Advertisment

নিউজিল্যান্ডে উইমেন ইন ব্লুজ: সিরিজ জয় ও মিতালির রেকর্ড

কোহলির রান ‘চেজ’ এর ক্ষমতা এবং ‘ফিনিশার’ হিসেবে ধোনির শ্রেষ্ঠত্ব সর্বজনবিদিত। কিন্তু রান তাড়া করে ম্যাচ জেতানোয় মিতালি সবাইকেই পেছনে ফেলেছেন।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Indian Womens Cricket Team

নিউজিল্যান্ডে সিরিজ জিতেছে টিম ইন্ডিয়ার উইমেন ইন ব্লুজ

ঠিক যে সময়ে বিরাট বাহিনী নিউজিল্যান্ডের মাটিতে ক্রিকেট সফরে ব্যস্ত, সেই একই সময়ে মিতালির দলও কিউয়িদের সঙ্গে ব্যস্ত ২২ গজের যুদ্ধে। আপাতত তিন ম্যাচের ওয়ান ডে সিরিজ দাপটের সঙ্গেই পকেটস্থ করেছে ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দল। ২-১ এ জয়ী হয়েছে তারা।

Advertisment

প্রথম ম্যাচ ছিল নেপিয়ারে। মিতালিরা টসে জিতে প্রথমে ফিল্ডিং এর সিদ্ধান্ত নেয়। কিউয়ি ব্রিগেডের কেউই সেরকম দারুণ কিছু করতে পারেননি এবং মাত্র ১৯২ রানে অল আউট হয়ে যায় নিউজিল্যান্ড। ভারতীয় বোলারদের মারকাটারি স্পেলের সামনে দাঁড়াতে পারেননি সেভাবে কেউই। উল্টোদিকে একতা বিস্ত এবং পুনম যাদব তুলে নেন তিনটি করে উইকেট। যোগ্য সংগত দেন শিখা পাণ্ডে (১টি উইকেট) ও দীপ্তি শর্মা (২টি উইকেট)। ভারতীয় দল ব্যাট করতে নেমে মাত্র ১ উইকেটের বিনিময়ে তুলে নেয় প্রয়োজনীয় রান। প্রসংগত ১৯৩ রানের টার্গেট নিয়ে ব্যাট করতে নেমে ভারতের দুই ওপেনারই মারকাটারি ব্যাটিং করেন। জেমাইমা করেন অপরাজিত ৮১ এবং স্মৃতি মান্ধানা মাত্র ১০৪ বলে করেন ১০৫। এই দুজনের ব্যাটিং এর দৌলতেই অনায়াসে মাত্র ৩৩ ওভারে ম্যাচ জিতে নেয় ভারত। স্মৃতি যখন আউট হয়ে প্যাভিলিওয়নে ফেরেন, ভারতের তখন মাত্র তিন রান বাকি জেতার জন্য।  স্বাভাবিকভাবেই প্লেয়ার অফ দ্য ম্যাচ হন স্মৃতি মান্ধানা।

