৪৮তম ওভারে তৃতীয় বল। এই মুহূর্তটির জন্য ৬৫,০০০ জোড়া চোখ ইডেন গার্ডেনে দিনভর অপেক্ষা করছিল। অবশেষে সেই মুহূর্ত। ব্যাক-ফুট পাঞ্চ দিয়ে, বিরাট কোহলি রান করলেন। যা তাঁকে তাঁর আইডল শচীন তেন্ডুলকারের সঙ্গে একদিনের ক্রিকেটে সমান সংখ্যক সেঞ্চুরি করা ক্রিকেটারের সমান করে তুলল। অভিনয় জগতের শিল্পীরা অত্যন্ত ভালো করে এই বিশেষ মুহূর্তর গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারবেন। বিশেষ করে, যে মুহূর্তে বিরাট তাঁর হেলমেটটি সরালেন, দু'হাত আকাশের দিকে তুললেন, ভেজা বন্ধ চোখ খুলে আকাশের দিকে তাকালেন, যেন এক নীরব প্রার্থনা। আর, তারপর ড্রেসিংরুমের দিকে ব্যাট নাড়লেন এবং কাঁধ ঝাঁকালেন। তার ব্যাটিং সঙ্গী ছিলেন রবীন্দ্র জাদেজা। তাপ, আর্দ্রতা এবং বয়স যেন তাঁকে ক্লান্ত করে তুলেছিল। রবিবার ৩৫ বছর বয়সি ভারতের এই ব্যাটসম্যান, তার মধ্যেই লিখলেন ইতিহাস।
সেঞ্চুরি করা আর মাইলফলক স্পর্শ করাকে বিরাট অনেকদিন ধরেই অভ্যেস করে ফেলেছেন। সেঞ্চুরি হওয়ার নয় বলে পরে, ভারতের ইনিংস শেষে, ঘামে ভিজে তিনি আবেগ প্রকাশ করলেন। বলেন, 'আমার জন্মদিনে এত বিশাল জনতার সামনে রেকর্ড করা, এটা একটা স্বপ্ন'। এই কথাগুলো এল বেশ ধীরে-সুস্থে, যেন সঠিক শব্দের খোঁজে ছিল। সঙ্গে ছিল বিরাটের প্রাণবন্ত হাসি, আর চোখের জল লুকিয়ে ফেলা। জনতার করতালির মধ্যে তিনি বললেন, 'ছোটবেলা থেকেই আমি চাই যে এরকম কিছু ঘটুক। তাই আমি ঈশ্বরের কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ যে এই মুহূর্তগুলো পেয়েছি। ভক্তদের কাছ থেকেও পেয়েছি অনেক ভালোবাসা। আমি যে কোনও উপায়ে দলকে সাহায্য করার চেষ্টা চালিয়ে যাব।' তাঁর এই বক্তব্য আরও নাটকীয় হতে পারত। কোহলি তাঁর জন্মদিনে দেশের সবচেয়ে প্রাচীন ক্রিকেট মাঠের সামনে তার ৪৯তম সেঞ্চুরি করলেন। এই মুহূর্তটির অপেক্ষা অবশ্য অনেক আগেই শুরু হয়েছিল। প্রায় তিন দিন আগে। কিন্তু, তখন মুম্বইয়ে ১২ রানের জন্য সেঞ্চুরি মিস করেছিলেন কোহলি।
শনিবার যখন কোহলি অনুশীলনের জন্য মাঠে এসেছিলেন, কয়েক হাজার লোক প্রবেশদ্বারে তাঁকে দেখার জন্য অপেক্ষা করছিল। রীতিমতো মন্ত্রের কায়দায় উৎসাহের সঙ্গে তাঁর নাম উচ্চারণ করছিল। ম্যাচের দিন, তাঁরা সকালেই ১৮ নম্বর জার্সি এবং 'কোহলির মুখোশ' পরে স্টেডিয়ামে ভিড় করেছিলেন। যখন বিরাট সেই ল্যান্ডমার্কের কাছে পৌঁছন, তাঁদের স্মার্টফোনের ফ্ল্যাশলাইটগুলো জ্বলে উঠেছিল, যা সন্ধ্যার অন্ধকারে চকচকে পোকার মত ঝিকিমিকি করছিল। রবিবার শুধু কোহলিই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেননি। পৃথিবীই