জানালার পর্দা সরাতেই সারি সারি পাহাড়। আর কিছু নেই,শুধুই পাহাড়। নানা আকৃতি, নানা রং। সামনের পাহাড়রা স্পষ্ট। পিছনেররা তুলনায় আবছা। পূর্ণজি জানালেন, ওগুলো সবই সিকিমের পাহাড়। পূর্ণ তামাং এই হোম স্টে-র মালিক। নামেই মালিক। তিন ঘরের এই হোম স্টে চালানোর ক্ষেত্রে জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ, সবই থাকে ওঁর কাজের তালিকায়। আর সব কাজের সঙ্গী স্ত্রী। দুজনে কী সুন্দর একে অপরের পরিপূরক হয়ে সামলাচ্ছেন সমস্তটা।
পেডং-এ প্রথমবার এসে প্রকৃতির অসীম সুন্দর রূপ দেখার পাশাপাশি পাহাড়ের মানুষের জীবনযাত্রা খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়। তারপর কতবার যে আসা! স্বাভাবিক ভাবেই দৃঢ় হয় সম্পর্কের বাঁধন। সিকিমের বর্ডারে অবস্থিত উত্তরবঙ্গের এই ছোট্ট জনপদ কালিম্পং জেলার অন্তর্গত। ঐতিহাসিক দিক থেকে এর গুরুত্ব অসীম। প্রাচীন সিল্ক রুট যাওয়ার একটি পথ গিয়েছে পেডং হয়ে। তাছাড়াও এখানে খ্রিস্টান ও বৌদ্ধধর্মের প্রচার ও প্রসার ঘিরে তৈরি হয়েছে গুম্ফা, গির্জা ইত্যাদি। ভারতে প্রথম চা উৎপাদনের সঙ্গেও জড়িয়ে পেডং-এর নাম।
তখনও চাকরি থেকে অবসর নিইনি। ফলে বড় ছুটি বলতে পুজো। তেমনই এক ছুটিতে প্রথম আসি পেডং। দুপুর গড়ায় পৌঁছতে পৌঁছতে। ঘরে ঢুকেই মন ভালো হয়ে যায় , কারণটা শুরুতেই বলেছি। লাঞ্চের মেনু ছিল ভাত, ডাল, আলুর চোখা আর ডিমের ঝোল। মেনুটা এই জন্যই বললাম, এমন একটা সাদামাটা লাঞ্চও রান্না ও পরিবেশনার গুণে কেমন স্মরণীয় হয়ে উঠতে পারে, অনুভব করি সেদিন। তারপর বারবার। ডাল, যে কোনও সবজি, চিকেন, ডিম, মোমো, পকোড়া, পুরি, আলু চোখা, রুটি দিয়ে খাওয়ার সাদা আলুর তরকারি, বেগুন ভর্তা - সবই অমৃত। সঙ্গে ঘরে তৈরি নানা ধরণের আচার ও পুদিনা বা ধনেপাতার চাটনি এবং স্যালাড। বেড়াতে গিয়ে খাওয়াদাওয়া নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামানো আমার চরিত্র নয়। তাই বলে ভালো রান্না খেয়ে, প্রশংসা না করে ভোজনরসিক বাঙালির বদনাম তো করতে পারি না! প্রসঙ্গত, মৎস্যপ্রেমীদের একটু সমস্যা হতে পারে। পেডং বাজারে চালানি মাছ মেলে মাঝেমাঝে। তবে তা বাঙালির জিভে রুচবে না।
প্রথম দিনটা বিশ্রামেই কাটল। বিকেলে হাঁটা পথে এদিক ওদিক গেলাম। প্রত্যেকটি বাড়ির সামনে ফুলের বাহার। রংবেরঙের ফুল, অর্কিড, পাতাবাহার, আর ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন অঙ্গন। মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়তেই এগিয়ে আসেন মানুষ। নিছক সৌজন্যমূলক কথা। কিন্তু কী আন্তরিক! আর সবারই মুখে নির্মল হাসি। চলতে চলতে খুদেদের একটি দল তৈরি হয়ে যায়। যাকে বলে না চাইতেই পাওয়া সবুজ সাথী। এটা সেটা দেখায় ওরা আমায়। ছবি তুলতে চাইলে পোজ দেয়। অঞ্চলের পুরোটাই চড়াই-উৎরাই। ওঠানামায় হাঁফিয়ে যাই, শহুরে সুখি জীবনযাপনের অভ্যাসে যা হয়। হোম স্টে পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে চলে যায় খুদের দল।
