Advertisment

ফিরে দেখা ২২ জুন: লর্ডসে সৌরভের হাত ধরে ঘুরে দাঁড়াল বাংলার ক্রিকেট

বাঙালি মানেই নরমসরম, মুম্বইকরদের মতো 'খাড়ুস' নয়, বাঙালি মানেই 'ভাগতা হ্যায়', এই ধারণাকে টেমসের জলে আছড়ে ফেলেছিল ২২ জুনের ওই ১৩১

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
sourav ganguly lords century

শরীরী ভাষায় কোনও বাড়তি উত্তেজনা নয়, ধরা পড়ছে প্রত্যয় এবং সংকল্পের যুগলবন্দি। ছবি সৌজন্য: টুইটার/আইসিসি

'গাঙ্গুলি অন নাইনটি-সেভেন, জাস্ট থ্রি শর্ট অফ আ মোস্ট মেমোরেবল ডেবিউ হান্ড্রেড অ্যাট লর্ডস..।'

Advertisment

বছর চব্বিশ বছর আগের এই দিনে, ২২ জুনের সেই দুপুরে কমেন্ট্রি বক্সে বসে যখন কথাগুলো বলছেন রবি শাস্ত্রী, লর্ডসের বিখ্যাত ব্যালকনিতে যখন এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় গোটা ইন্ডিয়ান টিম, সারা বাংলার চোখ তখন টিভি সেটে চুইংগামের মতো আটকে। মরিয়া প্রার্থনা এবং দমবন্ধ প্রতীক্ষা... পারবে তো? আর তো মোটে তিনটে রান... হবে তো?

হয়েছিল। পেরেছিলেন ২২ বছরের বঙ্গসন্তান। ডমিনিক কর্কের বলটা পড়ল অফস্টাম্পের বাইরে গুডলেংথে। ব্যাটসম্যানের পা এগোলো বলের লাইনে, বেরলো মখমল-মসৃণ অফড্রাইভ, এবং ঘাসে শিষ কেটে বল নিমেষে পৌঁছল বাউন্ডারিতে। স্কোরবোর্ডে যখন ফুটে উঠছে, সৌরভ গাঙ্গুলি নট আউট ১০১,সেই টেস্টের আরেক অভিষেককারী, নন-স্ট্রাইকার রাহুল দ্রাবিড় যখন এগিয়ে আসছেন হাত মেলাতে, তার আগেই হেলমেট খুলে ফেলেছেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। ব্যাট তুলে ধরেছেন উপরে। শরীরী ভাষায় কোনও বাড়তি উত্তেজনা নয়, ধরা পড়ছে প্রত্যয় এবং সংকল্পের যুগলবন্দি। ক্রিকেটের মক্কা লর্ডসের গ্যালারিতে তখন মুগ্ধতার অভিবাদন। আর টিমমেটদের হাততালির হুল্লোড় ব্যালকনিতে। সেই ব্যালকনি, আরও ছয় বছর পরে যেখানে দাঁড়িয়ে টিমের ন্যাটওয়েস্ট ট্রফি জয়ে জার্সি খুলে বেনজির উল্লাসে ফেটে পড়বেন ক্যাপ্টেন গাঙ্গুলি!

এ লেখা স্রেফ সৌরভের অভিষেক সেঞ্চুরি নিয়ে শব্দ খরচ নয়। লর্ডসের ওই স্মরণীয় ইনিংস কী পরিস্থিতিতে এসেছিল, ক্রিকেটপ্রেমী মাত্রেই জানেন। জানেন, ১৯৯৬-এ ভারতের ইংল্যান্ড সফরে ক্যাপ্টেন আজহারউদ্দিনের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে সিরিজের মাঝপথে নভজ্যোত সিং সিধু দেশে ফিরে না এলে লর্ডসের দ্বিতীয় টেস্টে প্রথম এগারোয় হয়তো জায়গাই হতো না বেহালার বীরেন রায় রোডের বাঙালির। সিধু থেকে গেলে হয়তো পুরো সিরিজেই রিজার্ভে থাকতে হতো সৌরভকে, হয়তো টেস্ট-অভিষেকের জন্য ফের শুরু হত অনন্ত অপেক্ষা।

প্রথম ইনিংসে ইংল্যান্ডের ৩৪৪-এর জবাবে নয়ন মোঙ্গিয়া-বিক্রম রাঠোরের ওপেনিং জুটি ২৫ রানে ভেঙে যাওয়ার পর সবাইকে অবাক করে আজহার তিনে ব্যাট করতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সৌরভকে। ব্যাটিং লাইন-আপে শচীন-দ্রাবিড় এবং আজহার স্বয়ং থাকা সত্ত্বেও। এবং লর্ডসের চিরাচরিত খামখেয়ালি আবহাওয়ায় ক্রিস লুইস-ডমিনিক কর্ক-পিটার মার্টিন-অ্যালান মুলালির পেস-সিম-সুইংকে কী অনায়াস আধিপত্যে সামলেছিলেন সৌরভ, অফসাইডে প্রতিটা শটে কী অবলীলায় যে লেখা ছিল লাবণ্যের ঠিকানা, সে তো চাইলেই দেখা যায় ইউটিউবে।