যেন তাঁর সঙ্গে চলা শুরু করেছিল এবং চলা শেষ করেছিল। ভক্তদের থেকে টিম ইন্ডিয়ার ১৪ বছরের খেলোয়াড় জীবনে কোহলি এটা অর্জন করেছেন। শচীন তেন্ডুলকরের প্রতিও ভক্তদের ঠিক এমনই আবেগ ছিল। তিনি টি-২০ তে মাস্টার কি না, তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, টেস্ট-এ শচীন তেন্ডুলকারের সমান কি না, তা নিয়েও সন্দেহ আছে। কিন্তু, ৫০ ওভারের খেলায় কোহলিই রাজা। কিং কোহলি উপাধিটি এক্ষেত্রে তার জন্য এক্কেবারে মানানসই। পরিসংখ্যান-ট্রোলিং সেখানে কোনও কাজ করে না। প্রতিটি ছয় ইনিংসে কোহলি একটি করে সেঞ্চুরি করেছেন। আর, তেন্ডুলকরের প্রায় নয়টি ইনিংসে একটি। তেন্ডুলকারও তাঁর শততম সেঞ্চুরির জন্য বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করেছিলেন। আর, কপিল দেব নিজের ৪৩২তম উইকেটের জন্য কয়েক মাস অপেক্ষা করেছিলেন। কোহলির অপেক্ষা কিন্তু, এতদিন চলেনি। বছরের শুরুতে তিনি তাঁর ৪৫তম সেঞ্চুরি করেছিলেন। মাত্র ২০ ইনিংস পর, এবার করলেন ৪৯তম সেঞ্চুরি। যেসব ম্যাচে তিনি সেঞ্চুরি করেছেন, তার মধ্যে ৪০টিতেই ভারত জয় পেয়েছে।
একদিনের ফরম্যাটে কোহলি অনবদ্য। এককথায় এখনও পর্যন্ত বিশ্বসেরা। খুব কমসংখ্যক ব্যাটসম্যান আছেন, যাঁরা একটি লক্ষ্যের পিছু ধাওয়া করতে পারেন। তিনি হিটম্যান হিসেবে কেরিয়ার শুরু করেছিলেন। এখন কতগুলো সেঞ্চুরি করতে পারেন, সেটাই যেন একটা বড় ব্যাপার হয়ে উঠেছে। তিনি ইডেনে বিধ্বংসী ক্রিকেট খেলেননি। কারণটা বিরাট নিজেই পরে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন, 'আমার কাজ ছিল দলের ইনিংসের গতি বজায় রাখা। কিন্তু, ১০ ওভারের পরে উইকেট ধীর গতির হতে শুরু করে। আমার ভূমিকা ছিল ওপেনারদের আউট হয়ে যাওয়ার পর গোটা ইনিসটা খেলে যাওয়া।' এমন কিছু স্ট্রোক আছে, যা অনেকেরই দক্ষতার বাইরে, কিন্তু কোহলির মতো সিঙ্গেল নেওয়া আর, প্রতিটি রান নেওয়ার নৈপুণ্যকে কেউ গ্ল্যামারাইজ করতে পারেননি। যখন আর্দ্রতা তাঁর প্রতিটি শক্তিকণা শুষে নিচ্ছিল, তখনও কোহলি দৌড়চ্ছিলেন। দর্শকরা সিঙ্গেল নেওয়ার জন্য প্রায় কোনওদিনই তাঁকে হাঁটতে দেখেননি।
তাঁর সেঞ্চুরির পথে, কোহলি বেশ কয়েকটি ভালো স্ট্রোক নিয়েছেন। যার মধ্যে একটি হল অতিরিক্ত কভার-ড্রাইভ। এছাড়া কাগিসো রাবাদার বলে একটি রাজকীয় স্ট্রেইট ড্রাইভ মেরেছেন। সব মিলিয়ে, তাঁর রেকর্ডতুল্য ৪৯তম শতরান রীতিমতো টানটান উত্তেজনায় পূর্ণ ছিল। ইডেনের ৬৫ হাজার দর্শকের চোখে যা ছিল ইতিহাস। যেটা তাঁরা স্মার্টফোন বন্দি করেছেন। আর, যাঁরা মাঠে আসেননি। টেলিভিশন সেটে অনুভব করেছেন সেই অনবদ্য মুহূর্তটি।