Advertisment

ভালোবাসার মানুষের জন্য হেলমেট পরতেন না, জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছেন রমন লাম্বা

স্ত্রীকে দেখতে পাওয়ার জন্য রামন লাম্বা হেলমেট পড়তে চাইতেন না। আর সেই না চাওয়াই কাল হয়েছিল। মাঠেই মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল ভারতীয় সুপারস্টারকে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

By Rabiul Islam Biddut

Advertisment

মানুষ মারা গেলে নাকি দূর আকাশের তারা হয়ে যায়! হাজারো মাইল দূর থেকে আলো দিয়ে যায় সেই তারা। তেমনিভাবে টেস্ট-পূর্বযুগে বাংলাদেশের ক্রিকেটে তারা হয়ে এসেছিলেন রমন লাম্বা। বাংলাদেশের ক্রিকেটে রোশনাই ছড়িয়ে এই দেশেরই সবুজ গালিচায় বানিয়েছেন মৃত্যুর মঞ্চ। নিজের অজান্তেই অপরাধী করে গিয়েছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটকে। আজ এত বছর পরে এসেও সেই দুঃস্বপ্ন তাড়িয়ে বেড়ায় বাংলাদেশের ক্রিকেটকে। হয়তো চিরকালই তাড়া করে ফিরবে সেই ট্র্যাজেডি।

এখনকার প্রজন্ম আবাহনী-মহামেডানের মহারণ দেখতেই পেল না। কী ক্রিকেট, কী ফুটবল-কোথায়ও সেই উত্তাপ-আবেগের দেখা মেলে না। কিন্তু তখনকার দিনে আবাহনী-মহামেডান দ্বৈরথ মানে দেশ দু'ভাগ হয়ে যাওয়া। এমনি এক আবাহনী-মহামেডান ম্যাচে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে নেমেছিলেন রমন লাম্বা। দিনটি ছিল ২০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৮। সেদিন কে বুঝতে পেরেছিল এই ম্যাচেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে চলেছেন রমন লাম্বা! বাংলাদেশের ক্রিকেটে তখন নামি মুখ তিনি। সেই রমন লাম্বার অকাল প্রয়াণ গোটা দেশকে শোকস্তব্ধ করে দিয়ে গিয়েছিল।

আরো পড়ুন: বিশ্বকাপ জয়ের একবছর! ‘স্বপ্নের সওদাগর’ আকবর এখনও আবেগে ভাসেন

আবাহনী-মহামেডান সেই ট্র্যাজিক ম্যাচে রমন লাম্বা আবাহনীর হয়ে মাঠে নেমেছিলেন। ১৯৯১ সাল থেকে ভারতের এই ক্রিকেটার বাংলাদেশের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন। আর প্রতি মরসুমে নিয়ম করে আবাহনীতে খেলতে আসতেন। এভাবে লাম্বা হয়ে উঠেছিলেন আবাহনীর 'ঘরের ছেলে'।

publive-image

আবাহনী ওই ম্যাচে প্রথমে ব্যাট করে স্কোরবোর্ডে খুব সম্ভবত ১৫৭ রান তুলেছিল। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য জয় চাই আবাহনীর। মহামেডানের হয়ে তখন ব্যাট করছিলেন মেহরাব হোসেন অপি। নন স্ট্রাইক এন্ডে ছিলেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল। নিয়মিত অধিনায়ক আকরাম খান তখন মাঠের বাইরে। তাঁর হয়ে দায়িত্ব পালন করছিলেন খালেদ মাসুদ পাইলট৷ মোহামেডানকে আরও চেপে ধরতেই পাইলট বল তুলে দিয়েছিলেন বাঁহাতি স্পিনার সাইফুল্লাহ খান জেমের হাতে। জেমের ওভারে বারবার শর্ট মিড উইকেট থেকে হেঁটে হেঁটে স্লিপে আসছিলেন রমন লাম্বা। অপির কাছে গিয়ে দু-চার কথা শুনিয়েও যাচ্ছিলেন৷

মাঠে সেদিন কী ঘটেছিল? সাইফুল্লাহ খান জেম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-র ফোন পেয়ে টাইম মেশিনে চড়ে পেছনে ফিরে গেলেন৷ তিনি বলছিলেন, "ওই ওভারটি ছিল সার্কেলের শেষ ওভার। শেষ তিন বলে যেন রান না হয় সে জন্য আমি রমন লাম্বাকে শট মিড উইকেটে থাকতে বলেছি। কিন্তু ও বারবার স্লিপে চলে আসছিল। আমি ওকে বললাম, 'আমার লাস্ট বল তুমি স্লিপে এসো না। চার হয়ে গেলে ওদের (মহামেডান) রান বেশি হয়ে যাবে। তুমি শট মিড উইকেটেই থাকো।' কিন্তু ও হাঁটতে হাঁটতে এসে অপিকে স্লেজিং করছিল এবং ফরোয়ার্ড শর্ট লেগে দাঁড়াচ্ছিল হেলমেট ছাড়া। আমি বারবার নিষেধ করেছি। হেলমেট নিতে অনুরোধ করেছি, কিন্তু ও শোনেনি। শেষ অবধি বলই করে ফেলেছি। অপির পুল শট রমন লাম্বার মাথায় লেগে ওপরে উঠে যাওয়ার পর পাইলট ওই ক্যাচটা ধরে। সে সময় বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে খেলা হতো। স্ট্রেচারও থাকত না…ওকে হাঁটতে হাঁটতে ড্রেসিংরুমে নিয়ে যাওয়া হলো৷ হেঁটে যাওয়ার সময় মোটামুটি কথা বলতে পারছিল। ড্রেসিংরুমে যাওয়ার পর আর কথা বলেনি।”

