দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে সিরিজ হারের কয়েক ঘন্টার মধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন। নিউল্যান্ডস ড্রেসিংরুমে সতীর্থদের সঙ্গে টিম মিটিং ডেকেছিলেন কোহলি। সেই বৈঠকেই তিনি আচমকা সবাইকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, টেস্টেও অধিনায়কত্ব থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন তিনি। হঠাৎ এমন ঘোষণায় হচকচিয়ে পড়েন সকলে।
এমন ঘোষণা করে সতীর্থ এবং সাপোর্ট স্টাফদের এই খবরের গোপনীয়তা রক্ষা করার অনুরোধও করেন। "ড্রেসিংরুমের বাইরে যেন এই খবর না বেরোয়। সকলের কাছে এটুকুই চাওয়া।" বলেছিলেন কোহলি।
ড্রেসিংরুম পর্বের ২৪ ঘন্টা করে কোহলির টুইটারে ভেসে ওঠে সেই মেগা ঘোষণা, "সাত বছরের কঠোর পরিশ্রম, অধ্যাবসায়, অক্লান্ত প্রচেষ্টা- সমস্ত কিছুর কোনও না কোনও শেষ থাকে। টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে এখানেই সমাপ্ত করলাম।"
আরও পড়ুন: বিশ্বাস রাখার জন্য ধন্যবাদ… নেতৃত্ব ছেড়ে ধোনিতে আবেগী কোহলি, নুইলেন কৃতজ্ঞতায়
আপাতত টিম ইন্ডিয়ার ক্যাপ্টেন কোহলি অতীত হয়ে গেলেন। এর আগে টি২০-র নেতৃত্ব ছাড়ার পরে কোহলিকে ওয়ানডের নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
কোহলি জানিয়েছেন, "গোটা যাত্রাপথে অজস্র উত্থান-পতনের সাক্ষী থেকেছি। তবে কখনই প্রচেষ্টা অথবা বিশ্বাসের খামতি থাকেনি। যা কিছুই করেছি, সবসময় নিজের ১২০ শতাংশ দেওয়ার চেষ্টা করেছি। এবং যখন সেটা উপলব্ধি করতে পারি, সেটা করা থেকে বিরত থেকেছি। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে হৃদয়ের দিক থেকে পুরোপুরি পরিষ্কার আমি। দলের প্রতি কখনই অসৎ হতে পারব না।"
আরও পড়ুন: কোহলি নেতৃত্ব ছাড়ার পরেই BCCI-এর বার্তা, মুখ খুললেন জয় শাহ-ও
আসলে টিম ইন্ডিয়ায় ধীরে ধীরে কোহলি জমানা যে খতম হয়ে আসছে, তা আগাম আঁচ পেয়েছিলেন নিজেই। রোহিত শর্মার ওয়ানডের নেতৃত্ব, টেস্টে সহ অধিনায়কত্ব প্রাপ্তির সেই ইঙ্গিতেরই পরিচয় বহন করে। দক্ষিণ আফ্রিকায় যাওয়ার আগে কোহলি সরাসরি বোর্ড সভাপতির বক্তব্য প্রকাশ্যে খন্ডন করেন। পরে প্রধান নির্বাচক চেতন শর্মা সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের বক্তব্যের সঙ্গেই সহমত হন। এছাড়া টিম ইন্ডিয়া থেকে রবি শাস্ত্রীর বিদায়ে কার্যত একলা হয়ে পড়েছিলেন কিং কোহলি। যিনি ছিলেন দলে তাঁর মস্ত বড় সমর্থক।
এমন প্রতিকূল আবহে কোহলির ব্যাটে দীর্ঘদিন রান নেই। দু বছর শতরান ছাড়াই টিম ইন্ডিয়ায় খেলে চলেছেন। প্রোটিয়াজ সফরে তৃতীয় টেস্টের প্ৰথম ইনিংসে চোয়ালচাপা ৭৯ করলেও তাঁকে বাকি ইনিংসে ভুগিয়েছে অফফর্ম। এই নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শেষ ৩০ ইনিংসে একটাও সেঞ্চুরি নেই তাঁর।
টি২০-র নেতৃত্ব ছাড়ার ঘোষণায় কোহলি জানিয়ে ছিলেন, ওয়ার্কলোড ম্যানেজমেন্টের কারণে অধিনায়কত্ব থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন। তবে শনিবাসরীয় ঘোষণার পিছনে কোনও কারণ খোলসা করেননি তিনি। সাত বছর টেস্ট দলের নেতৃত্ব দেওয়ায় শনিবার ইতি টেনেছেন কোহলি। ৬৮ টেস্টে নেতৃত্ব দিয়ে ৪০ জয় সমেত কোহলিই টিম ইন্ডিয়ার সফলতম অধিনায়ক।
আরও পড়ুন: টেস্টেও নেতৃত্ব ছাড়লেন কোহলি! শনিবাসরীয় মেগা সিদ্ধান্তে ঝড় তুললেন সুপারস্টার