ততক্ষণে সূর্যদেবের এপারের ডিউটি শেষ। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে। ঘরের লাগোয়া ছোট্ট এক ব্যালকনি আছে। চা-পকোড়া খেয়ে সেখানে দাঁড়াই কিছুটা সময়। দূরে পাহাড়ের কোলে জনবসতি, সেখানে একে একে জ্বলে উঠছে আলো। একই সঙ্গে তারারাও উঠছে জ্বলে। সে এক অপরূপ আলোকময় যুগলবন্দি। রাত নামে হিমের পরশ নিয়ে। দূরে পাহাড়ের কোলে তখনও দেখা যাচ্ছে আলোর মালা। জানতে পারলাম, ওগুলো সিকিম মণিপাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আলো।
কালিম্পং থেকে আলগরা হয়ে যেতে হয় পেডং। উচ্চতা চার হাজার ফুটের কিছু বেশি। ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে তাপমাত্রা অনেকটাই নিচে নামে। এছাড়াও সারা বছরই বেশ আরামদায়ক ঠাণ্ডা। মার্চ-এপ্রিল ফুলের মরশুম। তবে ফুল ও পাতার বাহার কমবেশি বছরভরই থাকে। এখানকার বাজারটি ছোট পাহাড়ি জনপদের হিসেবে বেশ জমজমাট। নিত্য প্রয়োজনীয় সবই মেলে। ফল ও শাকসবজি জৈবসারের প্রয়োগে উৎপাদিত। ফলে অত্যন্ত তাজা ও সুস্বাদু। বেশ কয়েকটি আবাসিক স্কুল আছে, যেখানে ভিন রাজ্য তো বটেই, প্রতিবেশী কয়েকটি রাষ্ট্রের ছেলেমেয়েরাও পড়তে আসে। শিক্ষার চর্চা এবং বিস্তারে পেডং অনেকটাই এগিয়ে, যেখানে খ্রিস্টান মিশনারিদের ভূমিকা অপরিসীম।
পরের দিন ঘুম ভাঙতেই দ্রুত উঠে ফ্রেশ হয়ে শীতপোশাকের সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। গন্তব্য ক্রস হিল পয়েন্ট। কাল বিকেলে বাঁ দিকটায় গেছিলাম। আজ ডান দিকে। এদিকটায় চড়াই-উৎরাই একটু বেশি। থেমে থেমে যাওয়া অগত্যা। চারপাশ শান্ত। পাখির ডাক ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। একটি/দুটি মানুষ পথে। একজনকে দেখলাম শুকনো কাঠ-পাতা নিয়ে চড়াইয়ের পথে উঠছেন। বোঝার ভারে নুয়ে পড়েছে শরীর। পাহাড়ে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা এমনই কষ্টসাধ্য। জঙ্গল থেকে এই সব নিয়ে বাজারে বিক্রি করে দুটো পয়সা আসবে। তাতেই ক্ষুন্নিবৃত্তি। মানুষটি অত কষ্টের মধ্যেও একমুখ অমল হাসি উপহার দিয়ে যান আমায়। হৃদয় পূর্ণ হয়ে ওঠে মাধুর্যে।
এই পথ গেছে অনেকটা দূর। প্রথমে ক্রস হিল পয়েন্ট, তারপর ছোট এক জঙ্গল ও গ্রাম। দুইয়েরই নাম কাশ্যম। গ্রামেই লেপচা হেরিটেজ কুটির। এলাকার একমাত্র লেপচা ঘর ও পরিবার যাঁরা প্রাচীন লেপচা ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন। নির্মাণ কৌশলেও সেই ধারা। মাটির বাড়ি, খড়ের চাল। এই চাল তৈরিতে পেরেক বা অন্য উপকরণ ব্যবহার করা হয় না। খড়ের বুননেই বানানো হয় চাল। এইসব পার করে পিচের রাস্তা চলে গেছে আরও দূর, সেই রংপো নদী পর্যন্ত। রংপোর ওপারেই সিকিম।
