৮২ বছর বয়সে চুনী গোস্বামীর মৃত্যুর সাথে সাথে একটা স্বপ্নেরও বোধহয় মৃত্যু হলো। স্বপ্ন না বলে তাকে সম্ভাবনাও বলা যায়, যার বীজ আজ থেকে ৫৮ বছর আগে জাকার্তার সেনায়ান স্টেডিয়ামে চুনী গোস্বামীর নেতৃত্বে এদেশের দামাল ছেলেরা বপন করেছিল। ১৯৮৩ সালের ২৫ জুন লর্ডসের ব্যালকনি থেকে বছর চব্বিশের কপিল দেব যখন দু'হাতে তুলে ধরেছিলেন প্রুডেনশিয়াল কাপ, সেই একটি দৃশ্য চিরদিনের মতো বদলে দিয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেটের গতিপথ। যদিও যে খেলায় মাত্র আটটি দেশ অংশগ্রহণ করে, তাকে কতটা বিশ্বকাপ বলা যায়, তাই নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে। তবু যেন ক্রিকেট দুনিয়ায় ভারতকে, এবং ভারতের দুনিয়ায় ক্রিকেটকে, সেই দিনটি দিয়েছিল এক এভারেস্ট-সমান উচ্চতা।
অথচ এই দিনটা হতেই পারত ১৯৬২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর, যখন প্রায় এক লক্ষ মানুষের প্রবল বিদ্রূপ এবং উপহাস উপেক্ষা করে ঘামে ভেজা চুনী, এবং রক্তে ভেসে যাওয়া জার্নেল সিং, এক যুদ্ধক্লান্ত দেশের জন্য ছিনিয়ে এনেছিলেন এশিয়ার ফুটবলের সর্বশ্রেষ্ঠ শিরোপা। চুনী, পিকে, জার্নেল, তুলসীদাস বলরামের সেই সোনার দৌড় ১৯৮৩-র কপিল, অমরনাথ, শ্রীকান্ত, এঁদের বিশ্বজয়ের চেয়ে কোনও অংশে কম ছিল না। বরং সেদিনের ভারতের ফুটবলের দীপ্তি যদি সত্যি সত্যি রাষ্ট্রগৌরবের মোড়কে প্রচার করা যেত, তবে এদেশের খেলার ইতিহাসে ক্রিকেট নয়, ফুটবলই হতো বৃহত্তম গৌরবের বিষয়।
দেখুন ছবিতে, ফিরে দেখা ২৫ জুন: এক নজরে ‘৮৩’ ছবিতে বিশ্বকাপের হিরোদের ফিল্মি অবতার
১৯৬২-র এশিয়ান গেমসে প্রথম থেকেই ভারত এবং ভারতীয় খেলোয়াড়রা ছিলেন ঘৃণার পাত্র। সেবারের আয়োজক দেশ ইন্দোনেশিয়া শেষ মুহূর্তে আরব দুনিয়া এবং চিনের চাপে যথাক্রমে ইজরায়েল এবং তাইওয়ানকে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে বাধা দেয়। এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে ভারত। জাকার্তা এশিয়ান গেমস ফেডারেশন কংগ্রেসে ভারতীয় প্রতিনিধি গোপালদাস সোন্ধি অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত বক্তব্য রাখেন যে, ইজরায়েল এবং তাইওয়ান ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটি এবং এশিয়ান গেমস ফেডারেশন দ্বারা স্বীকৃত দেশ, এবং তাদের এশিয়ান গেমস থেকে বাদ দেওয়ার কোনও অধিকার ইন্দোনেশিয়ার নেই।