অধিনায়কত্ব থাকাকালীন অস্ট্রেলিয়ায় দুবার টেস্ট সিরিজে জয় পেয়েছেন। ২০১৪/১৫-য় অস্ট্রেলিয়া সফরে ধোনি আচমকাই নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ান। অজিদের বিরুদ্ধে টেস্ট দলের নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে কোহলির।
এরপরে ২০১৭-য় ধোনির কাছ থেকেই সীমিত ওভারের নেতৃত্বের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তিনি। কোহলির নেতৃত্বে ভারতীয় দল দেশে-বিদেশে অপ্রতিরোধ্য শক্তি হয়ে উঠেছিল। কোহলির টিম ইন্ডিয়া দীর্ঘদিন টেস্টের ক্রমপর্যায়ে একনম্বর স্থান ধরে রেখেছিল। ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের প্ৰথমবারের ফাইনালেও ভারত পৌঁছয়।
কেপটাউনে ২৪ ঘন্টা আগেই হার হজম করেছে টিম ইন্ডিয়া। টেস্টে অধিনায়ক হিসাবে এটাই কোহলির শেষ স্টেশন হয়ে থাকল। দীর্ঘ ক্রিকেট কেরিয়ারের মত শেষ টেস্টেও কোহলিকে তাড়া করেছে বিতর্ক। ডিন এলগারের ডিআরএস নিয়মে বেঁচে যাওয়া নিয়ে বেনজিরভাবে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন স্ট্যাম্প মাইকে। প্যাশনের সঙ্গে আবেগের সঙ্গে জাতীয় দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তবে অতি আগ্রাসন, অতিরিক্ত আবেগের বহিঃপ্রকাশ কোহলিকে বারেবারেই বিতর্কিত চরিত্র হিসাবে তুলে ধরেছে ক্রিকেট মহলে।
কোহলি বর্তমান বোর্ড সভাপতি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের আগে ঝামেলায় জড়িয়েছিলেন স্বয়ং অনিল কুম্বলের সঙ্গেও। আর কুম্বলে বিদায়ের পরেই টিম ইন্ডিয়ার কোচের কুর্সিতে আগমন ঘটে রবি শাস্ত্রীর। নেতৃত্ব ত্যাগের ঘোষণায় কোহলি রবি শাস্ত্রীর সাহায্যের কথা তুলে ধরেছেন। "রবি ভাই সহ সমস্ত সাপোর্ট স্টাফ যাঁরা এই গাড়ির আসল ইঞ্জিন ছিলেন তাঁরা জীবনের এই দৃষ্টিভঙ্গি দলে নিয়ে এসেছিলেন। দলকে ক্রমাগত উপরে নিয়ে গিয়েছেন ওঁরা।" লিখেছেন কোহলি।
ধোনির প্রতিও নিজের প্রশংসা বরাদ্দ রেখেছেন কোহলি। শনিবার নিজের নেতৃত্ব ছাড়ার ঘোষণায় ধোনিকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে লিখেছেন, "মহেন্দ্র সিং ধোনিকে ধন্যবাদ, যে আমার মধ্যে নেতৃত্বের সত্তা আবিষ্কার করেছিল এবং বিশ্বাস করেছিল যে আমি জাতীয় দলকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে উপযুক্ত।"
২০১৪/১৫ সালে মহেন্দ্র সিং ধোনি আচমকা অস্ট্রেলীয় সফরের মাঝে টেস্ট অধিনায়কত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর পরে আচম্বিতে নেতৃত্বের সিংহাসনে বসেছিলেন। আর অধিনায়কত্ব ত্যাগও হল হঠাৎ ঘোষণায়। বোর্ডকে কি টেস্ট নেতৃত্ব ছাড়ার কথা আগাম জানিয়েছিলেন? ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের তরফে হোয়াটসএপে জিজ্ঞাসা করা হল। কোনও রিপ্লাই যথারীতি এল না।
বোর্ডকে অবশ্য ধন্যবাদ জানাতে ভোলেননি কোহলি, "দীর্ঘ এই সময় ধরে দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ দেওয়ার জন্য বোর্ডকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। দলের প্রতি আমার হার না মানা আমার মনোভাবে যে সতীর্থরা বিশ্বাস করেছেন, তাঁদেরও ধন্যবাদ জানাতে চাই। তোমরাই এই যাত্রাপথ এই সুন্দর এবং স্মরণীয় করে তুলেছ।"
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন