মে মাসের ৬ তারিখে নিজের বেহালার বাড়িতে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় আপ্যায়ন করলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ-কে। তবে ডিনার টেবিলে মিষ্টি দইয়েই মেন্যু খতম হয়নি। ঠিক তাঁর একদিন পরেই সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে বেসরকারি হাসপাতালের এক অনুষ্ঠান মঞ্চে দেখা গিয়েছিল তৃণমূলের মন্ত্রী এবং কলকাতা মেয়র ফিরহাদ হাকিমের সঙ্গে।
অমিত শাহের সঙ্গে শাহী-ভোজের আগে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় সাংবাদিকদের বলেন, "ওঁর সঙ্গে আমার ২০০৮ থেকে পরিচয়। খেলার সময়ে ওঁর সঙ্গে প্রায়ই সাক্ষাৎ হত। এর থেকে বেশি কিছু নয়।" হাসপাতালের অনুষ্ঠান মঞ্চে সৌরভ আরও বলেন, "আমি ফিরহাদ হাকিমের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। প্ৰথম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকে উনি আমাকে দেখে আসছেন। উনি আমাদের পারিবারিক বন্ধু। অনেকেই ওঁর সঙ্গে সাহায্যের জন্য যোগাযোগ করেন। আমিও বেশ কয়েকবার ওঁকে ফোন করেছি।"
সৌরভের গলায় জমানো থাকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অফুরান প্রশংসাও, "আমাদের সম্মানীয় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য ওঁর সাহায্য প্রার্থনা করেছিলাম।"
আরও পড়ুন: মৃত্যুতে অবসান সব শত্রুতার! মাঙ্কিগেট কেলেঙ্কারি সরিয়ে সাইমন্ডসের প্রয়াণে ‘কান্না’ ভাজ্জিরও
প্রশ্ন উঠছে, বিসিসিআই সভাপতি কি রাজনীতির সঙ্গে ফ্লার্ট করছেন? গত বছর।বিধানসভা ভোটের সময় রটেই গিয়েছিল বিজেপির টিকিট প্রার্থী হচ্ছেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রীর পদপ্রার্থী হিসাবেও নাকি তাঁকে তুলে ধরা হবে। বলা হচ্ছিল রাজ্যে বিজেপির মুখ্যমন্ত্রীতুল্য ফেস নেই। তাই সৌরভের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রাখছিলেন বিজেপির নেতারা। তবে সেই সময় মহাতারকা আচমকা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে যাওয়ায় বেশিদূর জল গড়ায়নি।
সেই সময় সৌরভের হৃদরোগে র জন্য বিজেপির চাপের রাজনীতিকে প্রকাশ্যে দুষেছিলেন বাম নেতা অশোক ভট্টাচার্য। বলে দিয়েছিলেন, "অনেকেই সৌরভকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে চাইছে। এতেই হয়ত ওঁর ওপর মানসিক চাপ হয়ে যাচ্ছিল। ও মোটেই রাজনীতির লোক নয়। ক্রীড়াক্ষেত্রের আইকন হিসেবেই ওঁকে মনে রাখা উচিত। আমরা বলেছি, সৌরভের ওপর যেন অনাবশ্যক না চাপ দেওয়া হয়। সৌরভকে বলেছি, ও যেন রাজনীতিতে না যোগ দেয়। ও অস্বীকার করেনি।"
আরও পড়ুন: ক্রিকেট বিশ্বে শনির ছায়া! পরপর মৃত্যু চার ক্রিকেটারের, রয়েছেন এক ভারতীয়ও
সৌরভ রাজনীতির সঙ্গে নিজের দূরত্ব কৌশলে বজায় রেখেছিলেন সযত্নে। এবার অবশ্য জল্পনা সৌরভ অথবা সৌরভের স্ত্রী ডোনা রাজ্যসভায় যেতে পারেন।
