২০২১-এ ইংল্যান্ড সফরে পূজারা, রাহানে একদমই রানের মুখ দেখেননি। সেই সময়েই জাতীয় দলে রূপান্তরপর্ব চালু করতে চেয়েছিলেন ক্যাপ্টেন বিরাট কোহলি। সেই প্ৰথমবার অবশ্য খুল্লামখুল্লা টেস্ট স্কোয়াডে 'ট্রানজিশন' পর্ব নিয়ে সওয়াল করেননি। ২০২০-তে নিউজিল্যান্ড সফরে গিয়েও কোহলির মুখে শোনা গিয়েছিল 'মিনি-ট্রানজিশন' পর্ব। ২০২১-এর অসমাপ্ত সিরিজে ভারত ২-১ এ এগিয়ে ইংল্যান্ড ছাড়ে। সেই সময়েও কোহলি কার্যত জাতীয় দলকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, বহু আলোচিত রূপান্তর পর্বের বিষয়ে।
তবে কোহলির সেই ব্লুপ্রিন্ট বাস্তবায়ন হওয়ার আগেই সব তালগোল পাকিয়ে যায়। সেই সিরিজের ছয় মাসের মধ্যেই কোহলি সীমিত ওভারের ফরম্যাট থেকে নেতৃত্ব হারান। এবং শেষ পর্যন্ত টেস্ট দলের নেতা হিসাবেও সরে দাঁড়ান। আর কোহলি-জমানা খতম হওয়ার পরই 'ট্রানজিশন' নিয়ে কথাবার্তা একদম মাটিতে চাপা পড়ে যায়।
আরও পড়ুন: খোলস ছেড়ে বেরোলেন BCCI প্রেসিডেন্ট বিনি! ভারত হারতেই রোহিতদের নিয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য
কোহলি-রবি শাস্ত্রী জুটি মিডল অর্ডারে বড়সড় রদবদল ঘটানোর জন্য তৈরি হচ্ছিল। তবে কোভিডের কারণে শাস্ত্রী-কোহলির সেই প্ল্যানিং পিছু হঠে। ভাবা হয়েছিল কোহলি-শাস্ত্রী জমানা খতম হতে গেলেও দ্রাবিড়-রোহিত সেই প্ল্যানিং থেকে পিছু হঠবেন না। নতুন কোচ, ক্যাপ্টেনের তত্ত্বাবধানে জাতীয় দলে বোলিং বিভাগ এমন মিডল অর্ডারেও রদবদল প্রত্যাশিত ছিল। নতুন ফাস্ট বোলারদের গ্রুম করে জাতীয় দলে সুযোগ দেওয়ার পাশাপাশি নতুন টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ সাইকেলে একাধিক নতুন মুখকে মিডল অর্ডারে দেখা যাবে- ভাবা হয়েছিল এমনটাই।
তবে আরও একটা ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের সাইকেলের ফাইনালে পৌঁছল ভারত। ব্যর্থ হওয়ার পর টনক নড়ল, 'আরে দলের কোর' টিমটাই তো এক রয়েছে।
আরও পড়ুন: ধোনির প্রশংসা শুনেই জ্বলে উঠল গা! কুরুচিকরভাবে বিতর্কের দাবানল জ্বালিয়ে দিলেন হরভজন
ট্রানজিশন পর্বে হনুমা বিহারিকে সরিয়ে শ্রেয়স আইয়ারের টেস্ট দলের জায়গা পাওয়া, ঋদ্ধিমান সাহার বদলে কেএস ভরতকে টিম ইন্ডিয়ার প্ল্যানিংয়ে নিয়ে আসা- খুচরো এসব বদল সত্ত্বেও জাতীয় দলের মূল কাঠামো কিন্তু অপরিবর্তিত রয়ে গিয়েছে। হনুমা বিহারিকে সরিয়ে দিলেও সেই রাহানে-পূজারাকে আগলে বসে থাকা থেকেই স্পষ্ট ভারত এখনও টপ অর্ডারে কয়েকজনকে ছাড়া ভাবতে পারছে না।
অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে দ্বিতীয় সারির ভারতীয় দলই অজিদের হারিয়ে এসেছিল। ভারতের বেঞ্চ স্ট্রেন্থ কুর্ণিশ কুড়িয়ে নিয়েছিল ক্রিকেট বিশ্বে। তবে ঘটনা হল, টিম ম্যানেজমেন্টের এখনও শক্তিশালী রিজার্ভ বেঞ্চ ব্যবহারে তীব্র অনীহা রয়েছে। আর ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ভারতের রক্ষণাত্মক ভঙ্গি দেখে ইতিমধ্যেই টিম ম্যানেজমেন্টের স্ট্র্যাটেজি তীব্র ধিকৃত।
আরও পড়ুন: কোহলির নেতৃত্ব ছাড়া নিয়ে ফের বয়ান সৌরভের! হৈচৈ ফেললেন এক মন্তব্যেই
ভারতীয়-এ দলের বিদেশ সফর বহুদিন ধরেই বন্ধ। এ দলের ট্যুর থেকেই অতীতে পরখ করে নেওয়া হত, বিদেশে প্রতিকূল কন্ডিশনে খেলার জন্য উপযুক্ত কারা। সেই অনুযায়ী তাঁদের গ্রুম করা হত। ঘটনা হল, সেই সমস্ত ট্যুর আপাতত অবলুপ্তির পথে চলে যাওয়ায় কেএল রাহুল, চেতেশ্বর পূজারা, রাহানেরা অফফর্মে থাকলেও লম্বা সুযোগ পেয়ে যাচ্ছেন। ধারাবাহিকতায় ভুগলেও নির্বাচকরা বাদ দেওয়ার পথে হাঁটছেন না তাঁদের। ঘরোয়া ক্রিকেটে চূড়ান্ত সফল সরফরাজ খান, অভিমন্যু ঈশ্বরণ, রজত পতিদারদের মত তারকাদের সুযোগ দিতে দ্বিধায় ভুগছেন নির্বাচকরা। সূর্যকুমার যাদবের মত সীমিত ওভারের সুপারস্টারদের ক্ষেত্রেও টেস্ট দলের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে ম্যানেজমেন্ট।
জুলাইয়েই ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের মাধ্যমে ভারতের নতুন ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ সাইকেল শুরু হচ্ছে। ক্যারিবীয় সফরে থেকেই ভারতীয় দলে যে একগুচ্ছ পরিবর্তন ঘটছেই, তা এখন থেকেই নির্দ্বিধায় জানিয়ে দেওয়া যায়। ওয়ার্ল্ড কাপে জাতীয় দলকে রোহিত নেতৃত্ব দেবেন। তাই ঠিক এই মুহূর্তে রোহিতকে টেস্টে নেতা ধরেই এগোনো হবে কিনা, তা এখনও স্পষ্ট নয়। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে রোহিত বাইরে বসলে নির্বাচকরা তরুণ যশস্বী জয়সোয়ালকে ডেকে নিতে পারেন টেস্টে। ঘরোয়া ক্রিকেট তো বটেই আইপিএলেও অপ্রতিরোধ্য গতিতে রানের বন্যা বইয়েছেন মুম্বইয়ের তারকা। শুভমান গিলের সঙ্গে ওপেন করতে দেখা যেতে পারে যশস্বীকে।
আরও পড়ুন: জয় শাহের বোর্ডই হারের জন্য দায়ী! আঙুল তুলে প্রকাশ্যে নীতি ঠিক করতে বললেন শাস্ত্রী
এমনকি এখনই না হলেও গিলকে মিডল অর্ডারেও নামিয়ে দেওয়া হতে পারে ব্যাটিং অর্ডারে ভারসাম্য আনার জন্য। এছাড়াও নির্বাচকদের মাথায় রুতুরাজ গায়কোয়াডের নাম-ও ঘোরাফেরা করছে। পাঁচ নম্বরের জন্য ভাবা হতে পারে তাঁকে। বাংলার হয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত পারফর্ম করছেন অভিমন্যু ঈশ্বরণ। তবে নকআউটে সেভাবে জ্বলে উঠতে পারেননি। এই কারণেই রুতুরাজদের সঙ্গে উঠতি তারকাদের ব্যাচে কিছুটা পিছিয়ে পড়েছেন তিনি। যদিও তাঁকে অদূর ভবিষ্যতে জাতীয় দলে তিন নম্বরে দেখা গেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
সরফরাজ খানের মত দুর্ধর্ষ প্রতিভার সমস্যা আবার অন্য। ভারি চেহারার জন্য ফাস্ট বোলারদের বিরুদ্ধে তাঁর ফুটওয়ার্কে খামতি রয়েছে। দেশীয় ক্রিকেটে চালু ধারণা এমনটাই। তবে তাঁকে বাকিদের সঙ্গেই ওয়েটিং লিস্টে রেখে এগোতে পারে টিম ম্যানেজমেন্ট। এছাড়াও দুর্ধর্ষ পারফর্ম করে অপেক্ষায় থাকা তারকাদের মধ্যে রয়েছেন সাই সুদর্শন, রিঙ্কু সিং, তিলক ভার্মা, অভিষেক শর্মা, ইয়াশ ধুলরা। প্রত্যেককেই আগামীদিনের জন্য গ্রুম করা হতে পারে।
আরও পড়ুন: নিজের PR টিমের সাহায্যে বাকিদের কৃতিত্ব কেড়েছেন ধোনি! মাহির বিরুদ্ধে ভয়াবহ অভিযোগ গম্ভীরের
একের পর এক ব্যাটসম্যান জাতীয় দলে সুযোগের অপেক্ষায়। তবে বোলিং বিভাগে চিত্র অন্য। সাম্প্রতিক অতীতেও ভারতের গর্বের বিষয় ছিল বোলিং বিভাগ। তবে হঠাৎ করেই সবকিছু যেন এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। গত কয়েকটা অনুর্দ্ধ-১৯ বিশ্বকাপ ভারতের সামনে একের পর এক নতুন প্রতিভা নিয়ে হাজির করেছিল। তবে বড় মঞ্চে কেউই আলো কেড়ে নিতে পারেননি। কমলেশ নাগারকোটির কেরিয়ার নষ্ট হয়ে গিয়েছে চোট-আঘাতে। শিবম মাভি, কার্তিক ত্যাগিরা ঘরোয়া মঞ্চেই খোঁড়াচ্ছেন। ভারতের হাতে পেস বোলিং অস্ত্র হাতে গোনা- আবেশ খান, উমরান মালিক, অর্শদীপ সিংরাই আপাতত সবেধন নীলমণি।
ভারতের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা যে সুদূরপ্রসারী নয়, তা প্রমাণ হয়ে গিয়েছে বারবার বড় মঞ্চে ব্যর্থতার মাধ্যমে। রবীন্দ্র জাদেজা, আর অশ্বিন, মহম্মদ শামি, মহম্মদ সিরাজ, ঋষভ পন্থ, বিরাট কোহলিদের নিয়ে টেস্ট দলের কোর গ্রুপ একই থাকবে। কেএল রাহুল, ওয়াশিংটন সুন্দর, হনুমা বিহারি, অক্ষর প্যাটেলদের মত তারকাদের নিয়ে অপশনের ভাড়ারও কম নয় ভারতের। বলা হচ্ছে, যে দলে এত অপশন সেক্ষেত্রে সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে টিম ম্যানেজমেন্ট এত অপারগ কেন। তবে সবকিছুর আগে সঠিক নির্বাচক কমিটি বাছাই করা আপাতত বোর্ডের প্রধান অগ্রাধিকার। চেতন শর্মা স্টিং অপারেশন কাণ্ডে সরে যাওয়ার পর আপাতত নতুন নির্বাচক প্রধান নিয়োগকে পাখির চোখ করছে বোর্ড। তারপরেই ভবিষ্যৎ-এর জন্য ব্লুপ্রিন্ট তৈরিতে নামতে হবে। এমনটাই ভাবনা আপাতত।
Read the full article in ENGLISH