হারার আগে হারছে না বাংলা। লড়ছে, মরণপন লড়ছে তিরিশ বছর পর ফের রঞ্জিজয়ের স্বপ্নপূরণে। চতুর্থ দিনের শেষে আম্পায়াররা যখন বেল তুলে নিচ্ছেন, বোর্ডে বাংলা ৩৫৪-৬। অনুষ্টুপ মজুমদার ব্যাটিং ৫৮। সঙ্গী অর্ণব নন্দী অপরাজিত ২৮। ফার্স্ট ইনিংসে লিডের ভিত্তিতেই যে এই ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারিত হতে যাচ্ছে, সেটা না লিখলেও চলে।
অঙ্ক যা দাঁড়াচ্ছে, সৌরাষ্ট্রের ৪২৫-কে টপকে ট্রফিতে হাত রাখলে হলে অভিমন্যু ঈশ্বরনের বাংলার এখনও দরকার ৭২। হাতে চার উইকেট। কাজটা এখনও কঠিন, কিন্তু মোটেই অসম্ভব নয় আর। জয়ের সিংহদুয়ার এখন দৃশ্যমান। ব্যাট-বলের সেয়ানে-সেয়ানে টক্করে রাজকোট সাক্ষী থাকছে এক স্মরণীয় রঞ্জি ফাইনালের। ম্যাচ এখন যে মোহনায় দাঁড়িয়ে, জিততে পারে যে কেউই। শেষ হাসি কার? রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা আগামিকাল পর্যন্ত।
আরও পড়ুন: তৃতীয় দিন পার, এগিয়ে সৌরাষ্ট্র, অভিমন্যুর আউট ঘিরে তীব্রতর হচ্ছে বিতর্ক
সকালের সেশনটা আজ দুর্দান্ত কেটেছিল বাংলার। সুদীপ-ঋদ্ধির জুটি পাল্টা চ্যালেঞ্জ জানাতে শুরু করেছিল প্রতিপক্ষকে। লাঞ্চ পর্যন্ত অবিচ্ছেদ্য থেকে প্রথম সেশনের ২৯ ওভারে দু'জন যোগ করেছিলেন ৮৪, চিন্তার ভাঁজ দেখা যাচ্ছিল সৌরাষ্ট্র অধিনায়ক জয়দেব উনাদকাটের কপালে।
বারাসাতের সুদীপ চট্টোপাধ্যায়কে ঘিরে এই বছরদুয়েক আগেও স্বপ্ন দেখত বাংলার ক্রিকেটমহল। সৌরভ-পরবর্তী প্রজন্মে বাংলার সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিমান বাঁ-হাতি হিসেবে ধরা হতো। ঘরোয়া ক্রিকেটে একের পর এক চোখ ধাঁধানো ইনিংস সুদীপকে এনে ফেলেছিল জাতীয় নির্বাচকদের নজরেও। ভারতীয় 'এ' দলে যে কোনও সময় ঢুকে পড়তে পারেন, এমন গুঞ্জন শোনা যেত কান পাতলেই। সেই সুদীপ হঠাৎ করেই ব্যাখ্যাতীত খারাপ ফর্মে আক্রান্ত হন গত রঞ্জি মরশুমে। ব্যর্থ হতে শুরু করেন ধারাবাহিকভাবে। এই মরশুমের শুরুর দিকের ম্যাচগুলির স্কোয়াডে জায়গাই হয়নি সুদীপের। কর্ণাটকের বিরুদ্ধে ইডেনের সেমিফাইনালে ফের দলে ফেরানো হয় সুদীপকে। যাঁর ফর্মে ফেরার ইঙ্গিত ছিল দ্বিতীয় ইনিংসের ৪৬-এ।
5⃣0⃣: Anustup Majumdar brings up his fifty as Bengal near 350 in the @paytm #RanjiTrophy 2019-20 #Final.
