শিলিগুড়ি শহর ছাড়িয়ে মহানন্দা রেঞ্জে পৌঁছতেই বদলে গেল ক্যানভাস। দুপাশে ঘন জঙ্গল, সেখানে গাছপালার ফাঁকফোকর থেকে উঁকি দিচ্ছে সূর্যকিরণ। ফাগুন শেষের আদুরে বাতাস ছুঁয়ে যায় শরীর। সারা রাতের ট্রেন যাত্রার ক্লান্তি উধাও এক লহমায়। জঙ্গল চিরে রাস্তা সোজা চলে গেছে। ক্রমশ দ্রুত হয় গাড়ির গতি। কিছুটা চলার পরই তিস্তার মুখোমুখি। শীতের পর বসন্ত এসেছে, সেই নিয়মে তো বটেই, সঙ্গে বাঁধ নির্মাণও বাদ সেধেছে তিস্তার অনায়াস গতিতে। কিছুটা ঢিমেতালে চলন এখন তার। সে যাই হোক, দুপাশের সুউচ্চ পাহাড়প্রাচীরের মাঝখান দিয়ে বহমান আঁকাবাঁকা তিস্তা কোনওভাবেই তার আকর্ষণ হারায় নি, হারায় না।
এই সব দর্শন ও অনুভূতিকে পিছনে ফেলে, করোনেশন (স্থানীয় নাম বাঘপুল) ব্রিজ পার হয়ে ৩১ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে চলে এলাম বাগড়াকোট মীনা মোড়। এখান থেকেই যাবো কাঙ্ক্ষিত পথে। নিছক পর্যটন নয়, এবার একটু অন্য উদ্দেশ্য নিয়ে আসা। সঙ্গী বাকি তিনজনও ওই উপলক্ষেই আমার সফরসঙ্গী।
আরও পড়ুন: ঈশ্বরের ঘর-বাড়ি
বহু বছরের স্বপ্ন, জীবনের শেষটা পাহাড়ে কাটাবো। এক্ষেত্রে উত্তরবঙ্গই ছিল প্রথম পছন্দ। বিস্তারে না গিয়ে বলবো, সেই স্থায়ী ঠিকানার খোঁজেই এবারের ট্রিপ।
তিস্তা পার হওয়ার পর মংপং জঙ্গল। জঙ্গল আজকাল বেশ দুঃখী। গাছপালারা কিছু কুড়ুলের খপ্পরে, কিছু প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা সময়ের অঙ্গুলিহেলনে হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে। তার মধ্যেই বাকিরা দাঁড়িয়ে মাথা উঁচু করে। ফেব্রুয়ারির নিয়ম মেনে বাতাসে শোনা যায় পাতাঝরার গান। সে গান কানে নিয়ে আরও একটু পথ চলা।
মংপং শেষ হতেই পরপর চা বাগান। সবুজের আভায় চোখ জুড়িয়ে যায়। চা বাগানে কর্মরত নারীপুরুষ থাকেন আশপাশের গ্রামেই। জঙ্গল ও চা বাগানকে ঘিরে সন্নিবিষ্ট সেই সব গ্রামের মানুষ এখনও জীবনযাপনের ন্যূনতম সুবিধাগুলি থেকে বঞ্চিত। যুগ যুগ ধরে অবহেলার শিকার এঁরা। ভাবলে অবাক লাগে, শিলিগুড়ি থেকে মাত্র এক ঘণ্টা সময়ের দূরত্ব। অথচ এখানে জীবন পিছিয়ে বহু যোজন, যেন কয়েক শতাব্দী আগে। প্রত্যেক পাঁচ বছরে আর যাই বদলাক, এদের অবস্থা বদলায় না।
আরও পড়ুন: থাসার ইকোটুরিজম: বাকহুইটের রুটি, চাকভাঙা মধু দিয়ে ব্রেকফাস্ট এবং…
ভাবতে ভাবতেই পার হলাম লীস নদী। আপাতত শুকনো বালি তার শরীর জুড়ে। বর্ষা এলেই পাগলপারা হবে সে। প্রসঙ্গত, এই রাস্তায় পর পর অনেকগুলি নদী। লীসের পর ঘিস। তারপর মাল, নেওরা, চেল, কুর্তি, মূর্তি। ৩১ নম্বর জাতীয় সড়ক গেছে আসাম পর্যন্ত। তার আগে ডুয়ার্সের মধ্যেই এতগুলি নদী। আমরা অবশ্য ওই পথে যাব না। ঘিসের আগেই বাগড়াকোট মীনা মোড় থেকে বাঁদিকে একটা রাস্তা চলে গেছে পাহাড় ও জঙ্গল ধরে। এই অঞ্চলটি পুরোপুরি ডুয়ার্সের অন্তর্গত। লীস আর ঘিসের মাঝে উপত্যকা। সেই উপত্যকার উপরই গড়ে উঠেছে ছোট্ট গ্রাম চুইখিম।
