Advertisment

ঈশ্বরের ঘর-বাড়ি

একজন বাঙালি, যার কিনা প্রবল পাহাড়প্রেম, ষাট বছর বয়সে পৌঁছেও দার্জিলিং গিয়ে উঠতে পারেনি। তার জীবনে, চোখের সামনে যে অভিভূত হওয়ার এমন এক আয়োজন ঈশ্বর সাজিয়ে রেখেছেন, তা বুঝিয়ে বলার জন্য কিছুটা প্রাককথন বোধহয় জরুরি।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

পাহাড়ি চাঁদ কি অন্যরকম? (ফোটো- লেখক)

পাহাড়ের টান, বিশেষত উত্তরবঙ্গ, সেটাও এতটাই যে জন্মকর্মের শহর ছেড়ে, একেবারে শিকড় উপড়ে পাকাপাকি এখানেই চলে আসা! এরপরও যদি কেউ বলে এখনও দার্জিলিং যাইনি, তাহলে সেটা হজম না হওয়ারই কথা। উত্তরবঙ্গে আমার আসা যাওয়া প্রায় দু'দশক ধরে। পাকাপাকি থাকা শুরু বছর দুয়েক। এতোগুলো বছর ধরে বন্ধু ও চেনাজানা লোকজনের এহেন অবাক প্রশ্নের জবাব দেওয়া প্রায় রুটিনে দাঁড়িয়েছিল। অথচ দার্জিলিং যাব না, তেমন কোনও কঠিন প্রতিজ্ঞা যে আমার ছিল সেটাও নয়। একটা ভয় অবশ্য ছিল - দার্জিলিং, দিঘা আর পুরী বাঙালির কমন ইন্টারেস্ট। যার মানে প্রচুর জনসমাগম। মিথ্যে বলবো না, এই ভিড় ব্যাপারটা নিয়েই যা কিছু দ্বিধা, সংশয়। অনেকটা এই কারণেই পাহাড়ের রানি দার্জিলিংকে বেড়ানোর উইশ লিস্টে রাখা হয়ে ওঠেনি এতদিন।

Advertisment

দার্জিলিং এবং কাঞ্চনজঙ্ঘা। টাইগার হিল থেকে সেই কাঞ্চনজঙ্ঘা দর্শন, সূর্যের উদয় ও অস্তকালে, সেও তো এক মহিমাময় অভিজ্ঞতা! লোকজন এটাও কতবার যে গুনগুন করেছে কানে! এর আগে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জায়গা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখেছি। তবে দার্জিলিং থেকে তার দর্শন নিঃসন্দেহে অভিনব। সেই দর্শন-খিদেটাও দিন দিন প্রবল হচ্ছে টের পাচ্ছিলাম।

আরও পড়ুন: থাসার ইকোটুরিজম: বাকহুইটের রুটি, চাকভাঙা মধু দিয়ে ব্রেকফাস্ট এবং…

পাঠক ভাবছেন দার্জিলিং যাওয়া নিয়ে এত ভূমিকা? আসলে এটা না হলে যাওয়ার পরের অনুভূতিটা বোঝানো অসম্ভব। একজন বাঙালি, যার কিনা প্রবল পাহাড়প্রেম, ষাট বছর বয়সে পৌঁছেও দার্জিলিং গিয়ে উঠতে পারেনি। তার জীবনে, চোখের সামনে যে অভিভূত হওয়ার এমন এক আয়োজন ঈশ্বর সাজিয়ে রেখেছেন, তা বুঝিয়ে বলার জন্য কিছুটা প্রাককথন বোধহয় জরুরি।

publive-image চার মহিলার যাত্রাপথে (ফোটো - লেখিকা)

চারজনের এক মহিলা টিম নভেম্বরের এক হিমসকালে ফুরফুরে মেজাজে যাত্রা শুরু করলাম। গাড়ি সুকনা জঙ্গলে পৌঁছতেই বদলে গেল দুপাশের দৃশ্যপট। ঘন জঙ্গল, আকাশছোঁয়া গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়ে রোদ্দুর উঁকি মারছে। পাখির কিচিরমিচির, ঝিঁঝির ডাক শুনতে শুনতে জঙ্গল পার হলাম। রোহিনী হয়ে গেলে পথ সংক্ষেপ হয়। কিন্তু সেটা হলো না। বিশেষ কারণে নো এন্ট্রি, পুলিশের কয়েকজন আধিকারিকও দাঁড়িয়ে। অতএব পথ বদল। পুরোনো পাঙ্খাবাড়ি হয়েই যাওয়া।

