নাসার বিখ্যাত অ্যাপোলো ১১ অভিযানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ভারতের চন্দ্রযান-২ চাঁদে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে একাধিক লেজার রিফ্লেক্টর, যেগুলি পৃথিবী এবং চাঁদের মধ্যে সঠিক দূরত্ব মাপতে সাহায্য করবে, জানিয়েছে Space.com নামের ওয়েবসাইট। নিজের অনবোর্ড প্রোপালশন সিস্টেম চালু করে দিয়ে চন্দ্রযান-২ উচ্চতর কক্ষপথে প্রবেশ করল। এই নিয়ে তৃতীয়বার নিজের কক্ষপথের উচ্চতা বাড়াল এই মহাকাশযান, যা চাঁদের বুকে পদার্পণ করার আগে বিভিন্ন জটিল প্রক্রিয়ার একটি।
অগাস্ট মাসের ২০ তারিখে চাঁদের কক্ষপথে প্রবেশ করার কথা চন্দ্রযান-২ এর, এবং সব ঠিকঠাক চললে ৭ সেপ্টেম্বর চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে 'সফট ল্যান্ডিং' হওয়ার কথা। কিন্ত সেসব কিছু হওয়ার আগে ইসরো'র এই মহাকাশযানকে লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে অসংখ্য জটিল প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। তার কারণ, ভারতের সবচেয়ে শক্তিশালী লঞ্চার ভেহিকল GSLV Mk-III এর এত ক্ষমতা নেই যে এক ধাক্কায় চন্দ্রযান-২ কে চাঁদে পৌঁছে দেবে।
এই প্রক্রিয়াগুলির অধিকাংশই উৎক্ষেপণের প্রথম ২৫ দিনের মধ্যে সম্পন্ন হবে। এই সময়ের মধ্যে ধাপে ধাপে পৃথিবীর চারপাশে নিজের কক্ষপথের উচ্চতা বাড়াতে থাকবে চন্দ্রযান, যার ফলে সেটি আগামীদিনের জন্য শক্তি সঞ্চয় করতে পারবে।
চাঁদে লেজার রেফ্লেক্টর নিয়ে যাচ্ছে চন্দ্রযান-২
১৯৬৯ সালে অ্যাপোলো ১১-র মহাকাশচারীরা চাঁদে রেখে আসেন লুনার লেজার রিফ্লেক্টর, যেগুলির মধ্যে ছিল ১০০ টি ছোট প্রিজম বা ত্রিপার্শ্ব কাচ। উদ্দেশ্য ছিল, পৃথিবীতে বসে বিজ্ঞানীরা এই প্রিজমগুলির দিকে লেজার রশ্মি ছুড়ে আমাদের গ্রহ এবং চাঁদের মধ্যে দূরত্ব নির্ধারণ করবেন। কয়েক দশক পরে চন্দ্রযান-২ ফের একবার লেজার রিফ্লেক্টর নিয়ে রওয়ানা দিয়েছে চাঁদের দিকে।
অল্প কথায় বলতে গেলে, লেজার রেঞ্জিং রেট্রো-রিফ্লেক্টর এমন এক ধরনের আয়না যা যে কোনও আলোর রশ্মিকে সেদিকেই প্রতিফলিত করে যেদিক থেকে সেটি এসেছে, কোনোরকম বাহ্যিক শক্তির উৎস ছাড়াই।
Space.com এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইসরো-কে একধরনের বিশেষ লেজার রেট্রো-রিফ্লেক্টর সরবরাহ করেছে নাসা (NASA), যেগুলি বসানো হয়েছে চন্দ্রযানের বিক্রম ল্যান্ডারে। নতুন এই মাইক্রো রেট্রো-রিফ্লেক্টরের এক একটির ওজন মাত্র ২২ গ্রাম।
এক ঝলকে চন্দ্রযান-২ এর গতিপথ
* জুলাই ২২: ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন (ইসরো) দ্বারা উৎক্ষেপিত চন্দ্রযান-২ উৎক্ষেপণের ১৭ মিনিটের মধ্যে পৃথিবীর সঙ্গে যুক্ত ডিম্বাকার কক্ষপথে ঘুরতে শুরু করে
* জুলাই ২৪: প্রথমবার কক্ষপথের উচ্চতা বাড়ায় চন্দ্রযান-২, পৌঁছে যায় ২৩০ কিমি x ৪৫,১৬৩ কিমি কক্ষপথে
* জুলাই ২৬: দ্বিতীয়বার কক্ষপথের উচ্চতা বাড়িয়ে এবার ২৫১ কিমি x ৫৪,৮২৯ কিমি হয়ে যায়
* জুলাই ২৯: তৃতীয়বার উচ্চতা বাড়ে কক্ষপথের, হয়ে যায় ২৭৬ কিমি x ৭১,৭৯২ কিমি
* অগাস্ট ২: কক্ষপথ হবে ২৪৮ কিমি x ৯০,২২৯ কিমি
* অগাস্ট ৬: পঞ্চম এবং শেষবারের মতো পৃথিবীর সঙ্গে যুক্ত কক্ষপথের উচ্চতা বাড়াবে চন্দ্রযান, পৌঁছে যাবে ২২১ কিমি x ১,৪৩,৫৮৫ কিমি কক্ষপথে, যেখানে সেটি ঘুরবে ১৪ অগাস্ট পর্যন্ত
এর পরে পৃথিবীর সঙ্গে যুক্ত কক্ষপথ থেকে সরে যাবে চন্দ্রযান-২, এবং চাঁদের দিকে এগোবে। চাঁদের প্রভাব গোলকে (sphere of influence) প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে চালু হবে অনবোর্ড প্রোপালশন সিস্টেম, যাতে কমে আসে মহাকাশযানের গতি। এর ফলে চাঁদের চারপাশে প্রাথমিক কক্ষপথে প্রবেশ করতে পারবে চন্দ্রযান।
এরও পরে অরবিটারের থেকে আলাদা হয়ে যাবে ল্যান্ডার, এবং চাঁদের চারপাশে ১০০ কিমি x ৩০ কিমি কক্ষপথে প্রবেশ করবে, যার পরে গতি কমানোর জন্য একাধিক "জটিল ব্রেক কষার" প্রক্রিয়ার পরেই চাঁদের দক্ষিণ মেরু অঞ্চলে ৭ সেপ্টেম্বর অবতরণ করবে সেটি।
চন্দ্রযান-২ এর চন্দ্র অভিযান
চাঁদের ওপর সফলভাবে অবতরণ করলে ল্যান্ডারের ভেতর থেকে বেরোবে রোভার, যা চাঁদের মাটিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাবে একটা গোটা দিন, যা পৃথিবীর ১৪ দিনের সমান। অরবিটার তার অভিযান চালিয়ে যাবে এক বছর ধরে। অরবিটারটি থাকবে চাঁদের উপরের অংশে। সেখান থেকে বিভিন্ন খনিজের ছবি তুলবে ও ম্যাপিং করা হবে। বিক্রম অর্থাৎ ল্যান্ডারটি চাঁদের ভূমিকম্প এবং তাপমাত্রা সংক্রান্ত বিষয়ে পর্যবেক্ষণ জারি রাখবে। পাশাপাশি, রোভারটি চলমান যানের মাধ্যমে চাঁদের মাটির পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে। উল্লেখ্য এই নিয়ে দ্বিতীয়বার চন্দ্র অভিযানে নাম লেখাল ইসরো। এর আগে ২০০৮ সালের ২২ অক্টোবর উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল চন্দ্রযান-১।