/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2020/03/2020-03-27-1.jpg)
গত সপ্তাহান্তে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ৪৫০ ছুঁতেই ভারতবাসীকে সচেতন হতে বলা হয়েছে। এই সংক্রমণ ছড়ানোর বিষয়টি যাতে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তার জন্য সকলের সাহায্য চাওয়া হয়েছে। এ মহামারির সঙ্গে লড়তে নেওয়া হয়েছে লকডাইনের ব্যবস্থা, চলাফেরায় এসেছে বাধা, জারি হয়েছে কার্ফু, সঙ্গে মিলেছে বাড়ি থেকে কাজ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশিকা। তারই পাশাপাশি, প্রতি মিনিটে আসছে কোভিড-১৯ মহামারি সংক্রান্ত নিত্য নতুন খবর। যা কি না দরজা খুলে দিচ্ছে প্রচুর ভুল, অপ্রয়োজনীয় তথ্যের।
এর প্রেক্ষিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাজেশন) মানুষকে ভুল তথ্যের ‘ইনফোডেমিক’, অর্থাৎ, অতি তথ্যের বাড়বাড়ন্তের বিষয়ে সাবধান হওয়ার বার্তা দিয়েছে। ইনফোডেমিক কিংবা ‘তথ্যের মহামারি’ মানুষকে ‘‘বিশ্বাসযোগ্য তথ্যভাণ্ডার চিনে নেওয়া থেকে বিভ্রান্ত করে,’’ বলেই মত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞদের। এ দিকে কোভিড-১৯ অতিমারি সংক্রান্ত নানা তথ্যের ভিড়ে কাজ করতে গিয়ে রীতিমতো হাবুডুবু অবস্থা ইংরেজি এবং উপমহাদেশের দশটি ভাষায় কাজ করা উইকিপিডিয়ার সম্পাদকদের।
উইকিপিডিয়া এবং এই গোত্রের কিছু প্রকল্প ‘ওপেন এডিটিং’ ব্যবস্থা মেনে চলে। যে কোনও তথ্যে পক্ষপাত নিয়ন্ত্রণ করতেই সাধারণের জন্য খুলে রাখা হয় এই সব ওয়েবসাইটের তথ্য সম্পাদনার সুযোগ। এই ব্যবস্থায় যে কোনও সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক মতামত সম্পন্ন মানুষকে এই সব তথ্যে নিজেদের অভিমত যোগ করতে দেওয়া হয়। উদ্দেশ্য একটাই, যাতে দেশ-কাল-পাত্র নির্বিশেষে সকলে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক থেকে শুরু করে হালফিলের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পক্ষপাতহীন তথ্য পেতে পারেন।
কিন্তু করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত তথ্য নিয়ে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। উইকিপিডিয়ার স্বেচ্ছাসেবী সম্পাদক অভিষেক সূর্যবংশী বলেছেন, ‘‘করোনা ভাইরাস ঠিক কী? যা যা তথ্য পাচ্ছি, তার কতটা সত্যি এবং কতটা আষাঢ়ে গপ্পো, তা বুঝতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহায্য চাইছি এখন আমরা। মূলত উপমহাদেশের বিভিন্ন ভাষায় যে সব তথ্য পাচ্ছি, তা অনুবাদ এবং সম্পাদনার সময়ে একটু বেশিই ভাবনা হচ্ছে।’’
উইকিপিডিয়ায় তৈরি হওয়া ‘স্বাস্থ্য’ ( SWASTHA) নামক একটি নতুন গোষ্ঠীর সদস্য অভিষেক। এই দলটি স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নানা অতি প্রয়োজনীয় তথ্য সাধারণ ভারতীয়দের কাছে সহজে নির্ভুল ভাবে পৌঁছে দেওয়ার জন্য কাজ করছে। ভারতে করোনা ভাইরাসের প্রকোপ নিয়ে ইংরেজি ভাষার উইকিপিডিয়ায় বেরনো লেখার সম্পাদনা করেছে এই দলটি। গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে সে লেখা দিনে গড়ে ২ লক্ষ বার দেখা হয়েছে গোটা বিশ্বে। তবে ভারতীয় ভাষাগুলিতে এ ধরনের অনলাইন তথ্যের জোগান অনেকটাই কম বলে জানা যাচ্ছে এই ‘স্বাস্থ্য’ গোষ্ঠীর কাজের মাধ্যমে। বিশ্বজুড়ে এমন স্বাস্থ্য সঙ্কটের সময়ে যা কি না অত্যন্ত সমস্যার এবং চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ এমন গুরুতর পরিস্থিতিতে সকলেরই নিজের ভাষায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানতে পারা খুব জরুরি।
জাতীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রকের সঙ্গে কাজ করছেন উইকিপিডিয়ার ‘স্বাস্থ্য’ প্রকল্পের স্বেচ্ছাসেবীরা। পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক স্তরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় এবং সুইৎজারল্যান্ডের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহামারি নিয়ন্ত্রণ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গেও চলছে কাজ। অভিষেকের বক্তব্য, এই হারে মহামারির প্রকোপ বাড়তে থাকলে স্থানীয় মানুষকে সাহায্য করার জন্য আরও বেশি করে ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক সহকারী সংস্থাগুলির সহযোগিতার প্রয়োজন হবে।