এই যাত্রায় অসংখ্য হেয়ারপিন বেন্ড, আর শুধুই চড়াই। একপাশে আকাশছোঁয়া পাহাড়ের প্রাচীর, অন্যদিকে গভীর খাদ। ড্রাইভার আদিত্য বহুবার দার্জিলিং গেছে। ফলে, একেবারে মুখস্থ সিলেবাস ধরেই তার হাতে গাড়ি এগিয়ে চললো। পথের পাশে ছোট ছোট গ্রাম। একটি-দুটি দোকান। নির্জন পথ ধরে কখনও একা পথচারী, কোথাও দল বেঁধে কাজে যাওয়া হাসিমুখের মহিলা। এদিক ওদিক খেলছে কুচোকাঁচার দল, একটু বড়রা স্কুলের পথে। পাহাড়ী জনজীবনের নিপুণ এইসব ছবি দেখতে দেখতে পৌঁছে যাই কার্শিয়াং।

publive-image এখানে আকাশ নীল (ফোটো - লেখিকা)

এবার হঠাৎ করেই যেন ছন্দপতন। ঘিঞ্জি রাস্তা, গাড়ির হর্ন, দোকানবাজারে ঠাসা এক শহর। ক্যানভাসে পাহাড় আছে, এই যা শান্তি। শহর পার হয়ে আবার নির্জন পথ। নানা বাঁক ঘুরে গাড়ি এগিয়ে চলেছে। সূর্যের উত্তাপ সামান্য টের পাওয়া যায়। সঙ্গে উত্তুরে হাওয়ার কাঁপন। মনটা 'চা চা' করছে সকলেরই। গাড়ি থামে পথের ধারের ছোট্ট দোকানের সামনে। দুই নেপালি মহিলার একজন ব্যস্ত মোমো তৈরিতে। আর একজন চা বানালেন। চায়ের কাপ মুখে তুলেছি, হঠাৎই চোখ আটকে গেল পথের বাঁদিকে। রবিন ব্লু আকাশে শুচিশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা। যেন রীতিমতো ঘোষণা, 'আমায় দেখো'! অনেকটা দূর ছড়ানো সেই রেঞ্জ দেখে মন পাগলপারা। ফটাফট ছবি, সেলফি তুলে গাড়িতে উঠি।

শিলিগুড়ি থেকে ছাড়ে দার্জিলিংয়ের মুখ্য আকর্ষণ, পৃথিবী বিখ্যাত টয় ট্রেন। পোশাকি নাম দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে। সাপের মতো আঁকাবাঁকা ও সরু লাইন, যার শেষ দার্জিলিংয়ে। কার্শিয়াং থেকেই এই রেললাইন অধিক দৃশ্যমান। ট্রেনও দেখতে পেলাম, তাতে হাসিখুশি মুখের ট্যুরিস্ট, সপরিবারে। মাঝে ছোট ছোট কয়েকটি স্টেশন। শুধু জয় রাইড নয়, কাজেকম্মেও স্থানীয় মানুষ যাতায়াত করছেন দেখলাম। এ যাত্রায় আমার অবশ্য টয় ট্রেন চড়া হয়নি। আগাম টিকেট বুকিং না করে আজকাল টয় ট্রেনে জায়গা পাওয়া যায় না। শুনলাম ব্ল্যাকে চড়া দামে টিকেট মেলে, যাতে আমাদের তেমন উৎসাহ নেই।

এবারের মতো তাই স্টেশন দেখেই সাধ মেটে। ঘুম স্টেশন এখন ঝাঁ চকচকে। তবে হেরিটেজ লুকটা টিকিয়ে রাখা হয়েছে। যেটা বাতাসিয়া লুপের ক্ষেত্রে কিছুটা বিলুপ্ত। সৌন্দর্যায়নের সৌজন্যে এই অতি প্রাচীন স্টেশনের চরিত্র কোথায় যেন উধাও। আমি যদিও এই প্রথম দেখলাম, তবে ছবি দেখে একটা কল্পনা তো থাকে। আমার টিমের বাকিরা আগে দেখেছেন। ফলে তাঁরা বেশ হতাশ। এখানে একটা তথ্য খুব জরুরি, বাতাসিয়া লুপ ঘিরে রয়েছে ওয়ার মেমোরিয়াল, এই সৌধটি দেখা দারুণ এক অভিজ্ঞতা।

publive-image এই সেই পর্বতমালা (ফোটো - লেখিকা)

টয় ট্রেন ছাড়া বরাবর সঙ্গে আছে  কাঞ্চনজঙ্ঘা। বারবার দেখেও মেটে না আশ। তখনও জানি না, আরও কত বিস্ময় অপেক্ষা করে আছে সামনের দিনগুলিতে। প্রসঙ্গত, আমি ছাড়া বাকি তিনজনেই এর আগে এক ও একাধিকবার দার্জিলিং ঘুরে গেছেন। তাঁদের অভিজ্ঞতালব্ধ ধারাবিবরণী কানে আসবে যাত্রাপথে, এটা প্রত্যাশিতই ছিল। সেই গাইডেন্স না থাকলেও অবশ্য কোনও সমস্যা ছিল না। দার্জিলিং-এর একটা আশ্চর্য ম্যাজিক আছে, সেটা কাছে গেলেই টের পাওয়া যায়। এছাড়া বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য তিনি তো আছেনই। পথ যেমন যেমন ওপরে উঠেছে, বাঁক ঘুরেছে, তেমন তেমন রূপের অতীত অরূপ রসের বন্যা বইয়ে দিয়ে আকাশে উদ্ভাসিত হয়েছেন কাঞ্চনজঙ্ঘা।

আমাদের থাকার জন্য নির্দিষ্ট হোটেলটি রাজভবনের পিছনে। রাজভবনের সামনের জায়গাটা অনেকটা ছড়ানো মালভূমির মতো, যা থাকে নিরাপত্তার ঘেরাটোপে। অতএব গাড়ি ছেড়ে কিছুটা পথ হেঁটে যাওয়া। রাজভবনের সীমানা পার হয়ে বাঁদিকে হোটেল। সামনে দিয়ে পথ চলে গেছে ম্যালে। হোটেলে নির্দিষ্ট ঘরটিতে ঢুকেই দারুণ চমক। দেওয়াল জোড়া বিশাল কাচের জানালা। পর্দা সরাতেই আকাশ জুড়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা। বলা বাহুল্য, পরের তিনটে দিন যখনই আমরা ঘরে, যতক্ষণ দিনের আলো, ততক্ষণ দৃশ্যমান তিনি। কী যে অপূর্ব রূপ তাঁর, কী অমোঘ আকর্ষণ! কেন সবাই পাগলের মতো বারবার ছুটে আসে দার্জিলিং, সেটা বুঝতে অসুবিধা হলো না।

publive-image ঘর থেকেই দর্শন মিলত তার (ফোটো - লেখিকা)

লাঞ্চ করে চললাম ম্যালের দিকে। সারি সারি শীতপোশাকের দোকান। বেশির ভাগ দোকানীই মহিলা। পরিপাটি সেজে দক্ষ হাতে ব্যবসা সামলাচ্ছেন তাঁরা। ট্যুরিস্ট সিজন। ব্যস্ততা তুঙ্গে তাই। কিছুক্ষন বসে ম্যালে বিচরণরত মানুষজন দেখলাম। সূর্য ততক্ষণে অস্তরাগের লাজুক আলো ছড়িয়ে দিয়েছে আকাশের কোণে কোণে। ঠান্ডা হাওয়া বাধ মানে না। সেই আলো আর হাওয়ায় মাখামাখি কথারা যেন কোন পুরাতন কালের হারিয়ে যাওয়া গাথাকাব্য হয়ে ওঠে। দার্জিলিং তার শতাব্দী প্রাচীন ইতিহাস, অগম্য রহস্যের মেজাজ নিয়ে জেগে আছে, জেগে থাকে। সেই সুর আর আবেশ মনসিন্দুকে ভরে ফিরি হোটেলে।

আসলে গির্জা আর গুম্ফা, পুরোনো বাড়িঘর, পুরো শহরটার পাশ দিয়ে কু ঝিকঝিক টয় ট্রেন, ঘুমন্ত ঘুম স্টেশন, সব মিলিয়ে পুরোনো ইতিহাসের অপরূপ সুগন্ধ দার্জিলিংয়ের শরীর জুড়ে। যাঁরা আগে গেছেন, অনেকদিন ধরে যাচ্ছেন, তাঁরা যতই বলুন 'সেই দার্জিলিং আর নেই', তাতে এই শৈল শহরের মহিমা এতটুকু কমে না। এখানকার মানুষের জীবনযাত্রা আজও একই স্রোতে বহমান। কঠিন জীবন সংগ্রাম এদের সুন্দর মনটাকে এতটুকু নষ্ট করতে পারেনি। যেমন কাঞ্চনজঙ্ঘা, যার দিকে তাকালেই মনে হয় ঈশ্বর দর্শন করছি। এত সুন্দর, এত মহিমাময় - এই তো ঈশ্বর। সেই ঈশ্বরের বাড়িঘরেই এই সরল মানুষগুলো বসবাস করে। রাজনীতির কুটিল পাকচক্রে উথালপাথাল তাদের জীবনযাপন। তবু তারা অমল আন্তরিকতায় দু হাত বাড়িয়ে রেখেছে আগত অতিথিদের জন্য।

পরদিন সকালেই টাইগার হিল। নাঃ, চূড়ান্ত মুডি কাঞ্চনজঙ্ঘা এদিন সূর্যোদয়ের মহা মুহূর্তে দর্শন দেননি আমাদের। সে যাই হোক, আমি তো প্রথমবার, অনেকে একাধিকবার এসেও বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে গেছেন শুনলাম। আমার এই প্রভাতের প্রাপ্তি অন্যত্র। এক পবিত্র প্রভাত, যার কাছে নতজানু হয়ে আবার নতুন করে পথ চলা যায়। অগণিত মানুষ সাক্ষী হতে চাইছেন সেই অমল অনুভবের। সবাই ঠান্ডায় কাঁপছেন। অনেকেই বয়সের ভারে ক্লান্ত। তবু দাঁড়িয়ে টাইগার হিলে সূর্য ওঠা দেখবেন বলে।

একটা কথা অবশ্য বলতেই হবে, সূর্য ওঠা না দেখলেও চাঁদ দেখেছি। ভোর রাতের সেই চাঁদের কী যে মায়াময় রূপ। শুধু মুগ্ধ হওয়া নয়, প্রকৃতির দুষ্টু খেলাও উপভোগ করলাম। চাঁদ যেন এদিন প্রতিজ্ঞা করে বসেছিল ডুববে না। চাঁদও ডোবে না, সূর্যও ওঠে না। নিচে আকাশপানে হাহুতাশ চেয়ে আমরা। এই প্রভাতে পূব আকাশে আরও একজন বহুক্ষণ হাজির ছিলেন, জ্বলজ্বল করা এমন শুকতারা, সেও তো প্রকৃতিরই দান। এই সব নিয়েই অমলিন থাকবে এই প্রভাতের স্মৃতি।

আরও পড়ুন: সুন্দরী সিতংয়ে একান্তে

এক্ষেত্রে প্রথমেই বলবো গুরুজির কথা। ভোর চারটের মধ্যে বেরিয়ে পড়তে হবে, আগের সন্ধ্যায় নেপালি ড্রাইভার গুরুজি জানিয়ে দিয়েছেন। আমরা সেইমতো তৈরি হওয়ার মধ্যেই গুরুজির ফোন, এসে গেছেন উনি হোটেলের সামনে। গাড়ি যাচ্ছে টাইগার হিলের পথে। শহরের পথে টিমটিমে আলো। এছাড়া বাকি সব অন্ধকার। একটু পরই জঙ্গলের পথ ধরলো গাড়ি। অন্ধকার এখন নিশ্ছিদ্র। রাস্তা ক্রমশ উপরে উঠছে, ঠান্ডাও বাড়ছে। পৌঁছে, সবাই পজিশন নিলাম, যেখান থেকে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখবো। এখানে স্পষ্টতই দর্শককুল দ্বিধাবিভক্ত। একদল সূর্য ওঠা দেখবেন, আর অন্যরা কাঞ্চনজঙ্ঘা। আমি দ্বিতীয় দলে। শেষ পর্যন্ত যে ব্যর্থ হয়ে ফিরি, সে তো আগেই বলেছি। ফেরার সময় শহরের ট্রাফিক এড়াতে জলাপাহাড়ের রাস্তা ধরলেন গুরুজি। বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সময় বহুবার খবরে উঠে এসেছে এই নাম। গুরুজি জানান, "আমরা সেই স্মৃতি ভুলতে চাই। একটা পুরো সিজন নষ্ট হয়েছে, ট্যুরিস্ট না এলে আমরা খাব কী?"

