কলকাতা ফুটবল উঠে এসেছিল খোদ রাজ্যসভার বক্তৃতায়। সাংসদ ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আর্জি জানিয়েছিলেন, কলকাতার তিন প্রধানকে যেন সেনাবাহিনীর হাত থেকে মালিকানা তুলে দেওয়া হয় ক্লাবগুলির কাছে। রাজ্যসভায় এমন বক্তৃতা পেশের পরেই কোমর বেঁধে নামছে কলকাতার তিন ক্লাব।
মোহনবাগান অর্থসচিব দেবাশিস দত্ত ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-কে জানালেন, ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজ্যসভায় বিষয়টি তুলে ধরার পরেই কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আর্জি জানাতে চলেছেন তাঁরা। সরকারিভাবে চিঠি পাঠানো হবে কেন্দ্রীয় ক্রীড়ামন্ত্রী কিরেন রিজিজুকে। "অত্যন্ত ভাল উদ্যোগ নিয়েছেন ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। পশ্চিমবঙ্গের সকল এমপি-কে এই বিষয়ে দলমত নির্বিশেষে এগিয়ে আসতে হবে। গতকাল রাতেই ঋতব্রতবাবুর সঙ্গে কথা হয়েছে। ওঁকে ধন্যবাদ জানিয়েছি।" বলছিলেন দেবাশিস দত্ত।
মোহনবাগানের শীর্ষ কর্তা আশা করছেন, ঋতব্রতবাবু ভবিষ্যতেও কলকাতার ক্লাবগুলির প্রয়োজনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবেন। ক্লাবের পরিকল্পনা খোলসা করতে গিয়ে দেবাশিসবাবু বলছিলেন, "ঋতব্রতবাবু এই ইস্যুতে রাজ্যসভায় প্রয়োজনে আবারও সরব হবেন। আমরা ওঁর সঙ্গে রয়েছি। একসঙ্গে এই ইস্যুতে ভবিষ্যতেও থাকতে হবে সবাইকে।"
ইস্টবেঙ্গল মাঠ (উইকিপিডিয়া)
কলকাতা ময়দানে শোরগোল ফেলে দেওয়া ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় শুক্রবার ফিরে এসেছেন শহরে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার তরফে যোগাযোগ করা হলে উনি জানাতে থাকেন, কলকাতার তিন প্রধান নিয়ে তাঁর স্বপ্নের পরিকল্পনার কথা। ইস্ট-মোহন দুই ক্লাবেরই সদস্য ঋতব্রতবাবু বলছিলেন, "ফুটবলের সঙ্গে আমার আত্মিক যোগ। প্রিয় দলের খেলা দেখতে নিয়মিত মাঠে যাই। ঘটনা হল, আমাদের ঔপনিবেশিক মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ব্রিটিশ সরকার গোটা বিশ্ব জুড়ে নিজেদের উপনিবেশের খেলার মাঠে সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল। সময়ের নিয়মে ব্রিটিশ রাজ্যপাট মিটতেই সেই মাঠের দখল সংশ্লিষ্ট ক্লাবগুলিকে দিয়ে দেওয়া হয়ে। কলকাতায় তিন প্রধানের ক্ষেত্রে অবশ্য তা হয়নি।"
এক নিঃশ্বাসে ব্রাজিলের ও গ্লোবো পত্রিকায় কলকাতা ফুটবলের ছবি ছাপানোর দৃষ্টান্তে টেনে তিনি বলতে থাকেন, "তিন ক্লাবের ফুটবল প্যাশনের বিষয়টি বুঝতে হবে। কলকাতায় ফুটবল আবেগ বিশ্বজনীন। সামান্য পেরেক পুঁততেও তিন প্রধানের সেনাবাহিনীর অনুমতি লাগে, সমস্যা এখানেই।" সেই সঙ্গে তিনি আরও জানালেন, দুই প্রধানের শীর্ষ কর্তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে এই বিষয়ে। শনিবারে তিনি দেবব্রত সরকার এবং দেবাশিস দত্তের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন।
