Advertisment

World Cup Football 2018 Trivia: বিশ্বকাপ ট্রিভিয়া, ইতিহাস থেকে- পর্ব ৪

World Cup Football Trivia 2018: আধুনিক ফুটবল এখন আর স্রেফ খেলা নয়, তা এক বিশাল ইন্ডাস্ট্রি। সেখানে অ্যাসেট ম্যানেজ করার লোক আছে, ট্যাকটিক্স -কাউন্টার ট্যাকটিক্স বানানোর লোক আছে, যেনতেন প্রকারেণ রেভিনিউ আনার লোক আছে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Maradona fouled in 1986 (wikipedia source)

১৯৮৬ সালে ফাউলের মুখে মারাদোনা (ছবি- উইকিপিডিয়া)

মিঠুন ভৌমিক

Advertisment

নক আউট পর্বের প্রথম রাউন্ড অর্থাৎ যাকে রাউন্ড অফ সিক্সটিন বলে, তা সদ্য শেষ হয়েছে। মুখোমুখি হওয়া দেশগুলো ছিলো ফ্রান্স-আর্জেন্তিনা, উরুগুয়ে-পর্তুগাল, স্পেন-রাশিয়া, ক্রোয়েশিয়া-ডেনমার্ক, ব্রাজিল-মেক্সিকো, বেলজিয়াম-জাপান, সুইডেন- সুইজারল্যান্ড, এবং, ইংল্যান্ড - কলম্বিয়া। এখন সবাই জেনে গেছেন যে ফ্রান্স, উরুগুয়ে, রাশিয়া, ক্রোয়েশিয়া, ব্রাজিল, বেলজিয়াম, সুইডেন এবং ইংল্যান্ড কোয়ার্টার ফাইনালে খেলবে। এই যে রাউন্ড অফ সিক্সটিন বা পরের পর্ব অর্থাৎ কোয়ার্টার ফাইনাল, এর ইতিহাসও খুব চিত্তাকর্ষক।

১৯৮২ সালের আগে বিশ্বকাপে মোট অংশগ্রহণকারী দেশের সংখ্যাই ছিলো ১৬, এবং দ্বিতীয় রাউন্ডের খেলা অনেক সময়ই গ্রুপ লীগের মত করে খেলা হয়েছে। ১৯৭৮ -এর টুর্নামেন্টে শেষবার ১৬ টি দল নিয়ে খেলা হয়। দলগুলোকে চারটে গ্রুপে ভাগ করে রাউন্ড রবিন পদ্ধতিতে ঠিক হয় কোন দুটো করে দল পরের রাউন্ডে যাবে। এই পর্যন্ত নিয়ম এখনও একই। কিন্তু দ্বিতীয় রাউন্ডে তখন আবার আরেক প্রস্থ রাউন্ড রবিন পদ্ধতিতে খেলা হতো চার গ্রুপের আটটি দলকে দু ভাগে ভাগ করে। সেই দুই গ্রুপের যারা চ্যাম্পিয়ন (পয়েন্ট, গোল পার্থক্য ইত্যাদির নিরিখে) তারা খেলতো ফাইনাল। আর গ্রুপ দুটির দ্বিতীয় স্থানাধিকারী খেলতো তৃতীয়-চতুর্থ স্থানের জন্য।
১৯৭৮ এর বিশ্বকাপ অতীব স্মরণীয় আরো নানাবিধ বিতর্কের জন্য। সেবার খেলার আসর বসেছে আর্জেন্তিনায়। এদিকে ১৯৭৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সামরিক অভ্যুত্থান হয়ে আর্জেন্তিনা তখন রাজনৈতিকভাবে খুবই অস্থির। অভ্যুত্থানের পরে পরেই শোনা যাচ্ছে সাড়ে পাঁচ হাজার মানুষ নিখোঁজ। পরবর্তীকালে জানা গিয়েছে রিভারপ্লেট ফুটবল স্টেডিয়ামের এক মাইল দূরেই ছিলো নবনির্মিত কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প, বন্দিরা খেলার সময় সমর্থকদের উল্লাস শুনতে পাচ্ছিলেন। আর্জেন্তিনার রাজনৈতিক অস্থিরতা গোপন ছিলোনা। হল্যান্ডের মত কোন কোন সেই বিশ্বকাপ খেলতে প্রথমে অস্বীকার করে। গুজব রটে যায় ক্রুয়েফ প্রতিবাদে খেলতে চাইছেন না।

