/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2023/02/eb-fan.jpg)
জয়শঙ্কর সাহা এবং অভিশপ্ত সেই ডার্বি ।(সংগৃহীত এবং এক্সপ্রেস ফটো শশী ঘোষ)
সকালে বাড়িতে বলে বেড়িয়েছিলেন প্রিয় ইস্টবেঙ্গলকে জিতিয়েই ফিরবেন! কনস্টানটাইনের হাতে ফেরান্দোর বাগান বধ হলেই বাড়িতে বসত সেলিব্রেশনের আসর। তবে ফুটবল পাগল জয়শঙ্কর সাহার আর বাড়ি ফেরা হয়নি ২৯ অক্টোবর রাতে। মাঠে লাল-হলুদ জার্সিধারীদের ফালাফালা করে দিয়েছিলেন হুগো বৌমাস, জনি কাউকোরা। প্রিয় দলের অসহায় আত্মসমর্পণ নিতে পারেননি ৩৮ বছরের লাল-হলুদ অন্তপ্রাণ সমর্থক। অফিসের কলিগদের সঙ্গে খেলা দেখতে গিয়ে মাঠেই হৃদরোগে আক্রান্ত হন। তারপর আমরি হয়ে নিথর দেহ ফেরে বাগুইহাটির বাড়িতে।
উদযাপনের মঞ্চ হয়ে দাঁড়ায় শোকবাসর। তারপর গঙ্গা দিয়ে বয়ে গিয়েছে বহু জল। ইস্টবেঙ্গলের শোচনীয় দশা অব্যাহত। এটিকে মোহনবাগান খোঁড়াতে খোঁড়াতে কোনওরকমে নকআউট পর্বে পৌঁছনো নিশ্চিত করেছে শেষ ম্যাচে। ফের শনিবার মুখোমুখি হচ্ছে দুই দল। তবে ডার্বি আর দেখবে না জয়শঙ্কর সাহার পরিবার। ফুটবল মানেই জীবনবোধ, জীবনের শ্রেষ্ঠতম দর্শনের পাঠ দেয় সবুজ ঘাসের লড়াই। তবে খেলার মাঠ-ই যে কেড়ে নিয়েছে তরতাজা প্রাণ।
বুধবার রাতে প্রয়াত জয়শঙ্করবাবুর স্ত্রী তপতী সাহা জানিয়ে দিলেন, আর কোনওদিন খেলার মাঠমুখো হবেন না। খেলাই যে কেড়ে নিয়েছে তাঁর হৃদয়ের এক টুকরোকে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-র সঙ্গে ফোনালাপে তপতী সাহার গলায় আক্ষেপ আর হতাশা মিলেমিশে একাকার, "ওঁকে মাঠে প্রাথমিক পরিচর্যা হলে হয়ত বেঁচে যেতে পারত। অন্তত চিকিৎসকরা পরবর্তীতে আমাকে এরকমই জানিয়েছেন। আইএসএল-এই মত একটা দেশের সেরা ফুটবল টুর্নামেন্ট। সেখানে লাখো লাখো দর্শক খেলা দেখতে আসছেন। আর জরুরিকালীন নূন্যতম চিকিৎসার বন্দোবস্ত করা গেল না?"
"বিদেশে তো আকছারই সমর্থকদের জরুরিকালীন চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়ার জন্য অংশগ্রহণকারী দলের মেডিক্যাল টিম হাজির হয়ে যায়। এখানে জয়কে সেরকমভাবে ফুটবলারদের জন্য নির্দিষ্ট ইমারজেন্সি রুমে নিয়ে যাওয়া তো হয়নি! একটু জল, একটা সরব্রিটেট পেলে হয়ত বেঁচে যেত জয়!" কান্না, দুঃখ, রাগ সব ছাপিয়ে আসতে চায় যেন।
আরও পড়ুন: ৩ লক্ষ ২৫ হাজারের LIC পলিসি ডার্বিতে প্রয়াত সেই সমর্থকের পরিবারকে! ফিরতি মহারণের আগেই ভিজল হৃদয়
এক্সপোর্ট-ইম্পোর্ট কোম্পানিতে চাকরি করতেন জয়শঙ্করবাবু। কাজের বাইরে নিজেকে সমর্পণ করতেন খেলার দুনিয়ায়। ইস্টবেঙ্গল তো বটেই ভারতের ক্রিকেট থাকলে মিস করতেন না। পুরনো স্মৃতি ঢেউ এখনও উথালপাতাল করে দেয় তপতী সাহাকে। অচেনা সাংবাদিককে অনভ্যস্ত ক্ষণে উজাড় করে দেন স্মৃতির ডালি, "ভীষণ লাজুক ছিল ও। কাজের বাইরে খেলাতেই মেতে থাকতেন আগাগোড়া। ইস্টবেঙ্গলের খেলা যেমন গ্যালারিতে বসে দেখা মিস করতেন না। তেমন ভারতের ম্যাচ থাকলে তো নাওয়া-খাওয়া ভুলে যেতেন। এই তো টি২০ ওয়ার্ল্ড কাপে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে কেউ যাতে ডিস্টার্ব না করতে পারে, সেই জন্য আমাদের মানে আমাকে আর মেয়েকে অন্য ঘরে পাঠিয়ে দেয়।"
