Advertisment

ট্রেনে চেপে পুব থেকে পশ্চিম, চেনা দেশের খোঁজে

মুসলিম শাসকদের প্রতিষ্ঠিত সৌধ, মসজিদে অপূর্ব সমন্বয়ে এসেছে হিন্দু ও জৈন শিল্পসৌকর্য। প্রাচীন ভারতের এই মানবিক বন্ধনের রূপটি আহমেদাবাদে যেন নতুন করে আবিষ্কার করলাম।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Ahmedabad Travelogue

সরখেজ রোজা

দেশের পূর্ব থেকে পশ্চিম প্রান্তে যাওয়া। দূরত্ব অনেকটাই। তবু শিলিগুড়ি থেকে আহমেদাবাদ যাওয়ার জন্য আমি রেলপথই বেছে নিয়েছিলাম। এর একটা কারণ, প্লেনে যাতায়াত আমার মতো চাকরি থেকে অবসরপ্রাপ্ত মানুষের জন্য সব সময়ে সম্ভব হয় না। আর একটা কারণ, যে ট্রেনটাতে আমি যাব, তার রুট। কামাখ্যা-গান্ধীধাম এক্সপ্রেস নামের এই সাপ্তাহিক ট্রেন আসাম, বাংলা, বিহার, ঝাড়খণ্ড, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, রাজস্থান হয়ে গুজরাত পৌঁছয়। যাকে বলে, অর্ধেক ভারত দেখে ফেলা।

Advertisment

যেমন ভাবা ঠিক তেমনই হলো। ৪৮ ঘন্টা ট্রেনযাত্রার ধকল টেরই পেলাম না, এতোটাই রঙদার ও বৈচিত্র্যময় ছিল পথের অভিজ্ঞতা। রেল দফতর ট্রেনগুলি পরিষ্কার রাখার দায়িত্ব কোনও একটি দায়িত্বশীল সংস্থার হাতে দেওয়ায়, এই দিকটাতেও তেমন সমস্যা হলো না।

আরও পড়ুন, পেডং ছাড়িয়ে, মুদুম পার হয়ে কাগে

শুরু থেকেই ট্রেনটা যাকে বলে 'নানা ভাষা নানা মত'-এর বিচিত্র গুঞ্জনে ভরে উঠলো। সে এক মহা মিলনের সুর। কথায়, সংস্কৃতিতে, খাদ্যের সম্ভারে-সুগন্ধে ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত উঁকি দিল। খুবই অভিনব ও আকর্ষণীয় সেই উপলব্ধি। মজাদার কিছু অভিজ্ঞতাও হলো। আমার বয়সী একজন মহিলা একা এত দূরের পথে যাচ্ছি, এটা নিয়ে কিছু বাড়তি কৌতূহল থাকাই স্বাভাবিক। সে নাহয় মেটানো গেল। কিন্তু আমি আপ্লুত হলাম মানুষের ব্যবহারে। কামরার প্রত্যেকে এগিয়ে এসেছেন দরকার মতো। এত দূরের পথ একা চলেছি, বুঝতেই দেননি সহযাত্রীরা।

Ahmedabad Travelogue নির্ভয় এক কাঠবিড়ালি

এক সন্ধ্যায় নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠে, একদিন পরের সন্ধ্যায় পৌঁছই নির্ধারিত সময়ের একঘন্টা পর। ৪৮-এর বদলে ৪৯ ঘন্টা। নাহ, এটুকু মেনে নেওয়াই যায়। পাওনার ঘরে যে থেকে গেল অমূল্য কিছু সম্পদ। বহু মানুষ দেখা, কয়েক ঘন্টার জন্য হলেও তাদের সুখদুঃখের শরিক হওয়া। নিজেকে যথার্থই জীবনপুরের পথিক মনে হচ্ছিল। ফেরাটা আহমেদাবাদ-কলকাতা প্লেনে, কলকাতা-শিলিগুড়ি ট্রেন। এই যাত্রাটা গতানুগতিক। কিন্তু যাওয়ার সময়ের দুটি দিন স্মৃতিতে থেকে যাওয়ার মতো। ভুলবো না ক্ষণিকের জন্য দেখা ভালোবাসায় মাখা মুখগুলি।

আহমেদাবাদ পৌঁছনোর পর কিছুক্ষণ রুটিন কাজ। স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে গাড়িতে ওঠা ও নির্ধারিত ঠিকানায় পৌঁছনো। থাকবো ভাইয়ের বাড়িতে। স্টেশনে নিতে এসেছে সে। কার্যকারণে বেশ কয়েক বছর পর দেখা আমাদের। ফলে দুজনেই প্রবল আনন্দিত। আমাদের বয়সের লোকজনের কাছে বেড়াতে এসে এটা বাড়তি পাওয়া। যাওয়ার পথে দেখলাম শহরের এক ঝলক। ততক্ষণে সন্ধ্যা গিয়ে রাত নেমেছে। পার হলাম সবরমতি। চওড়া নদী। এর তীরেই মহাত্মা গান্ধীর ইতিহাস বিখ্যাত আশ্রম।

Ahmedabad Travelogue সবরমতী আশ্রমে

শুনলাম এই নদীর ওপর এমন আরও কয়েকটি ব্রিজ জুড়েছে শহরের এপার-ওপার। পুরো শহর জুড়ে চওড়া চওড়া রাস্তা। গগনচুম্বী অট্টালিকা, প্রচুর শপিং মল, শো রুম, ফিটনেস সেন্টার, রেস্তোরাঁয় সজ্জিত অতি আধুনিক এক শহর। আলো ঝলমলে উজ্জ্বল পথে যেতে যেতে একটা কথাই ভাবছিলাম, এমন আধুনিক এক শহরের অন্তরমহলের কথা। কি আছে সেখানে, যার জন্য ইউনেস্কো একে হেরিটেজ সাইট ঘোষণা করে? পরের দিনটা নিখাদ বিশ্রাম। তারপর থেকেই শুরু হয়ে যায় সেই অন্তরমহলের খোঁজ।

প্রথমে অক্ষরধাম। নাহ, এর সঙ্গে ঐতিহ্যের কোনও সম্পর্ক নেই। তবে ভারতীয় ধর্ম, পুরাণ, এবং গুজরাতের মানুষের আবেগের যোগ নিশ্চয়ই আছে। গান্ধীনগরে অবস্থিত এই মন্দিরের পুরো নাম স্বামীনারায়ন অক্ষরধাম। আহমেদাবাদ থেকে এক বিকেলে গাড়ি করে চললাম গান্ধীনগর। সঙ্গে আত্মীয়পরিজন। সকলেই প্রবাসী এখন এখানেই। গল্প করতে করতে যাওয়া। বিশাল চওড়া রাস্তা ধরে এগোচ্ছে গাড়ি। ট্রাফিক ব্যবস্থা নিখুঁত। ব্যবস্থা তো নিখুঁত, কিন্তু লোকজন মানে কই! তবে রাস্তা অত্যন্ত চওড়া হওয়ায় ট্রাফিক জ্যাম হয় না তেমন। পৌঁছনোর পর মন্দিরের ভিতর পর্যন্ত যেতে কড়া নিরাপত্তার বেড়া পার হতে হলো। শুনলাম কড়াকড়িটা বেশি হয়েছে কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া সন্ত্রাসবাদী হামলার পর থেকে।

আরও পড়ুন, খোশবাগ, বর্ণময় মুর্শিদাবাদের এক বেদনামুখর গাথাকাব্য

২৩ একর বিস্তৃত এক অঞ্চল জুড়ে প্রতিষ্ঠিত এই মন্দির তৈরি হয়েছে রাজস্থান থেকে আনা ৬,০০০ মেট্রিক টন গোলাপি বালিপাথরে (পিঙ্ক স্যান্ডস্টোন)। অপরূপ কারুকার্যমণ্ডিত, দেখে মুগ্ধ হতেই হয়। এছাড়া ভিতরে ফুড কর্নার আছে, সম্পূর্ণ নিরামিষ বলাই বাহুল্য। আছে লাইব্রেরি ও বিপণনকেন্দ্র। সেখানে যোগী স্বামীনারায়নের জীবন, দর্শন ও কর্ম সম্পর্কে বইপত্র রয়েছে। মন্দিরের ভাবনাও তাঁরই দর্শন ও আদর্শ সম্পৃক্ত। সমস্তটাই নিপুণ ছন্দে পরিচালিত। টিকেট কেটে ঢুকতে হয়। নিয়ম মেনে পর্যবেক্ষণ। ক্যামেরা, সেল ফোন নেওয়া বারণ। তাই ছবি তোলার কোনও সুযোগ নেই।

একটি ওয়াটার শো হয় প্রতি সন্ধ্যায়। আধুনিক প্রযুক্তির চূড়ান্ত প্রয়োগ দেখলাম তাতে। লেজার, প্রজেক্টর, জলের ফোয়ারা বা ধারা (এমন যেন জলেই তৈরি ব্যাকড্রপ) ও লাইভ মঞ্চাভিনয় - সব মিলিয়ে এক ম্যাজিকাল শো। আমাদের এদিনের সন্ধ্যার উপজীব্য ছিল যম ও নচিকেতার কাহিনি। এই রকমই নানা কাহিনির মধ্য দিয়ে পুরাণকথা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে দর্শক দরবারে। লোকজন এতে বেশ অভিভূত দেখলাম। অগণিত সেই ভক্ত দর্শকের সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে মন্দিরের বাইরে আসা। ডিনার এক নামি রেস্তোরাঁয়, অবশ্যই নিরামিষ ডেলিকেসি সহযোগে।

বেশ ঝলমলে রোদ্দুর মাখা এক সকাল। আহমেদাবাদ পাক্কা বহুতলের শহর। কোথাও সবুজের কোনও চিহ্ন নেই। তবে, যেখানে আমি আছি সেই দশতলা ফ্ল্যাটের ব্যালকনি থেকে অনেকটা খোলা আকাশ দেখা যায়। যথারীতি নিচে পুরোটাই কংক্রিটের জঙ্গল। সেই সব দেখতে দেখতেই কিছুটা দূরে চোখ আটকে যায়। বৃহৎ এক বিল্ডিং নির্মাণের কাজ চলছে সেখানে। কিন্তু ঠিক আবাসিক নয়, তবে কী? জেনে চমৎকৃত হই। বিশ্বের বৃহত্তম ক্রিকেট স্টেডিয়াম তৈরি হচ্ছে এই শহরেই। আহমেদাবাদের মোটেরায় নির্মিয়মান এই স্টেডিয়ামে ১.১ লক্ষ দর্শক খেলা দেখতে পারবেন। এর আগে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন ক্রিকেট স্টেডিয়াম ছিল এক নম্বরে। সত্যি গর্বের খবর।

ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য গান্ধী আশ্রম বা সবরমতি আশ্রম। ১৯১৭ সালে মহাত্মা গান্ধী কোচরাব থেকে এখানে স্থানান্তরিত করেন তাঁর আশ্রম। সবরমতি সাবার্ব, আশ্রম রোডের কাছে সবরমতি আশ্রম। নদীর নামেই নামকরণ, সবরমতির তীরেই অবস্থিত মহাত্মা গান্ধীর স্বাধীনতা আন্দোলন, তাঁর জীবন ও আদর্শের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী জড়িত এই পুণ্যভূমি। প্রসঙ্গত, এখান থেকেই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন শুরু করেন গান্ধীজী। প্রাচীন ইতিহাস আশ্রমের সর্বত্র। সুখের কথা, সৌন্দর্যায়নের অজুহাতে আশ্রমের পুরোনো চেহারায় হাত দেয়নি গুজরাত সরকার। ঢোকার মুখেই চোখ টেনে নেয় দেওয়ালে খোদিত সেই ছবি, যা এককথায় ভারতাত্মার প্রতীক। হাতে লাঠি, চোখে গোল ফ্রেমের চশমা, খালি গা, হাঁটু পর্যন্ত ধুতি, একটু ঝুঁকে চলা। এই স্টাইল স্টেটমেন্ট নিয়েই বিশ্ব মানচিত্রে নিজের স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী।

Ahmedabad Travelogue সবরমতী নদীটি

অনেকটা এলাকা জুড়ে গাছপালায় ঘেরা প্রাঙ্গণ। প্রচুর পাখি আর কাঠবিড়ালি। সকলেই বড় নিশ্চিন্তে বিচরণ করছে। পাখিরা তবু কিছু ওপরে, তাদের নাচানাচি গাছের ডালে, পাতার আড়ালে। কাঠবিড়ালিরা একেবারে কাছে চলে আসে। সমগ্র পরিবেশেই অপার শান্তি। দর্শকরাও তার শরিক। কোথাও কোনও হট্টগোল নেই।

ঘুরে দেখলাম পুরো আশ্রম। ছড়িয়ে ছিটিয়ে কক্ষগুলি। প্রাচীন স্থাপত্যের মাঝে ইতিহাস গুঞ্জরিত। সাদা আর ঘিয়ে রঙের দেওয়াল ও ছাদ। পুরোনো আমলের কড়িবরগা, বড় বড় জানালা। খুব সুন্দরভাবে বিষয় অনুসারে বিন্যস্ত রয়েছে ছবি ও নিদর্শন। কোথাও টানানো রয়েছে কাগজে ছাপা ফ্রেমে বাঁধানো ঘটনাপ্রবাহ, সাল-তারিখ মেনে।

আরও পড়ুন, ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন? একবার দেখতে পারেন এই জায়গাগুলো

একটা জিনিস দারুণভাবে অনুভূত হলো - মহাত্মা গান্ধীর কর্ম ও জীবনে কস্তুরবার প্রভাব। যথার্থই অর্ধেক আকাশ হয়ে ছিলেন তিনি। কস্তুরী বাঈ ছাড়া গান্ধীজীর মাহাত্ম্য প্রতিভাত হতো না, এখানে সর্বত্র সেটা লক্ষণীয়। একটি বারান্দায় দেখলাম চরকা নিয়ে বসে কাজ করছেন দুজন মহিলা। কথা বলে জানলাম, ওঁরা নিয়মিত আসেন। অন্যরাও আছেন। এখানে চরকায় সুতো কাটা, কাপড় তৈরির কাজটি এখনও সমান গুরুত্ব ও মর্যাদার সঙ্গে চলছে। আশ্রমের মধ্যেই সেসব বিক্রয়কেন্দ্রও রয়েছে। এছাড়াও আছে লাইব্রেরি, মিউজিয়াম। ঘোরাঘুরির পর ক্লান্ত হয়ে বসলাম গাছের ছায়ায়। পাশেই বহতা সবরমতি। শান বাঁধানো পাড়ে রোদ্দুর ঝলকায়। সূর্য মাথার ওপর উঠেছে। এবার ফিরতে হবে। সামান্য দূরত্বের পথ। সবে ফেব্রুয়ারির শেষ। গাড়ির কাঁচ নামানো। অন্দর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। তবু ঘেমে উঠি। স্বাভাবিক। চওড়া পথের দুপাশ শুনসান। সবুজের লেশমাত্র নেই। এমনিতেই উষ্ণ এই শহর, তার ওপর গাছপালাবিহীন হয়ে গেলে পথিকের পক্ষে কষ্টদায়ক তো হবেই।

কষ্ট হলেও হাল ছাড়লে চলবে না। হেরিটেজ শহরের তত্ত্বতালাশ বাকি এখনও। মাঝে একদিনের বিরতি। তার পরের দিন সূর্য মাথায় নিয়েই চললাম আরও পুরোনো ইতিহাসের খোঁজে। এই প্রসঙ্গে একটা কথা আগেই বলে নেওয়া ভালো, এই শহরের প্রাচীন ও ছড়ানো ইতিহাসের খুব কম অংশই দেখা হলো এবার। মনে হয় আরও একবার আসতে হবে। এবারে সময় যতখানি অনুমতি দিল তাতেই সন্তুষ্ট থাকা আর কী! তবে তাতেই উপচে পড়েছে ঝুলি।

যেতে হবে আমবলির সরদার প্যাটেল রিং রোড দিয়ে। যেতে যেতেই জানলাম এখানে একটি কালী মন্দির আছে। অঞ্চলের নাম বোপাল। মন্দির যেমন হয়, এটা তেমনই। আদলে দক্ষিণেশ্বরের কালী মূর্তি। ছিমছাম, সুন্দর পরিবেশ। দূর প্রবাসে মা কালীর মন্দির ও মূর্তি দেখে কেমন একটা ঘরের অনুভূতি হয়। এই আবেগটা নিশ্চয়ই সঙ্কীর্ণতা নয়! আহমেদাবাদ শহরে প্রচুর বাঙালি, যেমন দেশ-বিদেশের সর্বত্রই আছেন। এই কালী মন্দির শুধু তাঁদের নয়, সব রাজ্যের মানুষেরই ভক্তির কেন্দ্রে আছে। আর সেই ভক্তি ও ভালোবাসার স্বীকৃতিতেই বোধহয় মন্দির সংলগ্ন ৩ কিমি রাস্তার নামকরণ হয়েছে কালী মন্দির রোড, যার উদ্বোধন করেন আহমেদাবাদের মেয়র স্বয়ং।

কিছুক্ষণ যাওয়ার পর ঝাঁ চকচকে শহর পার হয়ে আমাদের গাড়ি ঢুকলো তুলনায় ছোট এক পরিসরে। জায়গার নাম মকরবা। বেশ পুরোনো আমেজ চারপাশে। কিছু দোকানপাট। সামান্য পায়ে হেঁটে দাঁড়ালাম যেখানে, সেখানে থমকে কয়েকশো বছরের পুরোনো ইতিহাস। সরখেজ রোজা। আহমেদাবাদ যাঁর নামে, সেই সুলতান আহমেদ শাহ'র রাজত্বকালে (১৪১০-১৪৪৩) সরখেজ ছিল এক শান্ত গ্রাম। শেখ আহমেদ খাট্টু গঞ্জ বক্স বলে একজন সুফি, যিনি আবার ছিলেন আহমেদ শাহ'র বন্ধু ও পরামর্শদাতা, সরখেজের শান্ত পরিবেশে মুগ্ধ হয়ে জীবনের শেষ দিকে অনেকটা সময় এখানেই বসবাস করেন। কথিত আছে, ১১১ বছর বেঁচেছিলেন এই সাধক। আপামর মানুষের শ্রদ্ধাভাজন এই সুফির স্মরণেই তৎকালীন সুলতান মহম্মদ শাহ এই সৌধ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। এই স্মৃতিসৌধের ভিতরে একটি মসজিদও রয়েছে।

সরখেজ রোজা'র ভিতরে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো পৌঁছে গেছি ইতিহাসের সেই গৌরবময় অধ্যায়ে। জুতো বাইরে খুলে ঢোকা নিয়ম। এছাড়া মাথাও আবৃত রাখতে হবে। সেই সব মেনেই প্রবেশ। পরিচ্ছন্ন বিস্তৃত প্রাঙ্গণ, কক্ষগুলি সেই প্রাঙ্গণ ঘিরে দাঁড়িয়ে। পায়রার দল ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভিতরে সংগ্রহশালা ও অফিস। মুগ্ধ হয়ে গেলাম স্থাপত্যকলা দেখে। মুসলিম, হিন্দু ও জৈন স্থাপত্যের অপরূপ মেলবন্ধন ঘটেছে এখানে। সেকালের আহমেদাবাদ, যেখানে একদিকে মুসলিম সুলতানদের রাজত্ব, অন্যদিকে হিন্দু ও জৈন সম্প্রদায়ের ব্যবসায়িক বাড়বাড়ন্ত। কোথাও কোনও অশান্তি নেই। সবাই একে অপরকে সমীহ করে, একে অপরের পরিপূরক হয়ে উন্নতির সোপান অতিক্রম করছে। তৎকালীন ভারতের সেই আভাস মেলে এই সরখেজ রোজা-র ইঁট-কাঠ-পাথরে। প্রশংসা করতেই হবে যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের। আহমেদাবাদ ঘুরে দেখার স্মৃতিতে উজ্জ্বল থাকবে এই ঐতিহাসিক সৌধ।

একদিকে মুসলিম, হিন্দু ও জৈন স্থাপত্যের অপরূপ মেলবন্ধন। অন্য দিকে প্রাচীন ও আধুনিকের সহাবস্থান। সব মিলিয়ে দারুণ আকর্ষণীয় ও অভিনব এই শহর। আধুনিক ব্যবস্থা সমন্বিত চওড়া রাস্তা, ব্যস্ত জীবন - তারই মাঝে দাঁড়িয়ে সিদি সঈদ মসজিদ। প্রস্তুতের সময়কাল ১৫৭২। ভদ্রা রোডের ওপর এই মসজিদ তৈরি হয় গুজরাতে সুলতান সাম্রাজ্যের শেষ দিকে। অনন্য গঠনসৌকর্য। অত্যন্ত নিপুণ ভাবে পরিচালিত ও সংরক্ষিত। বিশাল গম্বুজাকৃতি ছাদ, পাথরের জালি সদৃশ জানালা, বড় বড় থাম। ওই জালি অর্থাৎ জানালা থেকেই এর আঞ্চলিক নামকরণ 'সিদি সঈদ নি জালি'। সৌন্দর্য দেখলে আপনা থেকেই মাথা নত হয়। প্রচুর পর্যটকের ভিড়, তার মধ্যে ভিনদেশি মানুষও আছেন। বলা বাহুল্য, প্রত্যেকেই বিস্ময়াবিষ্ট। শহরের প্রায় প্রাণকেন্দ্র, প্রচুর ভিড় ও হট্টগোল, গাড়ি চলাচলের শব্দ। তারই মাঝে শান্ত, সমাহিত এই মসজিদ।

Ahmedabad Travelogue সিদি সঈদ মসজিদে দর্শনার্থীরা

দেখা হয়ে ওঠেনি, কিন্তু বলার মতো কয়েকটি দ্রষ্টব্যের নাম বলব এবার। 'অদালজ স্টেপওয়েল' অথবা 'রুদাবাঈ স্টেপওয়েল', তৈরি হয় ১৪৯৮ সালে। গ্রামের নাম অদালজ। সেই নামেই এই সৌধের নাম। বিখ্যাত বাঘেলা বংশের রানা বীর সিং-এর স্মৃতিতে এই সৌধ তৈরি করেন তাঁর স্ত্রী রানী রুদাদেবী। ভারতীয় স্থাপত্যের বর্ণময় প্রভাব এখানেও লক্ষ্য করা যায়। দেখার মতো 'কানকারিয়া লেক'। এটি মণিনগর অঞ্চলে। ১৪৫১ সালে সুলতান দ্বিতীয় কুতুবউদ্দিন আহমেদ শাহ'র সময়ে তৈরি এই বিশাল হ্রদ। সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে আকর্ষণীয় আরও কিছু উপকরণ হাজির এখানে। রয়েছে চিড়িয়াখানা, টয় ট্রেন, কিডস সিটি ইত্যাদি।

'জামি মসজিদ'-এর প্রতিষ্ঠা ১৪২৪-এ সুলতান প্রথম আহমেদ শাহ'র সময়ে। এরই সঙ্গে বলব 'ভদ্রা ফোর্ট'-এর নাম। সময়কাল ১৪১১। ফোর্ট অর্থাৎ দুর্গের ঠিক বাইরে অবস্থিত মসজিদ। ভদ্রা ফোর্টের পূব দিকে অবস্থিত ঐতিহাসিক প্রবেশপথ 'তিন দরওয়াজা'। এইরকম মোট ১২টি দরওয়াজা আছে পুরো আহমেদাবাদ জুড়ে। প্রতিটিই ইতিহাসের সাক্ষী। প্রত্যেকটি নির্মাণের পৃথক পৃথক গল্প রয়েছে। ১৪১১ সাল থেকে এগুলির নির্মাণ শুরু, তৈরি হয় বিভিন্ন সুলতানের আমলে। কালের অঙ্গুলিহেলনে এই প্রবেশপথগুলিও আর আগের চেহারায় নেই, স্বাভাবিক। প্রাচীনতা শরীর জুড়ে। তবে, দ্রষ্টব্য আজও।

১৮৪৮ সালে তৈরি 'হাথিসিং জৈন মন্দির'। তখনকার দিনে ৮ লক্ষ টাকা খরচ হয় এর নির্মাণে। ধনী ব্যবসায়ী হাথিসিং কেশরীসিং এর নির্মাণ শুরু করলেও শেষ করতে পারেননি। তাঁর অকালমৃত্যুর পর স্বামীর আরাধ্য কাজ শেষ করেন স্ত্রী হরকুনভর। স্থাপত্য সৌন্দর্যের ছাপ এই মন্দিরেও। 'দ্য ক্যালিকো মিউজিয়াম অফ টেক্সটাইলস' তৈরি হয়েছে ১৯৪৯-এ। ঐতিহাসিক মূল্য অসীম। গুজরাতের প্রাচীন ও সমৃদ্ধ তাঁতশিল্পের ধারাবাহিকতা খুব সুন্দরভাবে সংরক্ষিত এখানে। একই সঙ্গে বোঝা যায়, একদা এই শিল্পকে ঘিরে এই অঞ্চলের বাণিজ্য কতদূর প্রসারিত ছিল।

নতুন আহমেদাবাদে দেখুন 'অটো ওয়ার্ল্ড ভিন্টেজ কার মিউজিয়াম'। ইতিহাস আছে এখানেও। সেকালের ধনী ও সৌখিন রাজরাজড়া, জমিদার থেকে ব্যবসায়ী, সকলের গাড়ি ব্যবহারের একটা নমুনা পাবেন। দেখা উচিত 'গুজরাত সায়েন্স সিটি'। ভোজনরসিক তো বটেই, যে কোনও পর্যটকের জন্যই আকর্ষণীয় 'মানেক চক'। দিবারাত্র খোলা এই বাজার। সকালে সবজি, দুপুরে জরি আর রাতে খাবার। এ হলো স্ট্রিট ফুডের স্বর্গ। একে বলে নাইট মার্কেট ইটস। পুরোনো আহমেদাবাদের একটা ঝলক মেলে এখানে। পাওয়া যায় গুজরাতের নানা আঞ্চলিক খাবার থেকে শুরু করে পাও ভাজি, স্যান্ডউইচ, পিৎজা, দোসা, ইডলি এবং কুলফি। কিছু পুরোনো হিরের গহনার দোকান আজও রয়েছে মানেক চকে। আর আছে সবরমতি রিভারফ্রণ্ট। নদীর ওপর দিয়ে সেতু বরাবর বাঁধানো পথ, পার্ক, যা-ই বলি। নতুন প্রযুক্তির অভিনব দর্শন। তরুণ প্রজন্মের জন্য বেশ আকর্ষণীয়।

আসার আগের দিন কেনাকাটার জন্য গিয়েছিলাম ন্যাশনাল হ্যান্ডলুমে। জামাকাপড়, উপহার সামগ্রী, জাঙ্ক জুয়েলারি থেকে গার্হস্থ্য জীবনযাপনের যাবতীয় উপকরণ হাজির সেখানে। শপিং মল তেমন টানে না আমায়। সেই আমিও মুগ্ধ এখানে এসে। কারণ রাজ্যের শিল্প সম্ভারকে কী নিপুণ ভাবনা ও ব্যবস্থাপনায় এক ছাদের নিচে এনেছেন এঁরা। বাণিজ্যে বাণিজ্য হলো, আবার শিল্পের প্রচার ও প্রসারও হলো। সংস্কৃতিকেও তুলে ধরা গেল।

ভৌগোলিক কারণ হোক বা অঞ্চলের সংস্কৃতি, বাণিজ্যক্ষেত্রে সেই ইতিহাসের কাল থেকেই স্বতন্ত্র এই শহর। বিভিন্ন সময়ে ভিন দেশি শাসকরা পা রেখেছেন আহমেদাবাদে। 'দিবে আর নিবে'-র মাঝেই নিজেদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন এখানকার মানুষ। একই সঙ্গে ইতিহাসকেও রক্ষা করছেন শ্রদ্ধার সঙ্গে।

সেই ইতিহাসে ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মেলবন্ধনটা অত্যন্ত দৃঢ়। মুসলিম শাসকদের প্রতিষ্ঠিত সৌধ, মসজিদে অপূর্ব সমন্বয়ে এসেছে হিন্দু ও জৈন শিল্পসৌকর্য। প্রাচীন ভারতের এই মানবিক বন্ধনের রূপটি আহমেদাবাদে যেন নতুন করে আবিষ্কার করলাম। আজকের দিনে, যখন চারপাশে কেমন এক অচেনা বিচ্ছিন্নতাবাদের সুর, তখন নিজের চেনা দেশকে খুঁজে পেয়ে অনেকটাই শান্তি ও তৃপ্তি পেলাম।

gujarat tourism travel destination
Advertisment