কলকাতা ময়দানে এখন ক্রিকেটের মরশুম। ভারত নিজের দেশে আয়োজিত ক্রিকেট বিশ্বকাপের সেমিফাইনালের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। উত্তেজনায় ফুটছে গোটা বাংলা। কারণ, পৃথিবীর দ্বিতীয় প্রাচীনতম ক্রিকেট ক্লাবের ঠিকানা এই শহরেই। যদিও ভিন্নমতের দাবি, দ্বিতীয় নয়, প্রাচীনতম। ১৭৯২ সালে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কিছু আধিকারিক মিলে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাব ক্লিপার্স’ নামে প্রধানত ক্রিকেট খেলার একটি ক্লাব। প্রতিষ্ঠাতা সদস্যরা সকলেই ইউরোপীয়।
হিকির বেঙ্গল গেজেটে
‘হিকিস বেঙ্গল গেজেট’ পত্রিকার ১৬ ডিসেম্বর, ১৭৮০ সংখ্যার প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল, 'The Gentlemen of the Calcutta Cricket Club are getting themselves into Wind, and preparing to take the Field for a very active Campaign…'। অর্থাৎ কিনা, 'ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাবের ভদ্রমহোদয়রা অনুকূল বাতাসের সাহায্যে প্রবল সক্রিয়তার সঙ্গে মাঠে নামতে চলেছেন…'। এই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৭৮০ সালেই ছিল ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাবের অস্তিত্ব। ১৭৮৭ সালে স্থাপিত হয়েছিল মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব (এমসিসি)। যা, পৃথিবীর প্রাচীনতম ক্রিকেট ক্লাব বলে এখনও পর্যন্ত স্বীকৃত। ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাব তারও সাত বছর আগে তৈরি হয়েছিল।
ইটন ক্লাবের সঙ্গে ম্যাচ
এই এমসিসির হাতেই কিন্তু বিশ্ববিখ্যাত লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ডের মালিকানা। ওই মাঠে ১৮১৪ সাল থেকেই বাসা বেঁধেছে এমসিসি। এমন এক বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানের চেয়েও সাত বছর আগে আমাদের এই শহরে আনুষ্ঠানিক ভাবে গড়ে উঠেছিল একটি ক্রিকেট ক্লাব। শুধু তাই নয়, ১৭৯২ সালেই ভারত সফরে এসেছিল ইংল্যান্ডের প্রাচীন এবং বিখ্যাত ইটন কলেজের একটি ক্রিকেট দল। ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাবের সঙ্গে তারা একটি প্রদর্শনী ম্যাচও খেলে।
মাঠ বলতে ঘাসের প্রান্তর
সেই সময় ক্লাবহাউজ বা প্যাভিলিয়নের বালাই ছিল না। খেলা হত ময়দানেই। সেই সময়, আজকের তুলনায় আরও অনেক, অনেকটা বেশি বিস্তৃত ছিল কলকাতা ময়দান। অচিরেই নিয়মিত ক্রিকেট ম্যাচের আখড়া হয়ে উঠেছিল বিস্তীর্ণ সবুজ ঘাসের এই প্রান্তর। ১৮২০-র দশকে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি-র অন্যতম সেরা দলগুলির একটি হয়ে দাঁড়ায় ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাব। ততদিনে ভারতের অন্যান্য প্রদেশে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সৌজন্যে গঠিত হয়েছিল আরও বেশ কিছু দল।