আরও পড়ুন, FIFA World Cup 2018: বিশ্বকাপ ট্রিভিয়া-ইতিহাস থেকে (তৃতীয় পর্ব)

এতো গেল মাঠের বাইরের কথা। মাঠের ভেতরেও এক অত্যন্ত অস্বস্তিকর ব্যাপার হয় যখন আর্জেন্তিনা আর পেরু মুখোমুখি হয়। ব্রাজিল পোল্যান্ডকে ৩-১ হারিয়ে দেওয়ায় আর্জেন্তিনাকে ৪-০ জিততে হতো সেই ম্যাচ। প্রথমত, সেই বিশ্বকাপে আর্জেন্তিনার সব খেলাগুলোই রাখা হয়েছিলো সন্ধ্যায়, যাতে বাকিদের খেলার ফল তারা দেখে নিতে পারে। দ্বিতীয়ত, পেরুর সাথে ম্যাচে তারা ৬-০ জেতে। আট বছর পর সানডে টাইমস লেখে পেরুর খেলোয়াড়দের আর্জেন্তিনার সদ্য জয়ী সামরিক সরকার প্রভূত ঘুষ দিয়েছিলো , যার মোট অর্থমূল্য ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
১৯৮২ সালে এই নিয়মটাই বদলে যায়। ২৪ টা দল নিয়ে ছটা গ্রুপ করে প্রথমে লিগ সিস্টেম, সেই আগের মতই রাউন্ড রবিন। প্রতি গ্রুপ থেকে দুটো করে সেরা দল নিয়ে মোট ১২টা দলকে তারপর আবার চারটে গ্রুপে ভাগ করা হলো। সেই চারটে গ্রুপে আবার রাউন্ড রবিন লিগ খেলার পরে সরাসরি নক আউট সেমিফাইনালের খেলা।
এখনকার যা নিয়ম, অর্থাৎ দ্বিতীয় রাউন্ডের নক আউট খেলা, তা শুরু হয় ১৯৮৬ সাল থেকে। সেবারও ২৪টা দলের প্রতিযোগিতা। ৬ টি গ্রুপের থেকে প্রথম দুটো দল সরাসরি গেল দ্বিতীয় রাউন্ডে। অর্থাৎ এইভাবে ১২ টা দল। বাকি ৪ টে দল বাছা হতো সমস্ত গ্রুপ মিলিয়ে, তাদের বলা হতো "বেস্ট ফোর থার্ডপ্লেস হোল্ডার"। খুবই জটিল প্রক্রিয়া, সন্দেহ নেই। ১৯৮৬ বিশ্বকাপ আরো নানা কারণে মনে রাখার মত। সেবারই প্রথম দক্ষিণ কোরিয়া যোগ্যতা অর্জন করে, এবং তারপর থেকে পরপর সাতটা বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছে। আজ দক্ষিণ কোরিয়া এশিয়ার অন্যতম সেরা ফুটবল শক্তি। অন্যদিকে ১৯৮৬'র বিশ্বকাপে ফুটবল শক্তি হিসেবে হাঙ্গেরির পতনের প্রমাণ হয়ে আছে। দুবারের ফাইনালিস্ট (১৯৩৮, ১৯৫৪), তিনবারের কোয়ার্টার ফাইনালিস্ট (১৯৩৪, ১৯৬২, ১৯৬৬) হাঙ্গেরি তারপর থেকে এখনও পর্যন্ত মাত্র তিনবার বিশ্বকাপ খেলতে পেরেছে, তিনবারই তারা বিদায় নিয়েছে গ্রুপ পর্যায়ে।
১৯৮৬ সাল অবশ্য বেশির ভাগ ফুটবলপ্রেমী মনে রেখেছেন দিয়েগো মারাদোনার জন্য। নোভি কাপাডিয়া লিখেছেন, ১৯৮৬'র পর থেকেই পশ্চিমবঙ্গ ফুটবল সমর্থনে দ্বিধাবিভক্ত হয়। তৈরি হয় আর্জেন্তিনার ফ্যান ক্লাব। তার আগে ১৯৫৮, ১৯৬২ এবং ১৯৭০ এর বিশ্বকাপ দেখার পর থেকে প্রায় গোটা বাংলাই ব্রাজিলের সমর্থক ছিলো। একই সঙ্গে সেবারে ব্রাজিল-ফ্রান্স ম্যাচটাও ফুটবলের ইতিহাসে সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে, যাকে পেলে শতাব্দীর সেরা ম্যাচ বলেছেন। ৬৫০০০ দর্শকের সামনে সেই রোমাঞ্চকর ম্যাচে টাইব্রেকারে খেলার মীমাংসা হয়, যেখানে ব্রাজিলের পক্ষে জিকো, সক্রেতিস এবং ফ্রান্সের পক্ষে প্লাতিনি - তিন কিংবদন্তিই পেনাল্টি মিস করেন। ফ্রান্স জিতে যায়। ১৯৮৬ সালেই পশ্চিমবঙ্গ দেখলো বিশ্বকাপের সরাসরি সম্প্রচার, এবং ততদিনে রঙিন টিভি এসে গেছে।