চুইখিম, নামটা শুনেই মনে হয়েছিল বড্ড আপন। উত্তরবঙ্গের পর্যটন মানচিত্রে জেলা কালিম্পঙের অন্তর্ভুক্ত এই প্রত্যন্ত গ্রামের প্রবেশ বেশ কয়েক বছর আগে হলেও, এখনও তেমন পরিচিতি পায়নি। আর সেই জন্যই বোধহয় চুইখিম তার শান্ত, অপাপবিদ্ধ গ্রাম্য প্রকৃতি বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছে।
মীনা মোড় থেকে গরম গরম পরোটা আর কিমা চচ্চড়ি দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে আবার গাড়িতে ওঠা। কিছুটা সমতল, ছোট জনপদ, সেনা হেড কোয়ার্টার। উল্লেখ্য, এটাই ঐতিহাসিক সিল্ক রুট যাওয়ার পুরোনো রাস্তা। সেনা হেড কোয়ার্টার ছাড়িয়ে জঙ্গলে প্রবেশ করলো গাড়ি। রাস্তা ক্রমশ চড়াইগামী। কোনও এক সময় বদলে যায় পথের মানচিত্র। এক দিকে পাহাড়, উল্টো দিকে খাদ। যেদিকে পাহাড়, সেদিকে জঙ্গল সঙ্গে সঙ্গে চলেছে। বুনো জানোয়ার বলতে লেপার্ড আছে শুনলাম, সুযোগমতো ছাগল, বাছুর নিয়ে পালায়। আশপাশের গ্রামগুলিতে জনবসতি এখনও তেমন ঘন নয়। ফলে বাচ্চাদেরও লেপার্ড আক্রমণের ভয় থাকে বলে জানান আমাদের গাড়ির ড্রাইভার।
আরও পড়ুন: সুন্দরী সিতংয়ে একান্তে
কিছু দূর যাওয়ার পর উপর থেকে আবার দেখলাম লীসের ছন্দময় রূপ। বালির চর, তারই ফাঁকে ফাঁকে ক্ষীণকায় জলধারা। তবু বহতা সে। পিচ রাস্তা প্রায় পুরোটা। কিছুটা অংশ পাথুরে ও দুর্গম। তবে গাড়ি চলে এল গ্রামের ভিতর পর্যন্ত। পথের বাঁক পেরিয়ে গাছপালার সঙ্গে লুকোচুরি খেলে চুইখিম যখন পৌঁছলাম, তখন বেলা গড়িয়েছে অনেকটাই। এরপর স্নান, দুপুরের খাওয়া ইত্যাদি সেরে গ্রাম ঘুরে দেখার পালা।
চারপাশে পাহাড়, মাঝে কয়েকঘর মানুষের বাস। মূলত কৃষিজীবী এঁরা। নানা ধরনের সবজি, ভুট্টা হয়। আর ফুলঝাড়ু তৈরির গাছ। কমলা ও স্ট্রবেরি চাষও হয় শুনলাম। চাষে সম্পূর্ণভাবে জৈব সার প্রয়োগ করা হয়। কেউ কেউ বন বিভাগের প্রকল্পে ঠিকাদারের অধীনে কাজ করেন। এদিকওদিক মজুরের কাজও হয়, তবে তা কদাচিৎ। একটি বন্ধ হয়ে যাওয়া কয়লাখনি আছে, যেখান থেকে কয়লা তুলে বিক্রি করেন কেউ কেউ। কাজটা বেআইনি, প্রবল কষ্টসাধ্য। তবু করতে হয় বলে জানান তারা, পেটের দায় বড় যে! যাঁরা সচ্ছল, তাঁদের বাড়িতে গরু আছে, দুধ ও গোবর দুইই ঘরের প্রয়োজন থেকে ব্যবসার উপকরণ হয়ে ওঠে। মুরগি পালনও একই উদ্দেশ্যে।