লর্ডস-উত্তর বছরগুলোয় কীভাবে এগিয়েছিল ব্যাটসম্যান এবং ক্যাপ্টেন গাঙ্গুলির কেরিয়ার, লর্ডসের পরে হেডিংলে টেস্টেও কী রাজকীয় ভঙ্গিতে ফের এসেছিল তিন অঙ্কের রান, কীভাবে ভারতের চিরকালীন গ্রেটদের অন্যতম হিসেবে নিজেকে অধিষ্ঠিত করেছিলেন হাজারো ঝড়-ঝাপটা সামলে, সে-ই বা আর কার অজানা?

এ লেখা স্রেফ ওই ইনিংস নিয়ে নয়। কারণ, লর্ডসের ওই সেঞ্চুরি শুধুমাত্র ব্যক্তি সৌরভের কেরিয়ারের মাইলফলক নয়। বৃহত্তর বিচারে ওই ইনিংস আসলে ভারতীয় ক্রিকেটে বঙ্গজ নবজাগরণের প্রতীক। দেশের ক্রিকেট-সংসারে বাংলার যে চিরন্তন দুয়োরানীর অবস্থান, তা থেকে সুয়োরানীতে উত্তরণের প্রামাণ্য দিকচিহ্ন হল কুড়িটা বাউন্ডারিতে সাজানো সেদিনের ওই দাপুটে ১৩১। সংখ্যায় ১৩১, কিন্তু জাতীয় প্রেক্ষিতে বঙ্গক্রিকেটের প্রভাবের নিরিখে বিচার করলে ওটা সেঞ্চুরি নয়, ট্রিপল সেঞ্চুরি। স্কোরকার্ড বলবে ১৩১, আসলে ৩৩১। নেভিল কার্ডাস কী আর সাধে লিখে গিয়েছেন, স্কোরবোর্ড আসলে একটা গাধা!

আরও পড়ুন: ফিরে দেখা ‘৮৩-র ১৮ জুন: কপিলের সেই অতিমানবিক ১৭৫

ভারতীয় ক্রিকেটে আবহমান কাল ধরেই দুটো আঞ্চলিক লবি নিরঙ্কুশ রাজত্ব করে এসেছে। কখনও মুম্বই, কখনও হায়দ্রাবাদ-কর্ণাটক-তামিলনাড়ু। আরও স্পষ্ট করে বললে, কখনও পশ্চিমাঞ্চল, কখনও দক্ষিণ। এই দ্বিমুখী দাপটে কখনও কল্কেই পায়নি বাংলার ক্রিকেট, বাঙালির ক্রিকেট। সেই পাঁচের দশকে ভারতীয় দলে নিয়মিত ছিলেন পঙ্কজ রায়। তারপরের চার দশক ধরে বঙ্গক্রিকেটে শুধুই 'ব্রাত্যজনের ক্রুদ্ধসঙ্গীত'।

জাতীয় স্তরে বাঙালি ক্রিকেটারদের প্রতি বৈষম্য আর বঞ্চনার ইতিহাস পড়তে পড়তে, শুনতে শুনতে আমরা বড় হয়েছি। বঞ্চিতদের নামগুলো বদলে গেছে মাত্র। কখনও সম্বরণ,ব্যানার্জি, কখনও গোপাল বসু। কখনও বরুণ বর্মণ, কখনও উৎপল চ্যাটার্জি। লবিবাজির শিকার হয়ে যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও এঁদের কীভাবে জাতীয় দলে জায়গা করে নিতে দেওয়া হয়নি, শুনেই গেছি, পড়েই গেছি শুধু। এবং বাঙালি ফুটবলটা পারে, ক্রিকেটটা বাঙালির জন্য নয়, বাকি দেশের এই ধারণাটা আমাদের অবচেতনেও শিকড় গেড়ে বসেছিল একপ্রকার বাধ্যতই।

হীনমন্যতার এই শিকড়কেই হ্যাঁচকা টানে উপড়ে ফেলেছিল সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের লর্ডসের সেঞ্চুরি। বাঙালি মানেই নরমসরম, মুম্বইকরদের মতো 'খাড়ুস' নয়, বাঙালি মানেই 'ভাগতা হ্যায়', এই ধারণাকে টেমসের জলে আছড়ে ফেলেছিল ২২ জুনের ওই ১৩১। এ ছেলে অন্য ধাতের, বুঝে গিয়েছিল দেশের এবং বিদেশের ক্রিকেটজগৎ। শুধু কি ইংল্যান্ড বোলিংয়ের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছিল সৌরভকে? প্রতিপক্ষ আরও ছিল। ব্রিটিশ মিডিয়া তো বটেই, বাংলার বাইরে দেশের ইংরেজি-হিন্দি মিডিয়াতেও সৌরভকে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল 'কোটার প্লেয়ার' হিসাবে। বাবা চণ্ডী গাঙ্গুলি সিএবি-র বড়কর্তা, বিসিসিআই-তে প্রভাব খাটিয়ে ছেলেকে টিমে ঢুকিয়েছেন, এটা দিনের পর দিন লিখে গিয়েছিল কাগজগুলো।

১৯৯২-এ আঠারো বছর বয়সে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে একদিনের ক্রিকেটে আন্তর্জাতিক অভিষেক হয়েছিল সৌরভের। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে একটা ম্যাচ খেলেছিলেন। করেছিলেন তিন রান। মিডিয়ায় স্টোরি হয়েছিল, সৌরভ নাকি সফরের কোনও একটা ম্যাচে টুয়েল্ভথ ম্যান হিসাবে জল বইতে অস্বীকার করেছিলেন। 'বড়লোক বাপের বখাটে ছেলে' তকমা লেগে গিয়েছিল আঠারোর সৌরভের গায়ে। তার চার বছর পরে সেই তকমা সঙ্গে নিয়েই লর্ডসে পা রেখেছিলেন সৌরভ।

টিম ম্যানেজমেন্টের বিরূপ মনোভাবও গোপন ছিল না। ইউটিউবে সৌরভের লর্ডস-সেঞ্চুরির একটা তেরো মিনিটের ভিডিও আছে। দেখবেন, সৌরভ যখন পঞ্চাশে পৌঁছে ব্যাট তুলছেন, ক্যামেরা ঝলকে ধরেছিল লর্ডসের ব্যালকনিতে টিমমেটদের। সবাই হাততালি দিচ্ছেন দাঁড়িয়ে উঠে। কোচ সন্দীপ পাতিলও হাততালি দিচ্ছেন মাঝখানের চেয়ারে বসে। পাতিলের মুখটা ছিল দেখার মতো। নিষ্প্রাণ, হাসি নেই, যেন কেউ ব্লটিং পেপার দিয়ে সমস্ত রক্ত শুষে নিয়েছে মুখের। পাতিল তো বটেই, কেউই কি ভেবেছিলেন, এভাবেও ফিরে আসা যায়?

দিনের শেষের প্রথাগত প্রেস কনফারেন্সে সৌরভকে এক দক্ষিণী সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, "নিজের সমালোচকদের ভুল প্রমাণ করতে পেরে কেমন লাগছে?" সপ্রতিভ উত্তর এসেছিল, "আমার নিজের কাছে নিজেকে প্রমাণ করার ছিল যে আমি এই পর্যায়ের ক্রিকেটের যোগ্য।"

সৌরভ বলেছিলেন, 'আমি'। আসলে বলতে চেয়েছিলেন ,'আমরা'। একবচন নয়, বহুবচন। 'আমরাও পারি', এই ধারণাটা বাংলার ক্রিকেটে জলবাতাস পেতে শুরু করেছিল ওই সেঞ্চুরির হাত ধরেই। "আমার ছেলেকে সৌরভের মতো করে দিন"-এর আর্জি জানিয়ে রাজ্যের আনাচেকানাচে রাতারাতি গজিয়ে ওঠা বিভিন্ন ক্রিকেট কোচিং ক্যাম্পে হত্যে দিতে শুরু করেছিলেন মা-বাবারা। 'সৌরভ' হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বাঁচতে দৌড় শুরু করেছিল কত যে কচিকাঁচা!

সবাই সৌরভ গাঙ্গুলি হয় না। সৌরভ একটাই হয়। এমন নয়, সৌরভের পরে গুচ্ছ গুচ্ছ বাঙালি ক্রিকেটার দেশের হয়ে নিয়মিত খেলেছেন বা খেলছেন। ব্যতিক্রম বলতে ঋদ্ধিমান সাহা, যিনি এখন দেশের সেরা কিপার এবং ৩৭ টা টেস্ট খেলা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু বাংলার ক্রিকেটার মানেই অচ্ছুৎ, বড়জোর ইরানি ট্রফি খেলবে, এই মনোভঙ্গির মৃত্যু ঘটে গেছে দেশের ক্রিকেটমননে। আর সেটার বীজ বপন হয়েছিল লর্ডসে সৌরভের ওই সেঞ্চুরির হাত ধরেই।

নবজাগরণ ছাড়া কী! সৌরভের সেই সেঞ্চুরিতেই তো সূর্যোদয়।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

Advertisment