আরও পড়ুন, World Cup Trivia 2018: বিশ্বকাপ ট্রিভিয়া-ইতিহাস থেকে (দ্বিতীয় পর্ব)

এই পর্ব শেষ করবো অধুনা বিতর্কিত প্লে অ্যাকটিং দিয়ে। এই মুহূর্তে ব্রাজিলের তারকা স্ট্রাইকার নেইমার খুবই সমালোচিত হচ্ছেন তাঁর প্লে অ্যাকটিং এর জন্য। দীর্ঘদিন ধরেই প্লে অ্যাকটিং, অর্থাৎ বিপক্ষের অল্প ফাউলেই বেশি চোট পাওয়ার অভিনয়, ফুটবল স্ট্র্যাটেজিতে জায়গা করে নিয়েছে। এখন নেইমার টাকার অঙ্কে বিশ্বের সবথেকে "দামী" ফুটবলার। ১৯৮৬ সালে ঠিক এই জায়গাটায় ছিলেন দিয়েগো মারাদোনা। সদ্য নেপোলি ইতালিয়ান সিরি এ চ্যাম্পিয়ান হয়েছে। ৮৬'র বিশ্বকাপে খেলতে এসেই অন্যান্য রেকর্ডের সাথে মারাদোনা ফাউলের রেকর্ডেও ঢুকে গেলেন। ১৯৮৬'র বিশ্বকাপে সবথেকে ফাউল করা হলো তাঁকে। একই ম্যাচে সবথেকে বেশিবার ফাউলের রেকর্ডও তার আগেই হয়ে গেছে, ১৯৮২ তে। এবং এখানে আমরা ফুটবলে ফাউল ব্যাপারটার রকমফের একটু আলোচনা করবো। ফুটবল ট্যাকটিক্সে ফাউল খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং কখনো সখনো প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। আধুনিক ফুটবলে রক্ষনাত্মক মিডফিল্ডারদের এখন কাজই হলো দরকার হলেই এইরকম খুচখাচ ফাউল করে খেলার গতি শ্লথ করে দেওয়া বা বিপক্ষের আক্রমণের ছন্দ নষ্ট করে দেওয়া। এ হলো একরকম ফাউল, যা ফুটবলের অপরিহার্য অঙ্গ। আরেকরকম ফাউল আছে, যা চিরকাল বিপক্ষের প্রধান অস্ত্রকে ভোঁতা করে দিতে ব্যবহার হয়ে এসেছে। এইরকম ফাউলের উদ্দেশ্য হলো কড়া ট্যাকলে প্রচণ্ড কোন চোট পাইয়ে দেওয়া, যাতে সেই ম্যাচে সংশ্লিষ্ট ফুটবলার খেলতেই না পারেন। সবথেকে "দামী" ফুটবলার মারাদোনাকে ১৯৮৬ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার একজন মার্কার স্পাইক দিয়ে এমনভাবে মাড়িয়ে দেয় যে মোটা কাপড়ের মোজা, তার ভেতরের ক্রেপ ব্যান্ডেজ ফুটো করে স্পাইক বসে গিয়েছিলো। পেরু ম্যাচে তাঁকে মেরে মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ার পর তাঁর মার্কার লুই রেইনা সাইডলাইনের ধারে অপেক্ষা করছিলেন, দিয়েগো ফিরলেই যাতে তাঁকে আবার মার্ক করা যায়। খেলা কিন্তু অন্যদিকে চলছে তখন, কিন্তু লুই জানতেন তাঁর একটাই কাজ, দিয়েগো মারাদোনাকে খেলতে না দেওয়া।
এই একই জিনিসের পুনরাবৃত্তি আমরা দেখেছি গত কয়েকটা বিশ্বকাপে। ২০১৪ বিশ্বকাপেই নেইমারকে কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচে কলম্বিয়ার জুনেগা হাঁটু দিয়ে মেরে ভার্টিব্রা ফ্র্যাকচার করে দেন। ফলে অবশিষ্ট বিশ্বকাপ মাঠের বাইরেই থাকতে হয় তাঁকে। প্রসঙ্গত ২০১৮ সালের বিশ্বকাপের ব্রাজিল সুইজারল্যান্ড ম্যাচে নেইমারের বিরুদ্ধে ফাউলের সংখ্যা ১০।

