেলা চলতে থাকে কারণ সেবছর মিলন সমিতি ভালো খেলে প্রথম ডিভিশনে উঠে আসে। রোজগারের জন্য শংকর এই সময় একটি পাঁউরুটির কারখানায় কাজ নেয়। তার এই সময়ের রুটিন অনেকটা এরকম - সকালে উঠে বাস ধরে ময়দানে প্র্যাক্টিস। ফিরে এসে কারখানার কাজ। বিকেলে আবার প্র্যাক্টিস। ২০০৩ নাগাদ অবস্থা খুবই সঙ্গীন হয়ে ওঠে কারণ তখনও কোন টাকাপয়সা ছাড়াই খেলতে হচ্ছে মিলন সমিতির খেলোয়াড়দের। এই সময়েই শংকর সুব্রত কাপে খেলার জন্য মধ্যমগ্রাম হাইস্কুলে সুযোগ পায়। যদিও জানবাজারের এক কর্তার অন্তর্দলীয় রাজনীতির জন্য তাকে খেলতে যেতে দেওয়া হয়নি শেষ পর্যন্ত। অবশ্য সুব্রত কাপ খেলে ফিরলেও অবস্থা একই থাকতো। সম্ভাবনাময় গোলকিপার রাজু মধ্যমগ্রামের হয়েই সুব্রত কাপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে ফিরেছিলো, সেসময় খবরের কাগজে তার ছবিও বেরোয়। সেই রাজু এখন স্কুলবাস চালায়। বস্তুত, সেই ছেলেদের মধ্যে রাজু ও শংকর হলো তারা যারা অপেক্ষাকৃত "ভালো" আছে।
আশাকরি পাঠক খেয়াল করেছেন, শংকরের এই এতগুলো বছর ধরে ফুটবলার হওয়ার লড়াইয়ের যে গল্প আপনারা পড়লেন সেখানে কোথাও রাজ্য বা কেন্দ্র সরকারের কোন উল্লেখ নেই। এমন কোন উদ্যোগ নেই এই খোঁজগুলো রাখার যে সামান্য হলেও নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ যারা দিয়েছে তারা উঠে আসতে পারছেনা কেন? যে দেশের সম্ভাবনাময় ফুটবলার সকালে কাঠফাটা রোদে প্র্যাক্টিস করে চা আর বাসি রুটি খেয়ে গল্ফ ক্লাবের ঘাসের পরিচর্যায় লেগে পড়ে, সেই দেশের ফুটবল ফেডারেশানে যত বড়ো দক্ষ প্রশাসকই আসুন লাভ নেই - যদি না তিনি ফুটবলারদের সমস্যাগুলো সম্পর্কে অবহিত থাকেন। যে দুখীরাম মজুমদার স্মৃতি টুর্নামেন্ট দিয়ে এই ছেলেগুলোর যাত্রা শুরু হয়েছিলো তিনি কলকাতা রায়টের সময় পূর্ণিয়ার এক প্রত্যন্ত এক হবু ফুটবলারকে বাংলা শিখিয়ে সন্তোষ ছদ্মনামে একটি হিন্দু পরিবারে রেখেছিলেন। সেই ফুটবলারের নাম সামাদ। এরকম অসংখ্য খেলোয়াড় স্কাউটিং করে, দরকার মত অর্থ সাহায্য করে বা অন্যভাবে আগলে রেখে তাদের স্বপ্নগুলোকে ফুটিয়ে তুলেছিলেন বলেই ষাট-সত্তরের দশকে ভারত এশিয়ায় অপ্রতিরোধ্য ছিলো। খাস কলকাতার বুকেই যদি এই অবস্থা হয় তাহলে অন্যত্র অবস্থা কেমন সহজেই অনুমেয়। একসময় দুর্দান্ত সব ফুটবলার তুলে আনা জেলাগুলোর খবর মাঝে মাঝে সংবাদপত্রে ভেসে ওঠে, জানা যায় ফুটবলার তৈরীর আঁতুড়ঘরগুলোর দুরবস্থা।
আরও পড়ুন, ভারতীয় ফুটবলের অসুখসমূহ: পর্ব -১
এইসবের মধ্যে একমাত্র আশার আলো, তরুণ প্রজন্ম (খেলোয়াড় এবং দর্শক দুইই) ফুটবল নিয়ে ভাবেন, তাঁদের নিজেদের মত করে পড়েন, আলোচনা করেন। বহু অনলাইন ফোরামে এই দুঃখ ঘুরে ফিরে আসে যে ভারত কোন বিশ্বমানের আঙ্গিনায় খেলেনা, বা জাপান/আফ্রিকার মত ভারত থেকে কোন তারকা নেই যিনি ক্লাব ফুটবলের বিখ্যাত কোন ক্লাবের অপরিহার্য্য অঙ্গ। কয়েক দশক আগে কিন্তু এ অলীক স্বপ্ন ছিলোনা। পিকে-চুনী-বলরামের যুগ ছেড়েই দিলাম, সেসময়ে ভারত যুগোস্লাভিয়া বা হাঙ্গেরির মত দলের সাথেও সমানে সমানে খেলেছে। তার আগেও মহম্মদ সেলিমের মত দাপুটে ফুটবলার এসেছেন যিনি Celtic এর হয়ে খেলেছেন, এবং নামী ব্রিটিশ ও জার্মান ক্লাবের অফার ফিরিয়ে দিয়ে দেশে ফিরে আসেন। বা পরবর্তীকালের এশিয়ান অলস্টার একাদশে সুযোগ পাওয়া খেলোয়াড়েরাও বিশ্বমানের ছিলেন।