আমার আপাতত গন্তব্য অবশ্য ক্রস হিল পয়েন্ট । পৌঁছে শুধুই মুগ্ধতা। একদিকে রাস্তার বাঁকে পাহাড়ের ওপরে গির্জা। সেখানে ক্রুশবিদ্ধ যীশুর মূর্তি। আপনা থেকেই অবনত হয় মাথা। দুটি চোখে কী অপার করুণা! উল্টো দিকে সারি সারি ঢেউয়ের মতো পাহাড়। দাঁড়িয়ে আছে বহু ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। পেডং-এ দ্বিতীয়বার এসে দেখি কাশ্যম জঙ্গল, লেপচা হেরিটেজ কুটির ইত্যাদি। সেও এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা।
ফাদার অগাস্তে দেগোদাঁ। এই ফরাসি ধর্মযাজক ও সমাজসেবী ভারতে এসেছিলেন উত্তরবঙ্গের এই অঞ্চলটি ধরে তিব্বতে যাবেন বলে। সেখানকার মানুষের জন্য কাজ করবেন, এই ছিল স্বপ্ন। স্বপ্ন পূরণ হলো তাঁর। কিন্তু বদলে গেল পটভূমি। তিব্বতে সে সময় প্রবল বৌদ্ধ শাসন। মিশনারিদের সেখানে প্রবেশ একেবারে নিষিদ্ধ। অনুমতি পেলেন না ফাদার দেগোদাঁ। অতএব ভারতেই শুরু হলো কর্মযজ্ঞ। পেডং-কে ঘিরে প্রতিষ্ঠিত হলো গির্জা, স্কুল ইত্যাদি। যার মধ্যে ক্রস হিল পয়েন্টের গির্জাটির কিছু বিশেষত্ব রয়েছে। বহু খ্রীস্ট ধর্ম প্রচারক ছিলেন, যাঁরা এখান থেকে ধর্ম প্রচারের লক্ষ্যে তিব্বতে গিয়েছিলেন, কিন্তু আর ফেরেন নি। তাঁদের সম্মান প্রদর্শন ও স্মৃতিরক্ষার্থে ফাদার দেগোদাঁ ১৮৮২ সালে এর প্রতিষ্ঠা করেন। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে প্রাণ ভরে শ্বাস নিলাম। কী পবিত্র এক প্রভাত ঈশ্বর উপহার দিলেন আমায় আজ!
ফিরে এসে দ্রুত তৈরি। প্রথমে চা। তারপর ব্রেকফাস্ট। পুরি আর কালজিরে-কাঁচা লঙ্কা দিয়ে তৈরি স্বর্গীয় এক আলুর তরকারি। বাইরে গাড়ির হর্ন। পেডং-এর মধ্যেই একটু দূরের পথে যাব। প্রথমে শতাব্দী প্রাচীন এক বৌদ্ধ গুম্ফা। যাওয়ার পথে এক নার্সারি। একজন প্রাক্তন সেনাকর্মীর এই নার্সারিতে ফুল ও অর্কিডের বৈচিত্র দেখবার মতো। বিশেষত রডোডেনড্রনের সংগ্রহ তো এককথায় লা জবাব। যদিও সেখানে ফুল ফুটতে আরও কিছুদিন দেরি। শীতের শেষ দিকটায় ফুটবে, থাকবে গরমের শুরু পর্যন্ত, জানালেন নার্সারির মালিক।
রাস্তা থেকে অনেকটা উঁচু খাড়া পাথরের সিঁড়ি উঠে গেছে ওপরে। সেখানেই দাঁড়িয়ে প্রাচীন গুম্ফা, নাম সাংচেন দোরজি মনাস্ট্রি। এই অঞ্চলের সবচেয়ে পুরোনো গুম্ফা। প্রতিষ্ঠাকাল ১৭০০ সাল। মূল ভবনটি দোতলা। মোম-পালিশ কাঠের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠা। চারপাশ নিঃশব্দ, সুশৃঙ্খল,পরিচ্ছন্ন। নানা বয়সের বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা যে যার নির্দিষ্ট কাজে ব্যস্ত। তাঁদেরই একজন আমাকে নিয়ে গেলেন দোতলার ওই প্রকোষ্ঠে। এটাই প্রার্থনাঘর।