Follow the #SAUvBEN game live ????https://t.co/LPb46JOjje pic.twitter.com/dBsVXgr1KA
— BCCI Domestic (@BCCIdomestic) March 12, 2020
সেই ইঙ্গিত ডালপালা মেলল রঞ্জি ফাইনালে। কঠিন থেকে কঠিনতর হতে-থাকা বাইশ গজে টিমের সঙ্কটে সুদীপের ব্যাট থেকে এল লড়াকু ৮১। সকালের প্রথম দু'ঘন্টায় শত চেষ্টা করেও সুদীপের জমাট ডিফেন্সে ফাটল ধরাতে ব্যর্থ হয়েছিল সৌরাষ্ট্রের বোলিং-ব্রিগেড। ছন্দপতন ঘটল লাঞ্চের পরে, ধর্মেন্দ্র জাদেজার স্পিনে শর্ট লেগে ধরা পড়লেন সুদীপ। সেঞ্চুরি থেকে ১৯ রান দূরে থেমে গেল ইনিংস। একটা ১২৫/১৫০ সুদীপের থেকে চাইছিল বাংলা। পারেননি, কিন্তু মানতেই হবে, এই উইকেটে ৮১-ও অমূল্য।
আরও পড়ুন: তিন দশকের ব্যবধান পেরিয়ে শুনছি পিকে’র কণ্ঠস্বর, ‘ফাইট বেঙ্গল, ফাইট!’
লড়েছেন ঋদ্ধিমান সাহাও। নিজের দ্বিতীয় সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরের দিনই যিনি কলকাতা থেকে উড়ে গিয়েছিলেন বাংলার রঞ্জি জয়ের লড়াইয়ে শরিক হতে। আজ প্রথম সেশনে সুদীপ ধরলেন, আর ঋদ্ধি সুযোগ পেলেই মারলেন। মাথায় চড়তে দিলেন না বোলারদের। ক্লোজ-ইনে ক্যাচ পড়েছে তাঁর। স্লিপে ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে গেছেন। লেগ বিফোরের জোরালো আবেদন নাকচ হয়েছে, কিন্তু স্কোরবোর্ড চালু রেখে গেছেন। ৬৪ রানে প্রেরক মানকড়ের বলে প্লেড-অন হয়ে যখন ফিরছেন, হতাশ দেখাচ্ছিল ঋদ্ধিকে। স্বাভাবিক। তাঁর ব্যাট থেকে আরও রানের প্রত্যাশী ছিল টিম।
শাহবাজ আমেদ (১৬) যখন ফিরলেন চেতন সাকারিয়ার বলে বোল্ড হয়ে, বাংলা তখন ২৬৩-৬। জয়ের স্বপ্ন ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর দেখাচ্ছে যখন, খেলাটা ধরলেন অনুষ্টুপ মজুমদার। সেই অনুষ্টুপ, কোয়ার্টার-ফাইনাল এবং সেমিফাইনালে যাঁর দুরন্ত সেঞ্চুরি বাংলাকে খাদের ধার থেকে তুলে এনেছিল। সেই অনুষ্টুপ, যাঁর ব্যাট চলতি মরশুমে বাংলার মূর্তিমান সঙ্কটমোচন। সঙ্গী অর্ণব নন্দীকে নিয়ে সপ্তম উইকেটে যোগ করেছেন ৯১ রান। এবং ঠুকুরঠুকুর ব্যাটিংয়ে নয়, আগাগোড়া 'পজিটিভ' মানসিকতায়। স্লিপে অনুষ্টুপের একটা সহজ ক্যাচ ছেড়েছে সৌরাষ্ট্র। যার জন্য ম্যাচ শেষে ঘোর আফসোস করতে হতে পারে উনাদকাটদের।
রঞ্জি ফাইনাল ফের দেখাচ্ছে, এই বাংলা অন্য বাংলা। হারার আগে হেরে যাব না, এই বাংলার মধ্যে কোচ অরুণলাল সেই বিশ্বাসটা ঢুকিয়ে দিয়েছেন। সেই বিশ্বাসেরই চিত্রনাট্য লিখছে বাংলার ব্যাটিং। মরিয়া লড়াই চালাচ্ছে রঞ্জিশৃঙ্গ আরোহনে।
জয় আসছে? এখনও নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। তবে এটুকু লিখেই ফেলা যায়, বাংলা হারার আগে হারছে না।
ফাইট বেঙ্গল ফাইট!