পরের দিনটা দার্জিলিং শহরেই ঘোরাঘুরি। এখানে কয়েকটি নাম উল্লেখ করবো। পদ্মজা নাইডু হিমালয়ান জুলজিক্যাল পার্ক, পিস প্যাগোডা, তেনজিং নোরগে রক, জাপানিজ বুদ্ধিস্ট টেম্পল, হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট অ্যান্ড এভারেস্ট মিউজিয়াম, হ্যাপি ভ্যালি টি এস্টেট, ঘুম মনাস্ট্রি, চুন্নু সামার ফলস অ্যান্ড রক গার্ডেন, সানচেল লেক, সিংরিলা ন্যাশনাল পার্ক, অবজারভেটরি হিলস, দার্জিলিং রঙ্গীত ভ্যালি প্যাসেঞ্জার রোপওয়ে (এক দুর্ঘটনার পর এখন বন্ধ)। নামগুলো কমবেশি সকলেরই জানা। যেটা বলার, খুব ভালো করে এই কেন্দ্রগুলি দেখার জন্য কমপক্ষে সাত দিন জরুরি। আর একটি কথা, যথেষ্ট ফিটনেসও দরকার। কারণ, সবই চড়াই-উৎরাই ভেদে পৌঁছতে হয়। আমাদের পক্ষেও তাই সবগুলি দেখা সম্ভব হয়নি। তারই মধ্যে লেবঙ টি এস্টেট দেখে মুগ্ধ হয়েছি। বিশাল উপত্যকা জুড়ে চা বাগান, সবুজের প্রাণময় উৎসব যেখানে। আর ঠিক উপরেই দিগন্তবিস্তৃত কাঞ্চনজঙ্ঘা। অসাধারণ ঘুম মনাস্ট্রি আর পিস প্যাগোডা।

দার্জিলিং শহর গড়ে উঠেছে পাহাড়ের ধাপে ধাপে। ব্রিটিশ আমলে তৈরি এ শহর স্বাধীনতা পরবর্তীতে অনেকটাই ছড়িয়েছে আয়তনে। আকাশছোঁয়া বিল্ডিংগুলি অপরিসর রাস্তাকে ক্রমশ যেন অধিকার করছে। রাস্তার ধারে জল নিষ্কাশনের ব্যবস্থা, যা এখনও খুব আধুনিক নয়। এ শহরের পর্যটন গুরুত্ব অসীম। সারা বিশ্বের পর্যটক আসেন এখানে। সেই কথাটা মাথায় রেখে শহরকে আরও একটু পরিচ্ছন্ন রাখা যায় না কি? উল্টোভাবে এটাও বলার, পর্যটকদের নিজেরও কিছু দায়িত্ব আছে এক্ষেত্রে। যত্রতত্র আবর্জনা ফেলার বদ অভ্যাস আমাদেরও ছাড়তে হবে। আন্দোলন চলাকালীন বহু কলকাতাবাসীকে বলতে শুনেছি, "দার্জিলিং আমাদের, ছাড়বো কেন?"

তাঁরা কজন দার্জিলিং এসে এই সংক্রান্ত আদর ও যত্নের কথা মনে রাখেন, আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। পাহাড়ী মানুষরা জন্মগত অভ্যাসেই পরিচ্ছন্ন, পরিশ্রমী ও সৌন্দর্যপ্রিয়। প্রত্যেকের ঘরের সামনে ফুলের বাগান বাধ্যতামূলক। ঘুম থেকে উঠেই বাড়িঘর পরিষ্কারে নেমে পড়েন। সুতরাং শহরটাও অপরিচ্ছন্ন করার কাজটা ওঁরা করেন না, এটা ধরে নেওয়াই যায়। যাঁরা এখানে হোটেল ব্যবসায় আছেন এবং সরকারি স্তরে এর দায়িত্বে যে সংস্থা, যৌথভাবে দার্জিলিংকে সুন্দর রাখবেন এটাই প্রত্যাশিত।

এদিন শহরে ঘোরার জন্য নির্দিষ্ট গাড়ির তরুণ ড্রাইভার এই চলাফেরার মাঝেই হাত দিয়ে দেখালেন বলিউড তারকা গোবিন্দার বাড়ি। জানা গেল, পরিবার নিয়ে প্রায়ই আসেন তিনি এখানে। প্রসঙ্গত, দার্জিলিং বরাবর টলিউড ও বলিউডের ফেভারিট শুটিং ডেস্টিনেশন। নামী-দামি পরিচালকদের ফ্রেমে বার বার এসেছে টয় ট্রেন, চা বাগান আর অবশ্যই কাঞ্চনজঙ্ঘা।