বুদ্ধের বিশাল মূর্তি ছাড়াও ছোটবড় নানা মূর্তি, বাঁধানো ফটো, বাঁধানো লিপি, বইপত্র, পূজার উপকরণে সজ্জিত ঘরের একটি দিক। আর এইসবের মাঝে প্রজ্জ্বলিত সেই প্রদীপ, যা কখনও নিভতে দেওয়া হয় না। ছোট এক জানালা দিয়ে সূর্যালোক প্রবেশ করছে। বাকি পুরোটাই অন্ধকার। দেওয়ালে টাঙানো ছবি, সিল্কের কাপড়ে করা কারুকাজ - বৌদ্ধ তন্ত্রসাধনার নমুনা রূপে প্রদর্শিত। এঁদের সংগ্রহে প্রায় ৩০০টি ফ্রেস্কো পেন্টিং রয়েছে, যা দেখলে মুগ্ধ হতে হয়। সব মিলিয়ে পরিবেশ এমন, মনে হলো বহু প্রাচীন সেই সময়টায় পৌঁছে গেছি। প্রতি বছর এখানে বর্ণাঢ্য ছয়ম নৃত্যানুষ্ঠান (মুখোশ নৃত্য) হয়।
এরপর ড্যামসাং ফোর্ট। ইতিহাস প্রসিদ্ধ এই দুর্গের ওপর থেকে পুরো অঞ্চলটি দেখা যায়। দুঃখের বিষয় ওই 'ওপর' পর্যন্ত যাওয়া আমার ভাগ্যে ঘটেনি। রাস্তা থেকে বেশ খানিকটা পথ ট্রেক করে এখানে পৌঁছোতে হয়, যা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। যাঁদের নিয়মিত ট্রেকিংয়ের অভ্যাস আছে এবং অবশ্যই অল্প বয়েসিরা পৌঁছে যাবেন সহজেই। উল্লেখ্য, দুর্গের ওই উপরিভাগ পর্যন্ত গাড়ির রাস্তা ছিল কোনও এক সময়। কালের প্রকোপে নষ্ট হয়ে যায়। সার্বিক অবহেলার কারণে তার সারাইয়ের দিকেও দৃষ্টি পড়েনি কারও।
পূর্ণজির কাছে শুনলাম, ওই অবহেলার কারণেই এখন ড্যামসাং ফোর্ট শুধুই ধ্বংসাবশেষ। তবু এর ঐতিহাসিক মূল্য অসীম। খুব সংক্ষেপে বলা যায়, একদা এই অঞ্চলকে ঘিরেই পল্লবিত হয় ভারতের চা শিল্প। ড্যামসাং ফোর্টের আশপাশের বিস্তৃত উপত্যকা জুড়ে ছিল চা বাগান, যা আজ সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত। কালের অঙ্গুলিহেলনে সব গিয়ে রয়ে গেছে শুধু সাহেবদের থাকার বাংলোটি। সেটি দেখলাম ড্যামসাং ফোর্ট থেকে আরও কিছু দূর গাড়িতে গিয়ে। রাস্তা থেকে অনেকটা নিচে নেমে সেই বাংলো দাঁড়িয়ে বর্ণময় অতীতের সাক্ষী হয়ে।
ফিরে আসি ড্যামসাং ফোর্ট প্রসঙ্গে। ১৬৯০-এ তৈরি এলাকার একমাত্র এই দুর্গ ছিল শেষ লেপচা রাজা গ্যাবো আচুকের আবাসস্থল। সেই সময় দুর্গ ছিল ভুটানের রাজার অধীন। ভুটানের রাজা গ্যাবো আচুককে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে রেখেছিলেন কাজকর্ম দেখার জন্য। পরে গ্যাবো আচুক বিশ্বাসঘাতকতা করে ভুটানের রাজার সঙ্গে ও দখল নেয় দুর্গের। এর ফলে দুপক্ষের লড়াই, যার সঙ্গে আবার জড়িয়ে ব্ল্যাক ম্যাজিক ইত্যাদির গল্প। সেইসব গল্প এখনও বলাবলি করেন স্থানীয় মানুষজন। কথিত, গ্যাবো আচুকের আত্মা আজও ঘুরে বেড়ায় দুর্গে। যাই হোক, ভুটানের রাজা আচুককে হারিয়ে দুর্গ পুনরাধিকার করেন। শেষে ১৮৬৪ সালে ব্রিটিশদের সঙ্গে ভুটানের রাজার যুদ্ধের পর দুর্গ যায় ব্রিটিশদের হাতে। ব্রিটিশদের আমলেই যত্নের অভাবে এর ধ্বংস শুরু, আজ যা অন্তিম লগ্নে। দেখার মতো কিছু ভাঙাচোরা দেওয়াল। প্রচুর গাছপালা অবশ্য আজও আছে। শুনলাম এপ্রিল-মে মাসে ফুলের প্রাচুর্যে সেজে ওঠে শতাব্দী প্রাচীন এই দুর্গের ধ্বংসাবশেষ।
পরের দিন গেলাম ঋষি খোলা। 'খোলা' অর্থ নদী। এই নদীও রাজ্যের সঙ্গে সিকিমের বর্ডার। ঋষি বেশ বড় নদী। ওপরে শক্তপোক্ত চওড়া ব্রিজ। ব্রিজ পার হয়ে পরিচয়পত্র দেখিয়ে সিকিমে ঢুকতে হয়। ব্রিজের পাশ থেকেই একটা পথ নেমে গেছে একেবারে নদীর ধারে, এটাও ট্রেকিংয়ের পথ। ফলে আমার নদীর সঙ্গে দেখা ব্রিজের ওপর থেকেই। প্রবল শব্দ টের পাওয়া যাচ্ছে, খরস্রোতা ঋষি বহতা আদি অনন্তকাল ধরে এভাবেই। নিচে লোকজন পুতুলের মতো। ঋষির পাড়ে কিছু হোম স্টে আছে। বলা বাহুল্য, সেখানে থাকার অভিজ্ঞতা দারুণ, যা এই পর্বে আর হলো না। নদী-পাহাড়-জঙ্গলের সমন্বয় সেখানে এক অপরূপ ক্যানভাস তৈরি করেছে, জানালেন ড্রাইভার ভাই।
সিকিমে ঢোকার পর দৃশ্যপট কিছুটা বদলে গেল। পথের ধারে ঘন পাইনের শোভা। উঁচু উঁচু পাহাড় আর চওড়া রাস্তা। গেলাম আরিটার লেক। লামপোখরিও বলে একে। পোখরি অর্থাৎ পুকুর বা লেক। সিকিমের প্রাচীনতম লেকগুলির অন্যতম আরিটার। ৪,৬০০ ফুট উচ্চতায় প্রকৃতির অপূর্ব সৃষ্টি এই লেকের দৈর্ঘ্য ১,১২০ ফুট, চওড়া ২৪০ ফুট। চারপাশে ঘন পাইনের জঙ্গল ছায়া ফেলেছে লেকের জলে। লেকের পাড় এমনভাবে বাঁধানো, যে কোনও জায়গায় দাঁড়িয়েই লেকটি দেখা যাবে। বোটিং-এর সুবন্দোবস্ত আছে। জলে নির্ভয়ে খেলা করে মাছ আর রাজহাঁসের দল। ভিতরে চা-বিস্কুটের দোকান আছে একটি, যেখানে সুস্বাদু মোমোও বিক্রি হয়। একটি রিসর্টও আছে থাকার জন্য।
ফিরতে ফিরতে দুপুর গড়ায়। লাঞ্চ শেষে বিশ্রাম। বিকেলটা হাঁটাপথে এদিক ওদিক। তার মধ্যে না ভোলা হয়ে থাকবে ক্রস হিল পয়েন্টের সূর্যাস্ত। সে এক অবর্ণনীয় সৌন্দর্য। ফিরে দেখলাম হোম স্টে গমগম করছে একদল নতুন অতিথির আগমনে। আমার ফেরার কাল সমাগত। কালই ফেরার ট্রেন। আজ ঠান্ডা একটু বেশি। ঘরে ঢুকে কম্বলের নিচে আশ্রয় আপাতত। ডিনারের এখনও কিছু দেরি। একটু আগে ভেজ পকোড়া সহযোগে কফি খেয়েছি। গল্পের বইয়ে মন দিই। নতুন অতিথিরা দলে ভারী, হইহট্টগোল চালু স্বাভাবিক ভাবেই। দূরে মিটি মিটি জ্বলে সিকিমের আলো। আকাশে নবমীর চাঁদ মায়াবী হয়ে ওঠে।
এই অবকাশে জানাই আরও কিছু তথ্য। পেডং-কে ঘিরে ঘুরে দেখা যেতে পারে সিলেরি গাঁও। এখানেও বেশ কিছু হোম স্টে আছে। এখান থেকেই যেতে পারেন রামিতে ভিউ পয়েন্ট, সাইলেন্ট ভ্যালি, তিনচুলে পাহাড়। রামিতে থেকে অনেক দূর পর্যন্ত বহতা তিস্তার দেখা মেলে। সাইলেন্ট ভ্যালি সবুজ কার্পেটে মোড়া পাইনে ঘেরা, অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন। আক্ষরিক অর্থেই নৈঃশব্দ এখানে। পেডং থেকে এছাড়াও যাওয়া যায় রামধুরা, বার্মিয়ক ও মুনসং। এই অঞ্চল থেকে তিস্তা ও কাঞ্চনজঙ্ঘা দুইয়েরই ভিউ অনবদ্য। একটি অতি প্রাচীন শিব মন্দির ও জলসা বাংলো আছে। জায়গাটি সিনকোনা চাষের জন্য বিখ্যাত। সেই উৎপাদন ও বিপণন দেখাশোনা করতেন যে সব সাহেব, তাঁদের থাকার জন্যই ব্রিটিশ আমলে এই বাংলো তৈরি হয়। একটি মালভূমির ওপর অবস্থিত এই বাংলোর চারপাশে রয়েছে বেশ কয়েকটি প্রাচীন বিশালাকৃতি গাছ। আছে সুন্দর এক ফুলের বাগান। এখান থেকেও তিস্তার দর্শন মেলে।
রাত ফুরোতেই বেজে ওঠে বিদায়বাঁশির সুর। এখনও ঘুমিয়ে সবাই। পাখিরা কিচিরমিচির শুরু করেছে পাশের গাছগুলিতে। হোম স্টে-র মেন গেট খোলা। পূর্ণজি ভিতরে কাজে ব্যস্ত। আমি গুটি গুটি হেঁটে যাই ক্রস হিল পয়েন্টে। তখনও জানি না আমার জন্য কী বিস্ময় আছে অপেক্ষায়। চড়াই-উৎরাই পার হয়ে এগিয়ে যাই। যেতে যেতে একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে একটু বিশ্রাম নিচ্ছি। এখান থেকে অনেকটা দূর পর্যন্ত রাস্তা সোজা গেছে, কোনও বাঁক নেই। সোজা ওই 'দূর'-টার দিকেই হঠাৎ আটকে যায় চোখ। সাদা ধবধবে তিন মাথার কী
ওটা? পূর্ণজি বলেছিলেন অবশ্য, ভাগ্যে থাকলে কাঞ্চনজঙ্ঘার দর্শন পাবেন!
এরপর কত দ্রুত হেঁটে ক্রস হিল পয়েন্টে পৌঁছেছিলাম বলতে পারবো না। ভয় হচ্ছিল, রোদ উঠলেই তো অদৃশ্য হয়ে যাবে সে। আমার অমূলক ভয়কে দূর করে অনেকটা সময় দৃশ্যমান থাকল কাঞ্চনজঙ্ঘা। ফিরলাম সেই দর্শনের অনির্বচনীয়তা নিয়েই। ফিরে ব্রেকফাস্ট ইত্যাদি সেরে রেডি হওয়া। বের হওয়ার আগে হালকা লাঞ্চ। গাড়ি এসে গেছে। প্রথমে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন। রাতে কলকাতা ফেরার ট্রেন। গাড়ি চলছে। মন পড়ে থাকে পিছনে।,
কীভাবে যাবেন: এনজেপি স্টেশন/শিলিগুড়ি তেনজিং নোরগে বাস স্ট্যান্ড/বাগডোগরা এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি গাড়িতে যেতে পারেন। খরচ ৩,২০০ থেকে ৪,০০০ টাকা। অফ সিজনে ভাড়া কম। গাড়ি বুকিংয়ের জন্য যোগাযোগ 9331939486। এছাড়া প্রচুর শেয়ার গাড়ি আসে কালিম্পঙে। সেখান থেকে পেডং পর্যন্ত গাড়ি বুকিং করে যেতে পারেন। এতে খরচ কিছুটা কম হবে।
কোথায় থাকবেন: বেশ কয়েকটি হোম স্টে আছে
খরচাপাতি: থাকা-খাওয়া দিনপ্রতি জনপ্রতি ৯০০ টাকা
যোগাযোগ: 9933615828, কালিম্পং থেকে পেডং-এর গাড়ি বুকিংয়ের জন্য এই নম্বরেই ফোন করুন। গাড়ি ভাড়া ১,০০০ টাকা
মনে রাখুন: টর্চ, ফ্লাস্ক, টি ব্যাগ, কফি, বিস্কুট ও শুকনো খাবার সঙ্গে রাখুন। রাখতে হবে ফার্স্ট এড বক্স, জ্বর, বমি, পেট খারাপ ইত্যাদির সাধারণ কিছু ওষুধ