মোহনবাগানের ঘরের ছেলে কল্যাণ চৌবে জানাচ্ছেন এই সমস্যা দ্রুত সমাধান হওয়া প্রয়োজন। তিনি বলছেন, "মোহনবাগান এই ইস্যুতেই ডুরান্ড কাপ খেলা বয়কট করেছিল। বছরের ১৫ দিন সেনাবাহিনী ক্লাবের মাঠের দখল নিয়ে নেয়। ব্যক্তিগতভাবে রাজ্য সভাপতি (বিজেপি), কেন্দ্রীয় ক্রীড়ামন্ত্রীর সঙ্গে এই বিষয়ে বেশ কয়েকবার কথা হয়েছে। আমরা বহুদিন ধরেই এই বিষয়ে সরব। ঋতব্রতবাবু যদি সাংসদে এই বিষয়ে কিছু বলেন, সেটা অবশ্যই ভাল বিষয়।"
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশকে গর্বিত করা ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান এবং মহামেডান- তিন ক্লাবের সমস্যা বহু পুরনো। তিন ক্লাবের মাঠ, গ্যালারি কোনও কিছুই তাদের নয়। সেনাবাহিনীর মালিকানাধীন ক্লাবের যাবতীয় সম্পত্তি। এই ইস্যু নিয়েই সাংসদ ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যসভায় জানিয়েছিলেন, ব্রিটিশ শাসনে তিন ক্লাব যে সেনাবাহিনীর কাছ থেকে লিজে মাঠের দখল পেয়েছিল। এখনও সেই মাঠ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানেই।
ক্লাবের পরিকাঠামোগত উন্নতির পথে অন্তরায় প্রতিটি মুহূর্তে সেনাবাহিনীর নির্দেশের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকা। এরপরেই ঋতব্রত আর্জি জানিয়েছিলেন, সেনাবাহিনীর কাছ থেকে মালিকানাধীন তুলে নিয়ে ক্লাবের সম্পত্তি যেন ক্লাবের দায়িত্বেই দেওয়া হয়।
ঋতব্রত শীর্ষস্তরে আলোচনা শুরু করার পরে অক্সিজেন পেয়েছে তিন ক্লাবই। মোহনবাগান ক্রীড়ামন্ত্রী চিঠি পাঠাতে উদ্যোগী হলেও ইস্টবেঙ্গল অবশ্য এখনই এই বিষয়ে ভাবছে না। লাল হলুদ শীর্ষ কর্তা শান্তিরঞ্জন দাশগুপ্ত বলছিলেন, "ক্লাবে এই বিষয় নিয়ে আগেই আলোচনা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীকে আগেই ক্লাবের বিভিন্ন বিষয়ে জানানো হয়েছিল। সেই সঙ্গে প্রণব মুখোপাধ্যায় রাষ্ট্রপতি থাকার সময়ে এই বিষয়ে তাঁকে অবগত করা হয়।"
মোহনবাগান মাঠ (উইকিপিডিয়া)
পাশাপাশি তিনি বলছেন, "ক্রীড়ামন্ত্রীকে চিঠি লিখলে সমস্যার সমাধান হবে বলে বিশ্বাস করি না। কারণ, পুরো বিষয়টাই প্রতিরক্ষামন্ত্রকের নিয়ন্ত্রণাধীন। এটা দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। রাজ্যসভায় বিষয়টি উত্থাপিত হওয়াই অনেক বড় বিষয়। পরবর্তীকালে হয়তো বিষয়টি নিয়ে রাজ্যসভায় বিতর্কসভা হতে পারে।"
আইলিগের খেলা শুরু ৪৮ ঘণ্টা পরেই। ইস্ট-মোহন দু-ক্লাবই এবার আইলিগে শহর-ছাড়া। কলকাতা ছেড়ে ইস্ট-মোহনকে হোম ম্যাচে খেলতে হবে কল্যাণীতে। কল্যাণ চৌবে নিজে জানাচ্ছেন, রাজ্য বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষ বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট চিন্তিত। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলায় দুই প্রধানে খেলা তারকা গোলকিপার বলছেন, "কিছুদিন আগেই উনি কলকাতার ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগানের কল্যাণীতে হোম ম্যাচ খেলা নিয়ে জানতে চেয়েছিলেন। উনি বিষয়টির দ্রুত সমাধান চাইছেন।"
সবমিলিয়ে বহু পুরনো ইস্যুকে সামনে আনায় কলকাতা ফুটবল আপাতত কুর্নিশ করছেন ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়কে।