তারকা-বুভুক্ষু রাজ্য। সেই রাজ্যেই ঈশ্বর-তুল্য হয়েছেন বিরেন রায় রোডের বাসিন্দা। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের দেড় দশক কেটে গেলেও এখনও সৌরভের ক্রেজ একফোঁটাও কমেনি। আর সৌরভের গগনচুম্বী জনপ্রিয়তা কাজে লাগাতে মরিয়া সমস্ত রাজনৈতিক দলই।
একসময় সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নয়নের মনি। ২০০৮-এ বামেদের সুরে সুর মিলিয়ে সৌরভ টাটা গ্রুপকে আর্জি জানিয়েছিলেন যেন ন্যানো তৈরির কারখানা রাজ্য থেকে না সরানো হয়। সেই সময় যে দর্শনের প্রবল বিরোধী ছিলেন তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন: বড় বিতর্কে দগ্ধ কেকেআর-হায়দরাবাদ ম্যাচ! রিভিউ নিয়েও পেলেন না রিঙ্কু, দেখুন ভিডিও
২০১৫-য় জগমোহন ডালমিয়ার মৃত্যুর পরে মমতা।বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ঐতিহাসিক সাক্ষাৎ হয় সৌরভের। এই সিএসবি সভাপতি হিসেবে সৌরভের নাম ঘোষিত হয় স্টেট সেক্রেটারিয়েট থেকে। এখনও জল্পনা চলে, ২০১৯-এ বোর্ড নির্বাচনের আগে অমিত শাহের সঙ্গে সাক্ষাৎকার বিসিসিআইয়ের মসনদে পৌঁছে দিয়েছিল বাংলার মহারাজকে।
শুধু সৌরভই নন, ক্রিকেট জগৎ এবং রাজনীতি বরাবর করমর্দন করার দূরত্ব থেকে পরস্পরের পাশে দাঁড়িয়েছে ঐতিহাসিকভাবে। যেভাবে শরদ পাওয়ার, এনকেপি সালভে, অনুরাগ ঠাকুররা বোর্ডের সিংহাসনে। এই রাজনীতি সংস্রব থেকে বহুবার ভারতীয় ক্রিকেটও উপকৃত হয়েছে। বর্তমান বোর্ডের প্রশাসনে রাজনৈতিক ছোঁয়াচ অনেকটাই স্পষ্ট।
২০০১-এ বোর্ড নির্বাচনে জগমোহন ডালমিয়া সেই সময়ের আসাম মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল মহান্তের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার জেরে বাজিমাত করেন এসি মুথাইয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে। মুথাইয়ার সঙ্গে শরদ পাওয়ারের সমর্থন ছিল। তবে প্রফুল্ল মহান্তের সঙ্গেই ডালমিয়ার সঙ্গে অদৃশ্য সমর্থনের ডালি নিয়ে হাজির ছিলেন তৎকালীন এক শক্তিশালী মন্ত্রী। যিনি পরে পথ দুর্ঘটনায় মারা যান।
আরও পড়ুন: ম্যাককালামের বিদায়! এই পাঁচ তারকা KKR-এর পরবর্তী কোচ হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে
সৌরভ রাজনীতির ছোঁয়াচ যেভাবে সযত্নে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে চলছেন তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলের ব্যাখ্যা তিনি মোটেই রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার ঝুঁকি নেবেন না। সৌরভ ঘনিষ্ঠ একজন বলছেন, "উনি কলকাতার প্রিন্স। মনে হয়না, কোনও রাজনৈতিক দলে যোগ দিয়ে নিজের বিশাল ফ্যানবেস ভাগাভাগি করবেন। সমস্ত রাজনৈতিক দলের শীর্ষনেতাদের সঙ্গেই ওঁর যোগাযোগ রয়েছে। এভাবেই উনি থাকতে চান।"
অমিত শাহ-পুত্র জয় শাহ বোর্ডে সৌরভের সহকর্মী। ভারতীয় বোর্ডের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক প্রধান হিসাবে রাজনৈতিক যোগাযোগ তাঁকে রাখতেই হবে। তবে ভবিষ্যতে মহারাজকে কোনও রাজনৈতিক ময়দানে দেখা যায় কিনা, তা সময়ই বলবে।