পরবর্তী ম্যাচ প্রায় রিপিট টেলিকাস্ট ছিল প্রথম ম্যাচের। এবারেও মিতালি টসে জিতে আগে বোলিং এর সিদ্ধান্ত নেন। অধিনায়ক অ্যামি স্যাটারথোয়েট (৭১) ছাড়া কেউই উল্লেখযোগ্য কিছু করতে পারেননি। বলা যেতে পারে তাঁর অর্ধ শতরানের ওপরে ভর করেই কোনমতে নিউজিল্যান্ড ১৬১ রান করে। এছাড়া লরেন ডাউন, ক্যাস্পেরেক, বের্নাডাইন এবং তাহুহু সামান্য অবদান রাখতে সক্ষম হন এবং দু সংখ্যার রানে পৌঁছন। আগের ম্যাচে একটাও উইকেট না পাওয়া ঝুলন গোস্বামী এই ম্যাচে পুরোদমে পুষিয়ে দেন। তাঁর বোলিং ফিগার (৮.২-২-২৩-৩) এই ম্যাচে রীতিমত ঈর্ষণীয়। এছাড়া একতা, পুনম, দীপ্তি প্রত্যেকেই দুটি করে উইকেট তুলে নিয়ে নিউজিল্যান্ডকে ৪৪ ওভারেই প্যাভিলিয়নে পাঠিয়ে দেয়। ব্যাট করতে এসে এবারেও মারকাটারি স্মৃতি। ৮৩ বলে অপরাজিত ৯০ এর ইনিংস তাঁকে একটি শতরান না করতে পারার কষ্ট ভুলিয়ে দেবে। স্মৃতি যখন একের পর এক কিউয়ি বোলারকে ক্লান্ত করছেন, অন্য প্রান্তে শান্তভাবে বরাবরের মতই অধিনায়কোচিত ইনিংস খেললেন মিতালি রাজ। ১১১ বলের ৬৩ রানের ইনিংসটির প্রতিটি শটে ছিল নিয়ন্ত্রণ ও আত্মবিশ্বাস। মাত্র ৩৬ ওভারে অনায়াসে ২ উইকেটের বিনিময়ের জয়ের প্রয়োজনীয় রান তুলে নেয় ভারত। আরও একবার শ্রেষ্ঠ খেলোয়ারের পুরস্কার পান স্মৃতি।

প্রথম দুই ম্যাচে স্মৃতির এই চোখ ধাঁধানো খেলা তাঁকে নিয়ে গেছে আইসিসি ব্যাটিং র‍্যাঙ্কিং লিস্টের এক নম্বরে। ২০১৮ সালের শুরু থেকে যে মেয়ে ১৫ ম্যাচে দুটো শতরান আর আটটা অর্ধ-শতরান করেছেন অংকের হিসেবেই এ সম্মান তাঁর প্রাপ্য। এলিসা পেরি আর মেগ ল্যানিংকে পিছনে ফেলে দিলেন ভারতের স্মৃতি।

সিরিজের শেষ ম্যাচটি ভারতীয় দল বেশীদিন মনে রাখতে চাইবে না। অবশ্য এই ম্যাচ সমগ্র ভারতীয় ক্রিকেট ফ্যানের জন্যেই স্মরণীয় ছিল। মিতালি রাজ ইতিহাসের প্রথম মহিলা ক্রিকেটার হিসেবে ২০০ তম ওয়ান ডে ম্যাচটি খেলতে নামেন এইদিন হ্যামিল্টনের মাঠে। এইবারের নিউজিল্যান্ড টসে জিতে ফিল্ডিং এর সিদ্ধান্ত নেয়। টসে পরাজয়ের সঙ্গে সঙ্গেই মিতালিদের ভাগ্যও নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। দীপ্তি শর্মার অর্ধশতরান ছাড়া এই ম্যাচে ভারতের উল্লেখযোগ্য বিশেষ কোন মুহুর্ত নেই। দীপ্তি করেন ৫২ এবং তার জেরেই ভারতীয় দল কোনক্রমে ১৪৯ রান করেন। মিতালি করেন মাত্র ৯ রান। অ্যানা পিটারসেন একাই ভারতের তিনজন নির্ভরযোগ্য খেলোয়ারের উইকেট তুলে নেন। স্মৃতি, দীপ্তি ও হারমানের উইকেট নিয়ে মিডল অর্ডারকে প্রায় একাই শেষ করে দেন। ১০ ওভারে ২৮ রান দিয়ে তুলে নেন মোট ৪টে উইকেট। স্যাটার্থোয়েটের অপরাজিত ৬৬ এবং সুজি বেটসের ৫৭ রানের দৌলতে খুব সহজেই ১৫৩ রান করে ফেলে নিউজিল্যান্ড। ভারতীয় বোলাররা খুব একটা সুবিধে করে উঠতে পারেননি। বলা বাহুল্য, চেষ্টা করার মত রসদ তাঁদের জন্য স্কোরবোর্ডে মজুত ছিল না।