সারা ইন্দোনেশিয়া এই মন্তব্যে ভারতের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়ে। প্রেসিডেন্ট সুকর্ণ (যাঁকে একসময় জওহরলাল নেহরুর নির্দেশে নিজের জীবন বিপন্ন করে প্রাণে বাঁচিয়েছিলেন তৎকালীন ভারতীয় বায়ুসেনার পাইলট তথা পরবর্তীকালে ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী বিজু পট্টনায়ক) পর্যন্ত ভারতের মন্তব্যের নিন্দা করেন। এরই মধ্যে চুনী গোস্বামীর দল শুরু করে তাদের অভিযান, এবং প্রথম ম্যাচেই এশিয়ান কাপজয়ী দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে দুই গোলে পরাজিত হয়। ভারতের পরাজয়ে সেদিন ইন্দোনেশিয়ায় যেন আনন্দের ঢেউ বয়ে যায়।
পরের ম্যাচে থাইল্যান্ডকে ভারত ৪-১ গোলে হারায়। প্রথম গোলটি করেন অধিনায়ক চুনী স্বয়ং। ম্যাচের মাঝপথে মাথায় ছ'টি সেলাই নিয়ে মাঠ ছাড়েন জার্নেল সিং। তার পরের ম্যাচে মহাশক্তিধর জাপানকে দু'গোলে হারায় ভারত, ঝলসে ওঠেন পিকে ব্যানার্জি, রাম বাহাদুর, এবং বলরাম। এর পরে সেমিফাইনালে ভারতের মুখোমুখি হয় দক্ষিণ ভিয়েতনাম। রুদ্ধশ্বাস সেই ম্যাচে প্রথমার্ধে জার্নেল সিং এবং চুনী গোস্বামীর গোলে এগিয়ে থাকা ভারত দ্বিতীয়ার্ধে দুটি গোল হজম করে। তারপর ম্যাচের ৭৫ মিনিটের মাথায় মাণিক ঝলসে ওঠে চুনী গোস্বামীর পায়ে। সেখান থেকেই আসে জয়সূচক গোল।
ভারতীয় ফুটবলের এহেন সাফল্য যেন আরও ক্ষুব্ধ করে তোলে ইন্দোনেশিয়ার সাধারণ মানুষকে। সারা এশিয়ান গেমস জুড়ে সেবার ভারতীয় খেলোয়াড়দের রাস্তা-ঘাট-মাঠ-হোটেল, প্রায় সর্বত্র, স্থানীয়দের টিটকিরি এবং অসহযোগিতার সম্মুখীন হতে হয়। ফাইনালের এক দিন আগে কিছু স্থানীয় দুষ্কৃতী আক্রমণ করে ভারতীয় দূতাবাস। তছনছ করা হয় কাগজপত্র, ভাঙা হয় কাচ, আসবাব। এমনকি গোপালদাস সোন্ধিকে হত্যার হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হয়।
৪ সেপ্টেম্বর চুনীরা যখন গেমস ভিলেজ থেকে স্টেডিয়ামে যাচ্ছেন, তখন টিম বাসের গা থেকে নিরাপত্তার স্বার্থে খুলে নেওয়া হয় ভারতীয় দলের ব্যানার। জার্নেল সিংকে বলা হয় বাসের মেঝেতে বসতে, কারণ জানালায় পাগড়ি পরা শিখ দেখলে স্থানীয়রা নাকি বুঝে যাবে যে এই বাসে ভারতীয় টিম যাচ্ছে। এবং তাতে নাকি নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। চরম অপমানের বোঝা নিয়ে ভারতীয়রা যখন ফাইনাল খেলতে মাঠে নামছেন, তখন স্টেডিয়ামে প্রায় এক লক্ষ মানুষ। প্রায় সকলের মুখেই ভারতের নামে অশ্রাব্য গালাগাল, এবং বিদ্রুপের হাসি।
মাঠে যখন ভারতের জাতীয় সঙ্গীত বাজানো হচ্ছে, তখনও তাকে চরম অবমাননা করে দর্শকরা। সারা মাঠ জুড়ে সেদিন দক্ষিণ কোরিয়ার জন্য প্রাণখোলা সমর্থন, এবং ভারতের জন্য উপহাস, বিদ্রূপ, গালাগালি, স্লোগান। তবু রহিম সাহেবের ছেলেরা ভয় পান নি। মাঠে নামার আগে সবাইকে হাতে হাত ধরে দেশভক্তির গান গাইয়েছিলেন কিংবদন্তী কোচ। প্রতিপক্ষ এশিয়ার শ্রেষ্ঠ ফুটবল শক্তি দক্ষিণ কোরিয়া, যারা তখন এশিয়ান কাপ চ্যাম্পিয়ন, এবং যাদের কাছে ১৯৫৮-র এশিয়ান গেমসে সেমিফাইনালে হেরেছিল ভারত। এমনকি ১৯৬২-র গ্রুপ ম্যাচেও দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে ভারত হেরে যায়।