আজ আবার যদি সেই সময়ে ফিরে যেতে হয়, তাহলে সেই আন্তরিকতা ফিরিয়ে আনতে হবে। সুনীল ছেত্রীর কথা আমাদের বারবার মনে করতে হচ্ছে কারণ তিনিও একজন নিম্ন-মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলে। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে তিনি নিজের জীবনের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন --
" আমাদের দেশের অদ্ভুত নিয়ম। যখন তুমি একজন সফল মানুষ তখন তোমার ওপরে প্রচুর আলো, প্রচুর সমর্থন। যখন তুমি কেউ নও, একটা বাচ্চা যে এগোতে চাইছে- তখন এসব কিছুই নেই। অথচ তখনই এই সাপোর্ট সিস্টেমের বেশি দরকার। আমার বাবা আর্মিতে ছিলেন, মাইনে কম ছিলো। তাই আমার জুতো ছিঁড়ে গেলে আমি নিজেই সেলাই করে করে চালাতাম কিছুদিন। আজ আমি স্টার, নাইকি আমার স্পনসর। আমার বাড়িতে তিরিশ চল্লিশটা জুতো এসে পড়ে থাকে। অথচ, জানেন, এখন কিন্তু এই সাপোর্টের আমার দরকার নেই, আমি নাইকির সবথেকে দামি জুতোটাও কিনেই পরতে পারি। কিন্তু সেদিন একটা যেকোন চলনসই জুতো হলেই হতো।"
ভারতীয় ফুটবলের (এবং ক্রিকেট বাদে অন্য খেলারও) উন্নতিকল্পে সরকার এবং কর্পোরেট স্পনসর ঠিক কীভাবে কাজ করছে তা বোঝার জন্য সুনীলের ওপরের বক্তব্যটিই যথেষ্ট।
সদ্য শেষ হওয়া অনূর্ধ্ব ১৭ বিশ্বকাপে উঠতি প্রতিভাদের খেলা দেখে যাঁরা খুব আশান্বিত তাঁদের মনে রাখতে হবে যে জুনিয়র বা সাব-জুনিয়র লেভেলে ভারতীয়রা অন্যান্য দেশের সাথে খুবই ভালো লড়াই দিতে পারে। এর মানে এই নয় যে সিনিয়র লেভেলেও তারা সমকক্ষ হয়ে উঠবে। সিনিয়র লেভেলে ভারতের সাথে অন্য দেশগুলোর মানের তফাৎ তা মেটানোর জন্য শ্লথ অগ্রগতি দিয়ে হবেনা। প্রয়োজন, বিশেষজ্ঞদের ভাষায় "বিগ লিপ"। তার জন্য দরকার আরো অনেক প্রতিভার, যাঁরা উপযুক্ত ট্রেনিং পেলে বিদেশের ক্লাবগুলোতে প্রথম একাদশে খেলবে। এই ফর্মুলাতেই যখনই প্রয়োজন পড়েছে তখন ইউরোপীয় ফুটবল শক্তিগুলো নিজেদের হৃতগৌরব ফিরিয়ে এনেছে। দরকার আরো অনেক খেলোয়াড়, যাদের মান সুনীল, গুরপ্রীত, সুব্রতদের মত বা আরো ভালো। কিছুদিন আগেই হয়ে যাওয়া ইরানের সাথে ভারতের খেলায় ভারতীয় দল চার গোলে হারে। সেই খেলায় গোলরক্ষক গুরপ্রীত অন্তত আটটা অবধারিত গোল বাঁচান। এটা ভাবা হাস্যকর হবে যে ভারতে ইরানের সমতুল্য মানের একটা ফুটবল দল গড়ার মত প্রতিভা নেই। এই মানের তফাৎ কমাতে হলে দরকার আরো অনেক বেশি আইকন ফুটবলার, যাঁদের দেখে পরবর্তী প্রজন্ম ফুটবল খেলতে আসবে। এবং সর্বোপরি দরকার প্রতিভাদের চিহ্নিতকরণ ও সাপোর্ট। ১৩৫ কোটির দেশে ২২ জন বিশ্বমানের ফুটবলার তৈরী করা খুবই সম্ভব। কিন্তু স্বচ্ছ, আন্তরিক প্রশাসন ও সদিচ্ছা ছাড়া সেটা সম্ভব নয়।