ভারতীয় ক্রিকেটের ফ্যান হিসাবে আজ গর্বিত লাগছে তেন্ডুলকর, কোহলি, গাভাস্কর, কপিল দেব, শেহওয়াগ, দ্রাবিড়, লক্ষ্মণ, সৌরভ গাঙ্গুলির দেশে জন্মগ্রহণ করেছি আমি। সব জল্পনার অবসান ঘটিয়ে বাংলার সৌরভ বিসিসিআইয়ের প্রেসিডেন্ট পদে মনোনীত হবেন ২৩ অক্টোবরের এজিএমে।
জেসি মুখার্জী (১৯৫১-৫৪), এএন ঘোষ (১৯৬৯-৭২), বিএন দত্ত (১৯৮৮-১৯৯০), জে ডালমিয়ার (২০০১-০৪, ২০১৩, ২০১৪-১৫) পর পঞ্চম বঙ্গসন্তান হিসেবে সৌরভ বোর্ডের প্রেসিডেন্ট হবেন। ৬৫ বছর পর একজন খেলোয়াড় বসছেন বোর্ডের মসনদে। পাঁচ বছর সিএবি-র প্রেসিডেন্ট থাকার পর সৌরভের পরবর্তী পদক্ষেপ এটি।
বোর্ড যখন কোর্ট কেসে জর্জরিত, ঠিক তখনই সর্বসম্মতিক্রমে এই পদমর্যাদা পেলেন সৌরভ। ১৯৯৯ সালে যখন তথাকথিত 'ম্যাচ-ফিক্সিংয়ে'র জন্য গেল গেল রব উঠেছিল, তখন শক্ত হাতে ভারতীয় দলের হাল ধরেছিলেন এই সৌরভই।
রাজ্য-রাজনীতি ভুলে গিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যোগ্য খেলোয়াড় তুলে এনে এক অপ্রতিরোধ্য টিম গড়েছিলেন, কোনও আপোস না করে, নিজের হাতে। সেই টিম স্টিভ ওয়ার 'লাস্ট ফ্রন্টিয়ার' জয়ের স্বপ্ন চুরমার করে সিরিজে ০-১ পিছিয়ে পড়ে সিরিজ জিতে নিয়েছিল। কে ভুলতে পারে ইডেন গার্ডেন্সে লক্ষ্মণ-দ্রাবিড়ের সেই পার্টনারশিপ। ভুললে চলবে না, আরেকজনের কথা। প্রায় কিশোর সর্দার হরভজন সিংও হ্যাটট্রিক করেছিলেন সেই ম্যাচে।
আরও পড়ুন: ‘ফর্ম ইজ টেম্পোরারি, ক্লাস ইজ পার্মানেন্ট’, প্রমাণ করে দিলেন রোহিত শর্মা
যদিও সময় কম (মাত্র ১০ মাস), সৌরভের কাছে পথপ্রদর্শক হিসাবে ছাপ রেখে যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। যে কাজ ১০ মাসে হয় না, সে কাজ ১০ বছরেও হবে না। সৌরভেরও সম্ভবত তাই চিন্তাধারা। নতুন টিম নিয়ে আবার মাঠে নেমে পড়বেন ক্যাপ্টেন।
অন্যদিকে, ভারতের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার শেষ দু'টি টেস্ট দেখে ক্রিকেট দর্শক হিসাবে বেশ হতাশই হলাম। ২০১৫-১৬ সালে ভারতের কাছে ০-৩ সিরিজ হারতে হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকাকে। ভেবেছিলাম, এই দক্ষিণ আফ্রিকা যতই নতুন দল হোক না কেন, সেই ৯০-৯১-এ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রত্যাবর্তনের পর তারা কিছুটা হলেও লড়াই করবে ভারতের বিরুদ্ধে। সে কোহলিরা নিজেদের ঘরের মাঠে যতই শক্তিশালী হোক না কেন।
প্রথম দু'টো টেস্টের প্রথম ইনিংস ছাড়া সেরকম কিছুই দেখলাম না দক্ষিণ আফ্রিকার মধ্যে, যা ভবিষ্যতে তাদের উদ্বুদ্ধ করবে। ডিন এলগার, কুইন্টন ডি ককের শতরান ও অধিনায়ক ফাফ দু প্লেসির দু'টি হাফ-সেঞ্চুরি ছাড়া চোখে পড়ার মতো কিছুই ছিল না। কী বোলিং, কী ব্যাটিং। দক্ষিণ আফ্রিকাকে পর্যুদস্ত করে ভারত টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে নিজেদের জমি যথেষ্ট শক্ত করে নিল।