মিতালি রাজ, অপরাজিত ২০০

২০০তম ম্যাচ খেলার পরে ভারতীয় অধিনায়ক মিতালি রাজ জানিয়েছে ‘২০০’ তাঁর কাছে কেবলই এক সংখ্যা মাত্র। অবশ্য বলবেন না-ই বা কেন? মিতালি ও ঝুলন হলেন সেই দুজন ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটার যারা কোনকিছু না পেয়ে লড়াই চালিয়ে গেছেন বছরের পর বছর। ধীরে ধীরে এখন সেই তাঁরাই দেখছেন প্রাপ্তির ভাঁড়ার পূর্ণ হতে। ভারতীয় ক্রিকেটে মিতালি রাজের অবদান অচিরেই তাঁর ২০০তম ম্যাচের ব্যর্থতা ভুলিয়ে দেবে ক্রিকেট অনুগামীদের।

সেই ১৯৯৯ থেকে শুরু। না, ১৯৯৯ থেকে তো খাতায় কলমে শুরু। আসল শুরু হয়েছিলি সেইদিন যেদিন ভারতনাট্যমে উৎসাহী ‘লেট রাইজার’ মেয়ের স্বভাব পরিবর্তনের জন্য বাবা ভর্তি করে দিলেন ক্রিকেট কোচিং এ। উদ্দেশ্য, মেয়েকে সকালে ঘুম থেকে ওঠানো। কে জানত একদিন সেই মেয়ে দেশের জন্য শুধু ক্রিকেট খেলবেই না, মেয়েদের ক্রিকেটকে এক সম্পূর্ণ অন্য পর্যায় নিয়ে যাবে।

বাবার বন্ধুর মনে হয়েছিল এই মেয়ের হবে। আর সেই হওয়ানোর জন্যেই শুরু কঠিন প্রস্তুতি। তারপর ১৯৯৭ সাল। ভারতে আয়োজিত হল প্রথম মেয়েদের ক্রিকেট বিশ্বকাপ। মিতালি ভেবেছিলেন বিশ্বকাপে সুযোগ পাবেন। পাননি। পেলেন ১৯৯৯ সালে। বিশ্বকাপের পর সেই প্রথম ক্রিকেট খেলতে নামলেন ভারতের মেয়েরা। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে একইসঙ্গে অভিষেক হয় রেশমা গান্ধী ও মিতালি রাজের। দুজনেই করেন শতরান। ১০১ রান করে রেশমা ওয়ান ডে অভিষেক ম্যাচে শতরান করা প্রথম ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটার। মিতালি ঠিক একই পদাঙ্ক অনুসরণ করে ১১৪ রান করেন। মিতালির আগেয় মহিলা ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথম ওয়ান ডে ম্যাচে শতরান করেছিলেন মাত্র তিনজন। এনিড ব্য্যাকওয়েল (১৩৪), লিন থমাস (১০১) ও রেশমা গান্ধী। প্রসঙ্গত রেশমা ও মিতালির মতই, ব্যাকওয়েল ও থমাসও একই ম্যাচে অভিষেক করে শতরান করেন। মাত্র ১৬ বছর ২৫০ দিনে এই কীর্তির অধিকারি হয়ে মিতালি হয়ে ওঠেন শতরানকারী কনিষ্ঠতম মহিলা ক্রিকেটার।

২০ বছরের লম্বা কেরিয়ারে ২০০টি ওয়ান ডে ম্যাচ খেলে এই মুহূর্তে মিতালি মেয়েদের ওয়ান ডে ক্রিকেটে সর্বোচ্চ রানের অধিকারী। তাঁর ৬,২২২ রানের মধ্যে রয়েছে ৭টি ১০০ ও ৫২টি ৫০। তালিকায় এই মুহুর্তে একমাত্র ইংল্যান্ডের সারাহ টেলর আছেন কাছাকাছি বর্তমান খেলোয়ারদের মধ্যে। তবে মিতালির সঙ্গে সারাহর রানের ব্যবধান ২০০০ এর বেশি।  কোহলির রান ‘চেজ’ এর ক্ষমতা এবং ‘ফিনিশার’ হিসেবে ধোনির শ্রেষ্ঠত্ব সর্বজনবিদিত। কিন্তু রান তাড়া করে ম্যাচ জেতানোয় মিতালি সবাইকেই পেছনে ফেলেছেন। মিতালির ১১১.২৯ এভারেজ এই ক্ষেত্রে ওয়ান ডে ক্রিকেটে তালিকায় সবার ওপরে। শুধু ওয়ান ডে নয়, নিজের সাবলীল ব্যাটিং-এর পরিচয় দিয়েছেন টেস্ট ক্রিকেট থেকে শুরু করে টোয়েন্টি-২০ এ। মাত্র ১০ টি টেস্ট ম্যাচে ৫১ গড়ে রান করা মিতালির টেস্টে সর্বোচ্চ রান ২১৪। টি-২০ এ মিতালি এই মুহুর্তে রয়েছেন মেয়েদের মধ্যে ষষ্ঠ স্থানে (২,২৮৩ রান)।