মাঠ ঘেরার প্রয়োজনীয়তা
ক্রিকেটে উৎসাহ বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে শুরু করেছিল দর্শকসংখ্যাও। তখনও খেলোয়াড় বলতে ছিলেন প্রধানত ইউরোপীয়রাই। দর্শকদের মধ্যে অবশ্য ভারতীয়রাও থাকতেন। সেই সংখ্যা বাড়ছিল। যার কারণে ১৮৪০ নাগাদ এই মাঠে অত্যুৎসাহী দর্শকের প্রবেশ রুখতে খেলার জায়গাটিকে বেড়া দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছিল।
টনক নড়ে সেনাবাহিনীর
এরপরই টনক নড়ে ব্রিটিশ প্রশাসনের। সেনাবাহিনীর কেন্দ্রবিন্দু ফোর্ট উইলিয়ামের এত কাছে নিয়মিত এমন ভিড় জমলে নিরাপত্তার আর কী থাকে? তাছাড়া এই ভিড়ের ফলে রীতিমত অসুবিধে হচ্ছিল সৈন্যদের নিয়মমাফিক কুচকাওয়াজ-সহ অন্যান্য কাজে। অবশেষে ১৮৬২ সালে ব্রিগেডিয়ার-জেনারেল চিঠি লিখে প্রশাসনের কাছে দাবি জানান, ফোর্ট উইলিয়ামের ত্রিসীমানায় এইসব ক্রিকেট তামাশা চলবে না, সরে যেতে হবে।
ইডেন গার্ডেনের পথচলা
ফলে বিকল্প খুঁজতে বের হন ক্লাবকর্তারা। বাবুঘাট এবং ফোর্ট উইলিয়ামের মাঝামাঝি সেই বিকল্প মাঠ পাওয়া যায়। খোলামেলা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। জায়গার নাম? ইডেন গার্ডেনস। যার অস্তিত্ব ১৮৪০-এর দশকের একেবারে গোড়া থেকে। কিছু ঐতিহাসিকের মতে, এই গার্ডেন বা বাগানের সৃষ্টি হয়েছিল আরও আগেই। খুব সম্ভবত রানি রাসমণির স্বামী বাবু রাজচন্দ্র দাশের মালিকানায়। ১৮৩৬ সালে নিজের মৃত্যুর আগে তৎকালীন বড়লাট লর্ড অকল্যান্ড এবং তাঁর দুই বোন ফ্যানি ও এমিলি ইডেনকে নাকি উপহার স্বরূপ এই বাগান দান করেছিলেন রাজচন্দ্র। সুতরাং ১৮৪১ সালে এর নাম বদল হয় মাত্র। ১৮৬৪ সালে এই বাগানের একটি অংশে উঠে আসে ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাব। সেই প্রথম জোটে ক্লাবের নিজস্ব প্যাভিলিয়ন। এই প্যাভিলিয়নই কালক্রমে হয়ে ওঠে বর্তমানের স্টেডিয়াম। যেখানে প্রথম আন্তর্জাতিক স্বীকৃত টেস্ট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় ১৯৩৪ সালে। আর, প্রথম একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ আয়োজিত হয় ১৯৮৭ সালে।
জন্ম নেয় সিসিএফসি
১৯৩০-এর দশকেও বহাল তবিয়তে ছিল ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাব। আর, তিন দশক পরেই দেখা যায় তার নতুন অবতার। এর মধ্যেই ১৮৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ক্যালকাটা ফুটবল ক্লাব, যা এশিয়ার প্রাচীনতম ফুটবল ক্লাব হিসেবে স্বীকৃত। সঙ্গে জুড়ে যায় বালিগঞ্জ ক্রিকেট ক্লাব। ক্রিকেট-ফুটবল মিলেমিশে ১৯৬৫ সালে জন্ম নেয় ক্যালকাটা ক্রিকেট অ্যান্ড ফুটবল ক্লাব (সিসিএফসি)। যার বর্তমান ঠিকানা গুরুসদয় দত্ত রোড। এসবের মধ্যেই ‘সাহেব’-দের দেখে ক্রিকেট খেলা আয়ত্ত করে ফেলেন ‘নেটিভ’রাও।