আঞ্চলিক স্তরে যে সব সংস্থা বা গোষ্ঠী এই কাজের সঙ্গে যুক্ত হবে, তাদের জেনে রাখা দরকার, ‘স্বাস্থ্য’ হল উইকিপিডিয়ারই আরও বড়সড় উদ্যোগ, উইকিপ্রোজেক্ট মেডিসিনের একটি বিশেষ শাখা। এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন বিশ্বের নানা প্রান্তের চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞেরা। ইতিমধ্যে উইকিপ্রোজেক্ট মেডিসিন বিভিন্ন ভাষায় চিকিৎসা সংক্রান্ত পঁয়ত্রিশ হাজারেরও বেশি গুরুত্বর্পূণ লেখা প্রকাশ করেছে। সে সব লেখায় ক্রমাগত নজর রাখছেন দেড়শোরও বেশি সম্পাদক।
২০১৪ সালে ইবোলা ভাইরাস নিয়ে সঙ্কট যখন তুঙ্গে, তখন উইকিপ্রোজেক্ট মেডিসিনের স্বেচ্ছাসেবীরা পঞ্চাশটিরও বেশি ভাষায় ইবোলা সংক্রান্ত লেখাটি অনুবাদ করেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল একটাই, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলির মানুষজন যাতে নিজেদের ভাষায় এই ভাইরাস সম্পর্কে কিছু বিশ্বাসযোগ্য, পক্ষপাতহীন তথ্য পেতে পারেন। এই প্রচেষ্টা বিশেষ জায়গা পায়, যখন নিউ ইয়র্ক টাইমস উইকিপিডিয়াকে ইবোলা সংক্রান্ত অতি নির্ভরযোগ্য অনলাইন তথ্যভাণ্ডারের মধ্যে একটি বলে গণ্য করে সম্মানিত করে। ‘উইকিপ্রোজেক্ট মেডিসিন’-এর সঙ্গে ‘স্বাস্থ্য’ গাঁটছড়া বাঁধার ফলে, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাওয়া করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত তথ্য উপমহাদেশের নানা ভাষায় অনুবাদ করতে অনেকটা সুবিধে হবে।
গোটা বিশ্বেই যথেষ্ট গুরুত্ব পাচ্ছে উইকিপিডিয়ার উদ্যোগে হওয়া করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত এই কাজ। গত জানুয়ারি মাস থেকে প্রায় ২০০ কোটি ভিউ পেয়েছে ইংরেজি ভাষায় এই মহামারি সংক্রান্ত মূল লেখাটি। তবে ‘স্বাস্থ্য’-এর স্বেচ্ছাসেবকেরা উইকিডেটা নামক একটি কম পরিচিত প্রকল্পের জন্যও কাজ করেন। নিয়মিত সেখানে তথ্যের জোগান বাড়ান এবং প্রয়োজন মতো তা সম্পাদনাও করেন। এখানে অ্যামাজনের অ্যালেক্সার মতো যে কোনও বিষয়ে সাধারণজ্ঞান অর্জনের জন্য বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়। উইকিপিডিয়ায় প্রকাশিত কোভিড-১৯ সম্পর্কে ভুল তথ্য সংক্রান্ত ইংরেজি লেখাটিও বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় অনুবাদের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এই দলটি।
উইকিমিডিয়া ফাউন্ডেশন নামক একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা উইকিপিডিয়া চালনা করে। সেই সংস্থার চিফ প্রডাক্ট অফিসার টোবি নেগরিন জানান, করোনা ভাইরাস নিয়ে করা ‘স্বাস্থ্য’র কাজ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষকে সাহায্য করবে। এর মাধ্যমে কোটি কোটি ভারতবাসী নিজেদের মুখের ভাষায় স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়ে যাবেন। আগামী দিনে উইকিমিডিয়ার বিভিন্ন লক্ষ্য পূরণ করার ক্ষেত্রেও বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে ‘স্বাস্থ্য’-এর স্বেচ্ছাসেবকদের অবদান। ‘‘আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে গোটা বিশ্বের দরবারে বিনামূল্যে তথ্য প্রদানের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ভাণ্ডার হয়ে উঠতে চাই আমরা। নয়াদিল্লি থেকে বার্লিন, সান ফ্রান্সিসকো— সর্বত্র যেন আমাদের উপরেই নির্ভর করা হয়। সেই কাজে আমাদের ভরসা সুযোগ্য ও নিবেদিত এই স্বেচ্ছাসেবীরাই, যাঁরা ‘স্বাস্থ্য’-এর মতো নানা প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন বিশ্বজুড়ে। আমার কর্মীরা আপাতত এই স্বেচ্ছাসেবী সম্পাদকদের কাজ মসৃণ করার জন্য নানা রসদ এবং সরঞ্জাম তৈরিতে ব্যস্ত। এঁদের সকলের কাজের জোরেই, উইকিপিডিয়ার মাধ্যমে উন্নত মানের তথ্য পাবে গোটা দুনিয়া।
SWASTHA বা ‘স্বাস্থ্য’-এর পুরো নাম হল ‘স্পেশ্যাল উইকিপিডিয়া অ্যাওয়্যারনেস স্কিম ফর দ্য হেলথকেয়ার অ্যাফিলিয়েটস’। এই প্রকল্পটি চালু হয়েছে গত জানুয়ারি মাসে, ঠিক যে সময়ে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ চুপিসারে ছড়িয়ে পড়ছিল গোটা বিশ্বে। অভিষেক বলেন, ‘‘স্বাস্থ্যের কাজ শুরু করার সময়ে আমরা কেউই ভাবিনি করোনা ভাইরাস এমন ভয়াবহ আকার নেবে। এই সময়ে আমাদের কাজ শুরু করাটা খানিকটা সমাপতনই বলা চলে।’’