আধুনিক ফুটবল এখন আর স্রেফ খেলা নয়, তা এক বিশাল ইন্ডাস্ট্রি। সেখানে অ্যাসেট ম্যানেজ করার লোক আছে, ট্যাকটিক্স -কাউন্টার ট্যাকটিক্স বানানোর লোক আছে, যেনতেন প্রকারেণ রেভিনিউ আনার লোক আছে। ১৯৮৬ সালের পরেও কিন্তু ফিফা এমন কিছুই করে উঠতে পারেনি যাতে করে মাঠে মারাত্মক ফাউল বন্ধ করা যায়। খেলোয়াড়সুলভ মনোভাবের ওপর ভরসা করে প্রতিযোগিতামূলক ফুটবলে তাই আর নিশ্চিন্ত থাকতে পারছেন না ফুটবলারেরা। রোনাল্ডো, নেইমার, সহ অনেক ফুটবলারই ক্রমশ জড়িয়ে পড়ছেন প্লে অ্যাকটিঙে, ক্যামেরায় ধরা পড়ে যাচ্ছে তাঁদের অভিনয়, হাস্যাস্পদ হচ্ছেন অন্যতম কুশলী খেলোয়াড়েরা। ভাবুন তো, স্পাইনাল কর্ডে গুরুতর চোট পেয়ে ২২ বছর বয়সেই যদি নেইমারের ফুটবল জীবন শেষ হয়ে যেত, বা চমকপ্রদ পারফরম্যান্সের আগেই যদি রোনাল্ডো-মেসি চোট পেয়ে ইতিহাস হয়ে যেতেন, ফুটবলের তাতে কম ক্ষতি হতো ? ২০১৮ বিশ্বকাপের ফাউলের ধরনগুলো লক্ষ্য করলে দেখবেন দ্বিতীয়শ্রেণীর ফাউলের সংখ্যা মাত্রাতিরিক্ত বেশি, এবং সূক্ষ্মভাবে, যেন অনিচ্ছাকৃত ফাউল এমনভাবে খেলোয়াড়েরা বুটের স্টাড ব্যবহার করে পায়ের গোড়ালি, চেটোর মত জায়গাগুলোয় আক্রমণ করছেন। এবং তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে খেলোয়াড়েরা হালকা মোলায়েম ছোঁয়াতেই মাটিতে পড়ে ছটফট করছেন, রেফারিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এটা আধুনিক ফুটবলেরই অঙ্গ হয়ে থাকবে, এবং এ নিয়ে বৃথা উত্তেজিত হয়ে লাভ নেই।

ISL 2018 Calcutta Football League Football Trivia
Advertisment