ভারতে যারা খেলতে আসে তারা প্রায়শই স্পিনিং উইকেটের দোহাই দেয়। কিন্তু ভাইজাগ ও পুনের উইকেটে প্রথম থেকেই যে ঘূর্ণীর মতো বল ঘুরেছে, তা বলা যাবে না। ভারত দুই টেস্টেই রানের পাহাড় গড়ে। দুর্দান্ত বোলিং করে দক্ষিণ আফ্রিকাকে কাবু করে তারা। দুই টেস্টে ভারতের পেস বোলাররাই ১০টির ওপর উইকেট নিয়ে প্রমাণ করেছেন যে, দক্ষিণ আফ্রিকা পেস অথবা স্পিন, কোনও ক্ষেত্রেই স্বচ্ছন্দ ছিল না।
আরও পড়ুন: ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো সহজে লড়াই ছাড়বে না দক্ষিণ আফ্রিকা
ময়াঙ্ক আগরওয়াল প্রথম টেস্টে দ্বি-শতরানের পর আবার অনবদ্য শতরান করলেন। ময়াঙ্ক সম্পর্কে একটা ছোট গল্প বলি। দু-তিন বছর আগে ময়াঙ্ক যখন কর্ণাটকের হয়ে খেলছিলেন, তখন তাঁর ব্যাটে রানের খরা চলছিল। অধিনায়ক বিনয় কুমার টিম লিস্টে চোখ বুলিয়ে দেখেন যে, ময়াঙ্ক দলে নেই। কী মনে হলো কর্ণাটকের অত্যন্ত সফল অধিনায়কের, তিনি ময়াঙ্ককে বললেন, তোমাকে আরেকটা সুযোগ দিচ্ছি, নিজেকে প্রমাণ করো। বলাই বাহুল্য, সেই ম্যাচে ময়াঙ্ক শতরান করেন। এরপর রানের বন্যা বইয়ে দেন ব্যাটে। এরপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি ময়াঙ্ককে।
সিরিজে বিরাট ফের একবার বিরাটোচিত ইনিংস খেললেন। তাঁর অধিনায়কত্বে ৫০ তম টেস্ট খেলল ভারত। তারই সঙ্গে ছাপিয়ে গেলেন স্যার ডন ব্র্যাডম্যানকে। এই নিয়ে ন'বার টপকে গেলেন ১৫০ রানের গণ্ডী। বিরাটের ২৬টি শতরান এল ১৩৮টি ইনিংসে। যা তাঁর আইডল তেন্ডুলকরের থেকে মোটে দু'টি ইনিংস বেশি। স্যার ডন নিয়েছিলেন ৬৯টি ইনিংস। আর ঠিক তারপরেই স্মিথ। তাঁর লেগেছিল ১২১টি ইনিংস। কোহলি এরই মধ্যে জীবনের সপ্তম দ্বি-শতরান করে ফেলেলন। এভাবে চললে বিরাট সম্ভবত সব ব্যাটিং রেকর্ডই ভেঙে দেবেন একদিন। দু'টি রেকর্ড বোধ হয় তাঁর অধরা থেকে যাবে। স্যার ডনের ৯৯.৯৯-এর ব্যাটিং গড় ও শচীনের ২০০টি টেস্ট খেলার নজির।
আরও পড়ুন: ক্রিকেটে আর ‘আম্পায়ার্স কল’ রাখার অর্থ কী?
সৌরভের নাম যখন শুরুতে উঠল, তখন আরেক বাঙালির নাম উল্লেখ করতেই হবে। তিনি অভিজিৎ বিনায়ক ব্যানার্জি। তিনি ও তাঁর স্ত্রী এস্থার ডাফলো এবং হার্ভাডের মাইকেল ক্রেমার নোবেল পাচ্ছেন। 'সারা পৃথিবীর দরিদ্রতা'কে উপশম করার লক্ষ্যে কীভাবে এগোতে হবে, তারই গবেষণার জন্য অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পাচ্ছেন অমর্ত্য সেনের পর দ্বিতীয় বঙ্গসন্তান।
এই সপ্তাহটা বাঙালিদের জন্য তাই সত্যিই গর্বের। সৌরভ ও অভিজিৎরা এত বাধা বিপত্তির মধ্যেও আমাদের শুধু উৎফুল্ল, উৎসাহিত করে উত্তরণের পথই দেখালেন না, ঘন কালো অন্ধকারের পর যেন নতুন আলোর দিশা দেখালেন।