চলে গিয়েছেন জয়শঙ্কর বাবু। রেখে গিয়েছেন তাঁকে ঘিরে থাকা আস্ত এক জগৎকে। যে জগতের বাসিন্দা ফুটবল, ক্রিকেট, স্ত্রী এবং একরত্তি মেয়ে। সংসারের জোয়াল আপাতত তপতীদেবীর কাঁধে। সারাদিন অফিস করে পরিশ্রান্ত মুহূর্তে বাগুইহাটির কন্যে শিউরে ওঠা গলায় এখনও মনে করতে পারেন অভিশপ্ত দিনের প্রতিটা ক্ষণ।
আরও পড়ুন: ইস্টবেঙ্গল-ইমামির সম্পর্ক কি মসৃণ! খবরের ভিতর খবর বলছে অন্য ‘কাহিনী’
"আমি মাঝেমধ্যেই মাঠে ওঁর সঙ্গে খেলা দেখতে যেতাম। তবে মেয়ে ছোট থাকায় এই ডার্বিতে যাইনি। ওঁর অফিসের কলিগরাই আমাকে হঠাৎ ফোনে জানায় ও অসুস্থ। আমরিতে ভর্তি রয়েছে। দ্রুত সল্টলেকের উদ্দেশ্যে রওনা দিই। তবে রাস্তার মাঝপথেই আমাকে ওঁর চলে যাওয়ার খবর জানানো হয়।"
কান্না দলা পাকিয়ে গলা দিয়ে নেমে যেতে চায়। পেঁজা পেঁজা অভিমানের বাষ্প বেরিয়ে আসে তারপরে। অভিমানিনী বলে দেন, "ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের কর্মকর্তারা এসে আমাকে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। বলা হয়েছিল আমার চাকরির বন্দোবস্ত করা হবে। মেয়ের লেখাপড়ার দায়িত্ব নেওয়া হবে। কোথায় কী! আমি আসলে কোনও আর্থিক প্রতিশ্রুতি চাইনি। চেয়েছিলাম কঠিনতম সময়ে আমার পাশে কেউ দাঁড়াক। ইমোশনাল সাপোর্ট দিক আমায়। জয়ের অফিসের বস আমাকে ওঁর জায়গায় চাকরি না দিলে হয়ত না খেয়ে থাকতে হত আমাকে। ইবিআরপি ফ্যান ক্লাব বরং আমার ত্রাতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর্থিক সাহায্য করেছে। সেটা বড় কথা নয়, নিজেদের সাধ্যমত ওঁরা ব্যবস্থা করেছে। তবে রাত-বিরেতে আমাদের খোঁজ খবর নিয়েছে। সমস্ত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ওঁদের ঋণ কোনওদিন পরিশোধ করতে পারব না।"
#EBRP has handed over a LIC policy of Rs. 3,25,000 to Joy Shankar Saha's family.
We are grateful to everyone for coming forward in support of the bereaved family.
Heartfelt thanks to #BFC for amplifying the campaign via #Blueprint and Mr. Ranjit Bajaj for donating of Rs. 20,000. pic.twitter.com/7A422DJaxA— EAST BENGAL the REAL POWER (EBRP)❤💛 (@EBRPFC) February 22, 2023
সারাদিন হাড় ভাঙা মনকে পিষে ফেলা খাটনি। তার মধ্যেই মেয়েকে বড় করে তোলার চ্যালেঞ্জ। অসম যুদ্ধে ব্রতী হয়েছেন তপতী সাহা। হাঁফ ফেলার ফুরসৎ নেই এখন। হৃদয়ে আঁকড়ে রয়েছেন পুরোনো স্মৃতি। ফেলে আসা সোনাঝরা সময়। ফোন রাখার আগে থরোথরো আবেগ মেখে তিনি স্রেফ বলে যান, "সল্টলেকে আর যেতেই চাই না। মেয়ের স্কুলের পিছনেই যুবভারতী। ওখানে গেলেই সব মনে পড়ে যায়। বুক যেন ভেঙে যায়। ডার্বি আমার প্রিয় মানুষটাকেই কেড়ে নিয়েছে। আর কীভাবে ডার্বি দেখব বলুন?"