সিপাইরা দক্ষ হয়ে ওঠেন
বিশেষ করে ‘নেটিভ’ সেপাইরা তো আয়ত্ত করেছিলেনই বটে। ১৮৩০ থেকে শুরু করে সমসাময়িক নথিপত্র অনুযায়ী, অধুনা বাংলাদেশের সিলেট, এপারের ব্যারাকপুর, দমদম, মেদিনীপুরের মতো ব্রিটিশ ক্যান্টনমেন্ট-এ সেপাইরা শুধু ক্রিকেট খেলা শিখেই নেননি। তাতে পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন। এমনকী উইকেট-কিপিং বা ফিল্ডিং-এর মত অপেক্ষাকৃত কঠিন কাজেও, যে তাঁদের বিরুদ্ধে মাঠে নেমে হেরে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল, তেমনটা মনে করতেন ‘সাহেব’রা।
ম্যাচে নিষেধাজ্ঞা
হিন্দি ছবি ‘লাগান’-এর পটভূমি মনে করুন। মহাপরাক্রমী ব্রিটিশ শাসকদের ক্রিকেটের মাঠে হারিয়ে দিচ্ছেন একদল দুর্জয় ভারতীয় গ্রামবাসী। এই ছবি কিন্তু আঁকা হতে শুরু করেছিল বাংলা তথা ভারতের একাধিক ক্যান্টনমেন্ট-এ। সেপাইরা ক্রমশ বুঝতে শুরু করেছিলেন ব্রিটিশ শাসকদের দৌড়। দুই তরফের মধ্যে ক্রিকেট ম্যাচে যেই দেখা দিতে লাগল ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ক্ষীণ ধারা, অমনি নড়েচড়ে বসল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রশাসন। ১৮৫০-এর দশক থেকেই আনুষ্ঠানিক ভাবে না-হলেও সক্রিয়ভাবে নিষিদ্ধ হতে শুরু করল এই ধরনের ম্যাচ।
সারদারঞ্জনের উদ্যোগ
কলকাতায় ক্রিকেট খেলার প্রসারের উদ্দেশ্যে স্থাপিত টাউন ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সারদারঞ্জন রায় (১৮৫৮-১৯২৫) সেই ১৮৮৪ সালে ক্লাবের প্রতিষ্ঠাবর্ষেই ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাবকে আমন্ত্রণ জানান একটি ম্যাচ খেলার জন্য। প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল সেই আমন্ত্রণ। অবশেষে ১৮৯৫ সালে সারদারঞ্জনের নাছোড়বান্দা মনোভাবের ফলে অনুষ্ঠিত হয় ম্যাচ। সারদারঞ্জন শুধু আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলকাতায় অঙ্ক ও সংস্কৃতের শিক্ষক হিসেবেই নয়। ইতিহাসে বিখ্যাত ক্রিকেট অনুরাগী হিসেবেও। ইংল্যান্ডের এক কিংবদন্তী ক্রিকেটারের স্মরণে তাঁকে বলা হত ‘ডব্লু.জি. গ্রেস অফ ইন্ডিয়া’, তথা বাংলার ক্রিকেটের জনক।
আরও পড়ুন- বিশ্বকাপে হার্দিকের বদলে কৃষ্ণকে নিতেই বিতর্কের ঝড়! মুখ খুলতে বাধ্য হলেন কোচ দ্রাবিড়
ঢাকায় ছাত্র থাকাকালীন
উত্তরাধিকার সূত্রে শুধুমাত্র টাউন ক্লাবই নয়। তিনি ঢাকা কলেজ ক্রিকেট ক্লাবও তৈরি করেছিলেন। ভাইদের সঙ্গে ১৮৭০-এর দশকের শেষদিকে ঢাকায় ছাত্র থাকাকালীন ওই ক্লাব তৈরি করেছিলেন। এই সারদারঞ্জন হলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর দাদা, সুকুমার রায়ের জ্যাঠা, অর্থাৎ সত্যজিৎ রায়ের পিতামহের দাদা।
(তথ্যসূত্র ও ছবি কলকাতা পুলিশের ফেসবুক পোস্ট)