publive-image

৩৮ বছরের রমন লাম্বা মাঠে জ্ঞান হারাননি। কিন্তু ড্রেসিংরুমে যাওয়ার পর তাঁর সহ্যক্ষমতার সীমা পেরিয়ে যায়। বমি করতে করতে অজ্ঞান হয়ে যান রমন লাম্বা। সেই যে সংজ্ঞা হারালেন আর ফিরলেন না। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে তিনদিন থমকে ছিলেন রমন লাম্বা। দেশ সেরা সব চিকিৎসকদের চেষ্টা ব্যর্থ করে তিনি পাড়ি জমালেন না ফেরার দেশে, ২৩ ফেব্রুয়ারি।

ভারতের হয়ে আশির দশকে অভিষেক হয় রমন লাম্বার৷ ৪ টেস্ট আর ৩২ ওয়ানডেতে থেমে গিয়েছিল তাঁর আন্তর্জাতিক কেরিয়ার৷ কিন্তু রমন লাম্বার ক্রিকেটপ্রেম তাতে আটকে থাকলে তো! বাংলাদেশ, আয়ারল্যান্ড ও ইংল্যান্ডে চুটিয়ে ঘরোয়া লিগ খেলেছেন। খেলতে খেলতেই প্রেম হয়ে যায় আইরিশ তরুণী কিমের সঙ্গে। এই যে রমন লাম্বা মাঠে নেমে হেলমেট পড়তে চাইতেন না সেটা ওই কিমের জন্যই৷

publive-image

কেন? বাকিটা শুনুন সাইফুল্লাহ খান জেমের কন্ঠে, "আমি ১৩ দিনের মতো একটা ঘরে বসেছিলাম। খারাপ লাগার জন্যে আমার মাথায় খানিকটা সমস্যা হয়েছিল। রমন লাম্বার স্ত্রী আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলছিলেন, 'তুমি এত দুশ্চিন্তা কোরো না।' ওঁর স্ত্রী যখন বাচ্চা নিয়ে আসতেন, তখন দেখেছি তাদের সম্পর্ক। সারাক্ষণ রমন লাম্বার কানে কি যেন গুনগুন করে বলে যাচ্ছিল। এটা দেখে আমি চোখের জল ধরে রাখতে পারিনি। আমাকে কিম বলেছিলেন, 'তুমি এটা নিয়ে কোনো অনুশোচনায় ভুগো না। আমাকে দেখার জন্য আমার হাজবেন্ড হেলমেট পড়তেন না। এখানে তোমার কোনো দোষ নেই।”

ভারতের হয়ে খেলার সময়ও হেলমেট পড়তেন না রমন লাম্বা। তাহলে তো কিম দেখতে পাবে না! যে অভ্যাসটা তাঁর রয়েই গিয়েছিল। শুধু ক্রিকেট নয় প্রেমেরও সংজ্ঞা নতুন করে লিখে গিয়েছেন রমন লাম্বা। কিমকে নিয়ে দিল্লিতে সুখের ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। মহামেডান ম্যাচে নামার আগে সাইফুল্লাহ খান জেমের কাছে দিল্লির সেই ঘরের কথা শুনিয়েছেন। নতুন বাড়িতে কিমকে নিয়ে থাকবেন৷

publive-image

সেই প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে গলাটা যেন ধরে এলো জেমের, "ওর সাথে আমার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। মাঠে নামার আগে ও আমাকে বলেছিল, 'জেম আমি ভারতে যে বাড়িটা বানিয়েছি সেখানে এবার ফ্যামিলি নিয়ে উঠব৷ একদম নতুন বাড়ি৷ ওর স্ত্রীও বারবার সে কথাই বলছিলেন, 'আমার হাজবেন্ডের নতুন বাড়িতে ওঠার কথা ছিল। ওর সে আশা পূরণ হলো না।”

publive-image

কোনো সন্দেহ নেই বাংলাদেশের ক্রিকেটে প্রথম বিদেশি সুপারস্টার রমন লাম্বা। মাঠের ক্রিকেটেও তাঁর বিচরণ ছিল সুপারস্টারের মতোই। বলেকয়ে সেঞ্চুরি করতে পারতেন রমন লাম্বা। সাইফুল্লাহ খান জেম স্মৃতি ঘেঁটে বলছিলেন, "ও প্রচণ্ড রসিক ছিল। মাঠে ঠিক তার উল্টো। ভীষণরকম প্রফেশনাল। ও খালি জিততেই চাইত৷ হার পছন্দ করত না। ওঁর মানসিকতাই ছিল “ আমি হারব না।” জয়ের নেশা ছিল। প্র্যাকটিসে বলত কাল সেঞ্চুরি করব, তাই করতোও। ৩০-৪০ হলেই আমরা ধরে নিতাম ও ১০০ মেরে দেবে।”

এই জন্যই বোধহয় রমন লাম্বা বন্ধুদের সঙ্গে রসিকতা করে বলতেন, "আমি ঢাকার ডন।”

এখন সেই তিনিও নেই, শুধু রয়ে গিয়েছে লাম্বার স্মৃতি। সেই স্মৃতি কখনওই মুছে যাবে না বাংলাদেশ ক্রিকেট থেকে।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

Bangladesh Cricket Indian Cricket Team
Advertisment