চন্দন বিশ্বাস
শুধুমাত্র ঘুরে বেড়ানো বা যদি আরও একটু বিশদে বলতে গেলে এক্সপ্লোরেশনের কি কোনো সংজ্ঞা থাকে? মনে তো হয় না। ইচ্ছেমত ঘুরে বেড়ানোকে নিয়মকানুনে বেঁধে ফেললে সেটা আর ইচ্ছেমত থাকল কই? সেটা তো তখন গতানুগতিক কাজের বাইরে আর কিছুই না। আমার ইচ্ছেটা ছিল নর্মদা নদীটাকে একটু এক্সপ্লোর করা, নদীর অববাহিকার অধিবাসীদের সম্পর্কে একটু জানা, কিছুদিন তাদের সঙ্গে তাদের বাড়িতে থাকা, বর্ষাকালে অববাহিকার পরিবেশ ও প্রকৃতির পরিবর্তনটা চাক্ষুষ করা। আমি সেই উদ্দেশ্যে মাসদুয়েক আগে হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত নিই নর্মদা নদীর মোহনা থেকে উৎস পর্যন্ত হেঁটে যাব। অর্থাৎ গাল্ফ অফ খাম্বাট থেকে অমরকণ্টক।
সামান্য পড়াশুনা শুরু করে দিলাম। চলে এল ‘নর্মদা পরিক্রমা’র কথা:
“নর্মদা পরিক্রমা দু'ই প্রকারঃ--- রুণ্ডা পরিক্রমা, জলে-হরি পরিক্রমা।
রুণ্ডা পরিক্রমা--- নর্মদাতটের যে কোন ঘাট হতে পরিক্রমা আরম্ভ করে নর্মদা মাতাকে দক্ষিণাবর্তে রেখে উভয়তট ঘুরে পুনরায় ঐ ঘাটে এসে সংকল্পমুক্ত হতে হয়।
জলে-হরি পরিক্রমা--- সমুদ্র-রেবা সংগমস্থল হরিধাম বা বিমলেশ্বর হতে পরিক্রমা আরম্ভ করে অমরকণ্টকে শেষ কিংবা অমরকণ্টক হতে আরম্ভ করে বিমলেশ্বর-জ্যোতির্লিঙ্গ পর্যন্ত পরিক্রমা।”
- তপোভূমি নর্মদা, শৈলেন্দ্র নারায়ণ ঘোষাল শাস্ত্রী (?)
কোনদিক থেকে কীভাবে পরিক্রমা করতে হবে শুধুমাত্র তাই নয়, ‘নর্মদা পরিক্রমা’র রয়েছে হাজারো নিয়মকানুন। যেমন,
*পরিক্রমা চলাকালীন একটি বোতলে নর্মদার জল সর্বক্ষণ বহন করতে হবে।
*সম্পূর্ণ নিরামিষ খাবারদাবার খেতে হবে এবং মদ্যপান চলবে না।
*পরিক্রমা চলাকালীন কোনোমতেই নর্মদা নদীকে পেরোনো চলবে না।
*পরিক্রমা শুরু এবং শেষদিন নর্মদা নদীকে পুজো করতে হবে।”
রয়েছে কিছু অতি উদ্ভট নিয়মকানুনও। যেমন,
“পরিক্রমা চলাকালীন কোনো চেয়ারে বসা যাবে না। দাড়িগোঁফ কেটে, মাথা ন্যাড়া করে পরিক্রমা করতে হবে। পরিশেষে নর্মদা পরিক্রমা চলাকালীন যৌনসঙ্গম চলবে না।”
নিয়মকানুন জেনেই ক্লান্ত হয়ে গেলাম, পরিক্রমা করব কী? তার থেকে আমার ইচ্ছেমত ঘুরে বেড়ানোই মঙ্গল।
পরিকল্পনা শুরু করে দিলাম। নর্মদা নদী মূলত মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র এবং গুজরাটের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হলেও অববাহিকা ছড়িয়ে আছে গুজরাট, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ এবং ছত্তিসগড় এই চার রাজ্যে। সাতপুরা এবং বিন্ধ্য পর্বতমালার বুক চিরে বয়ে গিয়েছে এই পশ্চিমবাহিনী নদী। উৎস মধ্যপ্রদেশ এবং ছত্তিসগড়ের সীমান্তে অমরকণ্টক। শেষ হয়েছে গুজরাটে, আরব সাগরের গাল্ফ অফ খাম্বাটে। রয়েছে শূলপানেশ্বর ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি, সাতপুরা ন্যাশনাল পার্ক, আচানকমার ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি। সরদার সরোবর ড্যাম, ইন্দিরা সাগর সরোবর ড্যাম, বার্গি ড্যাম। সরকার বাহাদুর ভালোবেসে ড্যাম দিয়েই বাঁধিয়ে দিয়েছেন নর্মদাকে।
অথচ ভারতের ইতিহাস এবং ভৌগোলিক অবস্থানে নর্মদার গুরুত্ব অপরিসীম। প্রায় ১৩০০ কিলোমিটার লম্বা এই নর্মদা নদী দিয়েই উত্তর এবং দক্ষিণ ভারত ডিমার্কেশন করা হয়। এই নর্মদা - বিন্ধ্যপর্বতের জন্যেই আর্যরা দক্ষিণ ভারত আক্রমণ করতে পারেনি, ফলে দক্ষিণ ভারতের সংস্কৃতি রয়েছে অটুট। সম্প্রতি আরও একটি তথ্য পেলাম, ভারতের প্রায় সবকটি প্রধান নদীতেই ওয়াটার অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসের আয়োজন করা সম্ভব হলেও নর্মদায় কোনোদিনও সম্ভব হয়নি হঠাৎ হঠাৎ নাব্যতার কারণে। অর্থাৎ রাস্তা সুগম নয়। তাতে আমার খুব বেশি কিছু যাবে-আসবে বলে মনে হয় না। বড়জোর অসফল হয়ে চলে আসব। যাচ্ছি তো এক্সপ্লোর করতে, সাফল্যের সংজ্ঞা এক্সপ্লোরেশনে খানিকটা বদলে যেতে বাধ্য। এবং আমার নিয়ম মেনে নর্মদা পরিক্রমাও নয়। উত্তর তট বা দক্ষিণ, যখন যেদিকে সুবিধা সেদিক দিয়ে খুশি হাঁটব।
সময়টা হয়তো উপযুক্ত নয়। বর্ষাকালে হঠাৎ বন্যার পরিস্থিতি আসতেই পারে। সাপ, গোসাপ এবং অন্যান্য বন্যজন্তুর আক্রমণের সম্ভাবনাও বেশী। কিন্তু সেক্ষেত্রে মাথায় রাখব আমি যাচ্ছি তাদের কাছে উপদ্রব হয়ে, তারা আমার বাড়ি আমায় জ্বালাতে আসেনি। আর বিপদ আসতে পারে সেটা জেনেই তো বেরোনো। নইলে তো বাড়ি বসে থাকলেই হত।
তথাকথিত নর্মদা পরিক্রমা নয়। পুণ্যার্থে যাত্রা তো আরোই নয়। খেয়ালখুশি মতই হাঁটার পরিকল্পনা। হয়তো ১৩-১৪ জুলাই ২০১৮ জার্নি শুরু করব। লাগবে প্রায় দুমাস। প্রতিদিন ২৫-৩০ কিলোমিটার হাঁটব। ভোজনং যত্রতত্র, শয়নং হট্টমন্দিরে। খাসা পরিব্রাজক জীবন।