দেশে ফিরে গিয়ে লাখ টাকা পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি নেই, বিজ্ঞাপনে মডেল হওয়ার অফার নেই, সরকারি চাকরির আশা নেই, তবু সেদিন পাঞ্জাবের জার্নেল সিং, বাংলার প্রদীপ ব্যানার্জি, অন্ধ্রের তুলসীদাস বলরাম, হায়দরাবাদের পিটার থঙ্গরাজ, বোম্বাইয়ের চন্দ্রশেখর, দেহরাদুনের রাম বাহাদুররা এসে দাঁড়িয়েছিলেন চুনী গোস্বামীর দু'পাশে। সারা মাঠে দর্শকদের বিদ্রুপে কান পাতা দায়, চিৎকারের বহর এমন যে অনেকবার রেফারির বাঁশির আওয়াজও শোনা যাচ্ছে না। তবু তারই মধ্যে পিকে এবং জার্নেলের গোলে এগিয়ে যায় ভারত। খেলার প্রায় শেষ লগ্নে একটি গোল শোধ করে দক্ষিণ কোরিয়া।
খেলার শেষ বাঁশি বাজার সময় রক্তে ভেসে যাচ্ছে জার্নেল সিংয়ের মাথা, এবং জলে ভেসে যাচ্ছে রহিম সাহেবের চোখ। ভারত জেতার সঙ্গে সঙ্গে আরও বেশি হতাশায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে দর্শকমণ্ডলী। সারা গ্যালারি জুড়ে তখনও এমন বিদ্রূপ এবং চিৎকার যে মাঠে কোনোরকম সেলিব্রেশন করতে পারে নি ভারতীয় টিম। অন্ধকার একটি বাসে করে গেমস ভিলেজে দিরে আসেন সকলে, এবং যত দ্রুত সম্ভব জাকার্তা ছাড়েন, প্রায় অপরাধীর মতো।
১৯৬২-র এই রূপকথা বদলে দিতে পারত ভারতের ক্রীড়া ইতিহাস। ফুটবল হয়ে উঠতে পারত এই ১৩০ কোটির দেশের প্রধান উৎসব। ১৯৬২ সালেই আমরা চিনের কাছে যুদ্ধে হেরেছিলাম। চুনী গোস্বামীর দলের সোনা জয়ের কাহিনী রূপকথা হয়ে উঠতে পারত, একটা আহত রাষ্ট্রের নতুন করে বাঁচার লড়াইয়ে। হরিয়ানার দস্যি ছেলেটা ১৯৮৩-র জুনে যেভাবে চিরদিনের জন্য পাল্টে দিয়ে গেল ভারতীয় ক্রিকেটের গতিধারা, তার চেয়েও বোধহয় অনেক বেশি গতিতে ভারতীয় ফুটবলকে পাল্টে দিতে পারতেন জাকার্তার স্টেডিয়ামে মাথায় রক্ত ঝরানো জার্নেল সিং, এবং সোনার মেডেল গলায় ঝুলিয়ে, নায়কের হাসি হেসে ওঠা চুনী গোস্বামীরা।
কিন্তু তা হয় নি। এই পোড়া দেশ সেই আগুনের আলো আর তাপ বোঝার চেষ্টা করে নি সেদিন। মৃত্যুর আগে জার্নেল সিং, পিকে ব্যানার্জি, বলরাম, অরুণ ঘোষ, চুনী গোস্বামীরা দেখে গেলেন, যে জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়াকে তাঁরা ১৯৬২ সালে হারিয়েছিলেন, সেই দুই দেশ আজ প্রতিটি বিশ্বকাপে এশিয়ার প্রতিনিধিত্ব করে, আর তাঁদের নিজের দেশে আজও ফুটবল সর্বজনীন হয়ে ওঠার জন্য যুদ্ধ করে প্রতিদিন।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন