কোটেশ্বরে দুগড়ু বাবার আশ্রম একটি মজার আশ্রম। অসংখ্য সেবায়েত জনগণকে সেবা করার জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছেন কিন্তু সেবা করার স্কোপ পাচ্ছেন না কারণ অত জনগণ নেই। আমি গিয়ে উপস্থিত হতে তারা খুবই আনন্দিত এবং উচ্ছসিত। একটি ঘর খুলে দিলেন আমার জন্য। ঘরে ঢুকে মাথায় হাত। ওটা ছিল ওই মন্দিরের গোডাউন। জরুরী জিনিসপত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, পড়ে আছে স্তূপাকৃতি জঞ্জাল। এবার এই জঞ্জাল পরিষ্কার করবে কে? সেবা করার জন্য সেবায়েতরা তখন হাওয়া। বেশ আমিই করব পরিষ্কার। লেগে পড়লাম, ঘন্টাখানেকের চেষ্টায় হল পরিষ্কার। ভালোই তো, কাজের বিনিময়ে বাসস্থান। কিন্তু খাট কই? জানালেন যে রাতের মধ্যে খাটের বন্দোবস্ত হবে। তখন দুপুর পেরিয়ে বিকেল। বাইরে প্রবল হট্টগোল শুনতে পাচ্ছি। কি ব্যাপার? চা বানানো হয়েছে, কিন্তু কে বিতরণ করবেন তাই নিয়ে বাগবিতণ্ডা চলছে। কাজ করার লোক বেশী থাকলে যা হয়। আশ্রম থেকে নর্মদার ভিউ কিন্তু অপূর্ব। রাত হতে চলল, খাট আর পাই না। জিজ্ঞেস করলাম একজনকে,
-’আমি কি একটা খাট পাব?’
সে আমায় দশ মিনিটের মধ্যে একটা খাট এনে দিল। তার পিছনে পিছনে আরও তিনজন। সে কোত্থেকে আরেকজনের খাট তুলে নিয়ে চলে এসেছে। আর যার খাট সে পিছন পিছন এসেছে। আবার শুরু হল গন্ডগোল। মহা সমস্যা! যার খাট তাকে ফেরৎ দেওয়া হল। বললাম যে আর খাটের দরকার নেই, আমি মেঝেতেই ম্যাট্রেস পেতে শুয়ে পড়ব। কিন্তু পাত্তা দেওয়া হল না সে কথায়। আবার চলে গেল ‘খাটিয়া অভিযানে’। আমি পড়লাম ঘুমিয়ে। রাত এগারোটা নাগাদ দরজায় ‘ঠকঠক’। অবশেষে আমার জন্য একটি দাবীদাওয়াহীন খাট জোগাড় হয়েছে। রাত বারোটা নাগাদ আমি সেই মহার্ঘ্য খাটে ঘুমালাম।
পরদিন অর্থাৎ ২৮ জুলাই ২০১৮ আমার পৌঁছানোর কথা বারওয়ানি। প্রায় ২৭ কিলোমিটার। বারওয়ানিতে থাকে আমার পুরোনো বন্ধু যোগেশ রাজপুত। আমি ২০১৪ সালে আমি জম্মু এবং কাশ্মীরের লাদাখ রিজিয়নে একটি সাইকেল এক্সপিডিশন করি। দুর্গম বাটালিকের রাস্তায় সাইকেল নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই উচ্চতাজনিত কারণে শরীর বিগড়ে যায়, ফলে অভিযান বাতিল হয়। সেই অভিযানে মহারাষ্ট্র থেকে অংশগ্রহণ করেছিল যোগেশ। দারুন মজার ছেলে। বাড়িতে আঙুর থেকে ওয়াইন তৈরী করা ছিল ওর প্যাশন। বর্তমানে কর্মসূত্রে মধ্যপ্রদেশের নর্মদাতীরবর্তী বারওয়ানিতে আছে। আমি যবে থেকে নর্মদা অভিযানে বেরিয়েছি তবে থেকে বলে রেখেছে যেন বারওয়ানিতে ওর বাড়িতে থাকি। কড়া রোদের মধ্যে পৌঁছলাম ওর বাড়ি। ওর স্ত্রী ভাবনা এবং ছোট্ট ছেলে রাজদীপকে নিয়ে থাকে। আমার জন্য তৈরী করে রেখেছিল মারাঠী মেনু। অনেকদিন পর বাড়ির খাবার খেয়ে ভালোই লাগল। অনেক পুরোনো স্মৃতিচারণ হল।
পরদিন যোগেশ বলল, ‘আজ আর নর্মদার তীরে হাঁটতে হবে না, তার থেকে চল একটা ছোট ট্রেক করে আসি।’
তথাস্তু, চললাম দুজনে মিলে ট্রেক করতে। প্রথমে যোগেশের স্কুটিতে করে বাওনগজা নামের এক জায়গায় গেলাম। সেখান থেকে হাত শুরু। পাহাড়ের উপরে একটা জৈন মন্দির, নাম চুলুগজা। বেশ অনেকটাই হাইট। ঘন্টাদুয়েক লাগল। উপরে উঠে অপূর্ব ভিউ। সাতপুরা রেঞ্জ আশাতীত মনোমুগ্ধকর। এতদিন না এসে খুব ভুল করেছি। যোগেশকে অনেক ধন্যবাদ বারওয়ানিতে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য। নর্মদার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বিন্ধ্য এবং সাতপুরা পর্বতমালার মধ্যে দিয়েই গেছে। এই দুটি পর্বতমালার কারণেই আর্যদের দাক্ষিণাত্য বিজয় হয়নি। হাঁটতে বেরিয়ে জানতে পেরেছি নর্মদা অববাহিকাকে নর্মদাখন্ড বলা হয়। আমি (আমরা) পাহাড় বলতে মূলত হিমালয়কেই বুঝেছি, দেখেছি বলেই বোধহয় ভারতবর্ষের বিন্ধ্য, সাতপুরা, পশ্চিমঘাট, পূর্বাঘাট, পালামৌ পর্বতমালাগুলি সেইভাবে ঘুরে দেখিনি বা এক্সপ্লোর করিনি।
ফেরার সময় গেলাম লোকাল একটা হাটে। বাজারঘাট করে ফিরলাম। ট্রেক, রান্নাবান্না, খাওয়াদাওয়ার মধ্যে দিয়ে দিনটা মজাতেই কাটল। পরদিন ভোরবেলা আবার বেরিয়ে পড়লাম। যোগেশ খানিকটা এগিয়ে দিল, তারপর আবার হাঁটা। গ্রামের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তখন প্রায় দুপুর বারোটা। পাহাড়ি রাস্তা, বেশ গরম, জল শেষ। এক বাড়িতে ঢুকেছি জল চাইতে। বাড়িতে একাই এক ভদ্রলোক থাকেন। ভিনদেশী দেখে বোধহয় একটু দয়া হল। অনুরোধ করলেন খেয়ে যেতে। আমি খানিক না না করেও রাজি হয়ে গেলাম। খাওয়ার পর এবার অনুরোধ করলেন সেই দিনটা তার বাড়িতেই থেকে যাওয়ার জন্য। এই ঘটনা বোধহয় নর্মদাতীরেই সম্ভব। গ্রামের নাম ছিল সেমালদা।
(আমার ট্রেকিং প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। কিন্তু ট্রেকিংয়ের বিবরণ লেখা, রিয়েল টাইমের চেয়ে অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে। ট্রেক শেষ করে গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়ার পর লেখা শেষ হয়ে যাবে না। এই লেখার মাধ্যমে যাঁরা আমার সঙ্গে হাঁটছেন, তাঁদের আরও কিছুটা সফর বাকি থাকবে।)