২০ বছর ধরে মহিলা ক্রিকেটের ইতিহাসে একের পর এক মুহূর্ত রচনা করেছে্ন মিতালি রাজ। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ভারতীয় মহিলা দল আজ যে সম্ভ্রম আদায় করে নিতে সক্ষম, তার একটা বড় কারণ তিনি স্বয়ং। মিতালি ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসে একমাত্র অধিনায়ক যিনি দেশকে দুবার ফাইনালে তুলেছেন। ২১ বছর বয়সে কনিষ্ঠতম ভারতীয় ক্যাপ্টেন হয়েও অনভিজ্ঞতার ছাপ দেখা যায়নি মাঠে। গত পনেরো বছরের অধিকাংশ সময় মিতালি ছিলেন দলেন ক্যাপ্টেন এবং দলকে একের পর এক সাফল্যের দিকে নিয়ে গেছেন অবলীলায়। ৭৫ টি ম্যাচে মিতালির নেতৃত্বে জয়ী হয়েছে ভারতীয় দল এবং সে ম্যাচগুলিতে মিতালির ব্যাটিং গড় হল ৮২। এছাড়া ১২২টি ম্যাচে অধিনায়ক হিসেবে মিতালির স্কোর ৪,১২৭ রান। এর মধ্যে রয়েছে ৫টি শতরান ও ৩৫টি ৫০। গড় ৫৬.৫৩। বোঝাই যায়, অধিনায়কত্ব কোনদিন মিতালির ওপর চাপ সৃষ্টি করেনি, বরং তাঁর শ্রেষ্ঠ পারফরম্যান্স বের করে এনেছে।

তবে রেকর্ড বুক যাই বলুক, মিতালির অবদান সংখ্যা দিয়ে শুধু বিচার করা সম্ভব নয়। মিতালিরা সেদিন হাল ছেড়ে দেননি বলেই আজ স্মৃতিরা ব্যাট ধরতে সাহস পেয়েছে। শুধু একটা জেনারেশন নয়, মিতালি উদ্বুদ্ধ করেছেন একটা গোটা সমাজকে। আর কোথাও না কোথাও ৩৬ এ পা দেওয়া মিতালি রাজ এটা নিজেও জানেন। তাই তো অবলীলায় এক ইতিহাসের সৃষ্টি করেও বলতে পারেন, ‘২০০ শুধুই একটা নম্বর’।

কিউয়িল্যান্ডে টি-২০

আপাতত চলছে কয়েকদিনের বিরতি। এরপর নিউজিল্যান্ডে শুরু হবে টোয়েন্টি-২০-র লড়াই। ভারতীয় ও কিউয়িবাহিনী ৬ ফেব্রুয়ারি থেকে মাঠে নামবে তিন ম্যাচের টি-২০ সিরিজ খেলতে। দেখা যাক ভারতীয় দল নিজেদের জয়ের ধারা বজায় রাখতে পারে কিনা। তবে নিউজিল্যান্ড বিনা যুদ্ধে মঞ্চ ত্যাগ করবে না। অতএব আরও একটি টানটান সিরিজের সাক্ষী হবে আপামর ক্রিকেটপ্রেমী।

cricket Mithali Raj
Advertisment