আজ স্বপ্না বর্মণের যাবতীয় কৃতিত্বের নেপথ্যে রয়ে গিয়েছেন একটাই মানুষ। তিনি সপ্নার কোচ সুভাষ সরকার। স্বপ্নার জীবনে মেরুদণ্ডের মতো তিনি। শিষ্য়ার শারীরিক গঠন ও চোট প্রবণতা নিয়ে গুরুর মনেও সংশয়ের কালো মেঘ জমেছে মাঝেমধ্যে। কিন্ত সুভাষ জানতেন যে, স্বপ্না শুধুমাত্র মনের জোরেই ঝকঝকে রোদের মতো ধরা দেবে অ্যাথলেটিক্সের আকাশে। সুভাষের ভবিতব্য মিলি গিয়েছে অক্ষরে অক্ষরে। আজ তাঁর কন্যাসম ছাত্রীই দেশের প্রথম ভারতীয় হিসেবে এশিয়ান গেমসে হেপ্টাথলনে সোনা জিতে ইতিহাস লিখেছিলেন।
আজকের কথা নয়, স্বপ্নাকে ২০১১ সালে স্পট করেছিলেন সুভাষ। স্বপ্না থাকেন জলপাইগুড়িতে। এখানেই বছরে একবার করে আসতেন সুভাষ। দুর্গা পুজোর সময় যেতেন তিনি। ওখানেই স্থানীয় একটা মাঠে স্বপ্নার সঙ্গে আরও অনেকেই প্র্যাকটিস করতেন। সুভাষের কাছে আবদার এসেছিল স্বপ্নার দিকে একটু নজর দেওয়ার জন্য়। সেসময় স্বপ্নার আর পাঁচটা মেয়ের থেকে একটু ভালই লাফাতে পারতেন। সেই ১৯৯৮ থেকে সল্টলেক সাই-এর সঙ্গে যুক্ত সুভাষ। স্বপ্নাকে প্রথম দেখে তাঁর মোটেই মনে ধরেনি। সুভাষ বললেন, “ একেবারেই আন্তর্জাতিক মানের অ্যাথলিটদের মতো ওর চেহারা ছিল না। উচ্চতাও ছিল অনেকটা কম। তারওপর মোটার দিকেই গড়ন ছিল। থাইতেও প্রচণ্ড ফ্যাট ছিল। আমি সোমার (সোমা বিশ্বাস) মতো লম্বা কাউকেই খুঁজছিলাম। কিন্তু পরে দেখলাম ওর শারীরিক গঠনটা কোনও বাধা হবে না। ওর মনের জোর সাংঘাতিক। ও চাইলে অনেক কিছু করতে পারে। আর আমি যদি ওকে জলপাইগুড়ি থেকে শিলিগুড়িতে নিয়ে না-আসতাম, তাহলে ওকেও চা বাগানে কাজ করতে হতো ”
আরও পড়ুন: কলকাতায় বাড়ির বন্দোবস্ত করে দিক রাজ্য সরকার, আবেদন স্বপ্না বর্মণের
ছাত্রীকে নিয়ে কথা বলতে গেলে থামতে পারেন না সুভাষ। বলেই চলেন। সুভাষই বলছেন ছাত্রীর যা ক্ষমতা তাতে তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে, ব্রোঞ্জ নিয়েই ফিরবেন। কিন্তু সোনা জেতার ক্ষমতা রয়েছে শিষ্যার। ৬৩০০-র ওপর পয়েন্ট আনতেও পারে সে। এমনটাই বিশ্বাস ছিল সুভাষের। স্বপ্নার কোচ আরও বললেন যে, এশিয়ান গেমস থেকেই হয়তো কলকাতার বিমান ধরতে হতে পারত তাঁকে। কারণ এশিয়াডের ঠিক আগে আগেই চোট আঘাতে রীতিমতো কাবু হয়ে গিয়েছিলেন স্বপ্না। এমনকি ফেডারেশনও সংশয় প্রকাশ করেছিল স্বপ্নাকে সুবজ সংকেত দেওয়ার জন্য। সুভাষ জানালেন, এশিয়াডের আগে চোট-আঘাতই শেষ করে দিয়েছিল। চিকিৎসার জন্যই ছুটেছি পাতিয়ালা থেকে দিল্লি। কখনও অ্যাপেন্ডিক্স, তো কখনও হ্যামস্ট্রিং, আবার এশিয়াডের ঠিক আগে আগে হাঁটু। এমনকি অনন্ত যোশির মতো ডাক্তার বলেছিলেন অস্ত্রোপচারের জন্য। আমি বলছিলাম সেটা কিছুতেই সম্ভব না। কারণ তখন হাতে বাকি আর দু-তিন সপ্তাহ। আর এর মধ্যে কিছুতেই ঠিক হয়ে ট্র্যাকে ফিরতে পারত না স্বপ্না। তখন আমিই ডাক্তারকে বলি বিকল্প রাস্তার সন্ধান দিতে। এশিয়াডের জন্য স্বপ্নার ভরসা পেনকিলার আর ইনজেকশনই ছিল। কারণ অস্ত্রোপচার করাতেই হতো।” ২০১৯ পর্যন্ত স্বপ্নার জন্য কোনও বড় টুর্নামেন্টের কথা ভাবছেন না সুভাষ। প্রয়োজন হলে তাঁর অস্ত্রোপচার করাবেন তিনি। আপাতত সুভাষের লক্ষ্য স্বপ্নাকে চোট-আঘাত থেকে দূরে রাখা।
গত ২৯ অগস্ট স্বপ্না এশিয়াডে সোনা পেয়েছিলেন। তাঁর আগের দিন প্র্যাকটিস তো দূরের কথা, স্বপ্না দাঁতের যন্ত্রণায় ঘুমতো পর্যন্ত পারেননি। সুভাষ ওরকম একটা দিনে স্বপ্নাকে বিশ্রামে রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল অফ-সিজন প্র্যাকটিসের দৌলতেই স্বপ্না কামাল করে দিতে পারবে। আর সেটাই হল বাকিটা ইতিহাস। সুভাষ এমনই কোচ যিনি কোনও টার্গেট সেট করে দেননি স্বপ্নাকে। শুধু বলেছেন, উপভোগ করতে। আর স্বপ্না বললেন, “স্যারের সম্বন্ধে যতই বলি না কেন, কম বলা হবে। যতটা প্র্যাকটিস আমি করেছি উনিও ঠিক ততটাই করেছেন।”