আরও পড়ুন: কাপাদোচিয়া: এক বাস্তুহারার শহর

পরের দিন মিরিক যাত্রা। আর এই পথ এতটাই অপরূপ যে শুধু এই যাত্রাপথ নিয়েই একটা পুরো উপন্যাস লিখে ফেলা যায়। পাইনের ছায়া এক অদ্ভুত মায়ায় মুড়ে দিয়েছে পুরো পথ। শুধু পাইন নয়, অন্যান্য গাছও রয়েছে। অনেকেই প্রপিতামহ, আকাশের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে যুগযুগান্ত।  চোখ জুড়নো সবুজ, আর তাও নানা শেডের। সেই সবুজের অঞ্জন চোখে মেখে পৌঁছলাম সুখিয়াপোখরি। এখান থেকে অনেকটা উপরে, জঙ্গল পেরিয়ে পৌঁছতে হয় জোড়পোখরি। পাশাপাশি দুটি কৃত্রিম লেক। কাঞ্চনজঙ্ঘার ভিউ এখানে অবিশ্বাস্য সুন্দর। বুড়ি ছুঁয়ে যাওয়ার মতো ঘুরে গেলে চলে না এমন সুন্দর পুরো এলাকা। 'পরে কখনও আসবই', নিজেকে একথা বলে আবার রওনা।

প্রথমে লেপচা ভিলেজ, ছোট্ট সুন্দর এই স্পট থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার ভিউ দুরন্ত। মন বলে যাবো না, চোখ ভরে শুধু দেখে যাই। বেশ কটি হোমস্টে হয়েছে দেখলাম। অর্থাৎ একবার আসতেই হবে। এবার সীমানা, এটা নেপালের সীমান্ত। খুব কাছে পশুপতি মার্কেট। ঠিক এই জায়গায় দাঁড়িয়ে আমরা সবাই স্তব্ধ। এমন সৌন্দর্যের কাছে নতজানু হতেই হয়। দাঁড়িয়ে আছি নেপালের অংশে। সেখান থেকে ডান দিকে তাকালে যতদূর চোখ যায় শুধু কাঞ্চনজঙ্ঘা। ঝকঝকে নীল আকাশে তার অমোঘ অস্তিত্ব জানান দিয়ে সে যেন বলছে, 'আমার কাছে এসো। আমার কাছে আসতেই হবে'। মিরিক থেকে ফেরার পথে অন্য রূপ তার। গোধূলীর রঙে লালাভ আকাশ, আর সোনালি আভায় অভিষিক্ত কাঞ্চনজঙ্ঘা। মিরিকের পথে এ ছাড়াও দেখলাম গোপালধারা টি এস্টেট। স্বপ্নের জলবোনা এক সবুজ গালিচা পাতা রয়েছে উপত্যকা জুড়ে। দেখে দেখে আশ মেটে না।

মিরিকে গিয়ে লাঞ্চ আর লেক দর্শন। লেকের অবস্থা যেন গরিব ঘরের মেয়ের রুগ্ন শরীরে বেনারসী। লেক ছোট হতে হতে অর্ধেকেরও কম। এই পুরো ঘোরাটা ছিল গুরুজির গাড়িতে। কী উৎসাহ নিয়েই না উনি আমাদের দেখাচ্ছিলেন সব। বললেন, "আমরা এখন শুধু শান্তি চাই। লোকজন আরও বেশি বেশি আসুক। দেখুক আমাদের দার্জিলিং।"

দার্জিলিং ফিরতে সন্ধ্যা। এরপর ব্যাগপত্র গোছানোর পালা। পরদিন সকালে দ্রুত তৈরি হচ্ছি , গাড়ি চলে আসবে। তারই মধ্যে জানালার বাইরে চোখ চলে যায়। আজ কী একটু বিষণ্ণ সে! মনে মনে আবার আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে হোটেল ছাড়ি। তারপর পুরো রাস্তা ধরেই বারবার দেখা কাঞ্চনজঙ্ঘার সঙ্গে। চলার পথের যাবতীয় অনুষঙ্গে মিশে সে যথার্থই বলে, এ দেখাই শেষ দেখা নয় তো!

travelogue
Advertisment