গ্রামেরই এক বাড়িতে দেখা হলো এক মহিলার সঙ্গে, পা রেখেছেন প্রায় একশোর ঘরে। স্মৃতি সঙ্গ দেয় না। তবু মনের অতল হাতড়ে বললেন, বহু বছর আগে নেপাল থেকে একদল মানুষ এসেছিলেন এখানে। ওখানে জীবিকা নির্বাহ কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেই দলটিই বন কেটে বসত বানায়। কখনও হিংস্র পশু, কখনও দুর্গম ও বিরূপ প্রকৃতি - বহু লড়াইয়ের পর আজ গ্রাম মোটামুটি একটু আকার নিয়েছে।
সারাদিন প্রচুর ঘোরাঘুরি করে ক্লান্ত সবাই। হোমস্টের বারান্দায় জমিয়ে আড্ডা চলছে। একটু আগেই সূর্য অস্ত গেছে। কিছুক্ষণ নিঃসীম অন্ধকার । তারপর সেই অন্ধকার ভেদ করে রুপোর থালার মতো চাঁদ উঠলো, পুরো আকাশকে জ্যোৎস্না মাখিয়ে। কী অপরূপ সেই অভিজ্ঞতা। ঝিঁঝির ডাক ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। অপার্থিব এক অনুভূতি ঘিরে ধরলো সকলকে। রাত কাটলো সেই অনুভবকে সাথী করেই। আর তারই রেশ নিয়ে প্রভাতের মুখ দেখা।
আরও পড়ুন: মেঘালয়ের এই গ্রামে হয় সুরে সুরেই বার্তা বিনিময়
অনাবিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে সরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত মানুষগুলি। প্রত্যাশা কম, তাই আক্ষেপও নেই অপ্রাপ্তির। গ্রামে তিনটি প্রাইমারি ও একটি জুনিয়র হাই স্কুল রয়েছে। খুবই কষ্টেসৃষ্টে চলে স্কুলগুলি। ডাক্তার বা চিকিৎসাকেন্দ্র নেই। ছোটখাটো সমস্যা নিজেরাই শেকড়বাকর, গাছপাতায় সামলে নেন। কঠিন ও জটিল সমস্যায় ওদলাবাড়ি, মালবাজার, কালিম্পঙ বা শিলিগুড়ি আসেন গ্রামের মানুষ। সবার সেই আর্থিক সামর্থ্যও অবশ্য নেই। বেঁচে থাকা ওই ভগবানের ভরসায়। দেখে মনে হলো, অনেক না পাওয়ার মাঝে আনন্দে থাকার ম্যাজিকও হয়তো সেই ঈশ্বরেরই দান।
বসন্তকালীন এই ট্রিপ ছাড়াও আমার স্থায়ী ঠিকানা হওয়ার পর এখানে শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা সব ঋতুই দেখার সুযোগ হয়েছে। শীতের রিক্ত গাছের শাখা চোখের সামনে ফুলপাতায় ভরে উঠতে দেখেছি বসন্তে। গ্রীষ্মে উন্মত্ত কালবৈশাখী। প্রবল বর্ষায় বজ্রনির্ঘোষ থেকে ঘরের জানালায় মেঘেদের হানা, চুইখিম বড় প্রাণময় সব মিলিয়ে। দূষণমুক্ত পরিবেশ, স্বাস্থ্যকর জলহাওয়া। শিলিগুড়ি থেকে মাত্র দুঘন্টা দূরত্বের এই গ্রামটি প্রকৃতি, বিশেষত পাহাড়প্রেমী পর্যটককে এক অমল অভিজ্ঞতার স্বাদ দেবে নিঃসন্দেহে।
চুইখিমের উচ্চতা বেশি নয়, ৩৫০০ ফুট। তবে চারদিক একেবারে ফাঁকা হওয়ায় ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে বেশ ঠান্ডা লাগে। এই সময় গেলে শীতের যথেষ্ট পোশাক নিয়ে যাওয়াই ভালো। প্রত্যন্ত গ্রাম, ডাক্তার বা ওষুধ কোনওটাই মিলবে না, তাই প্রাথমিক চিকিৎসা ও ন্যূনতম প্রয়োজনীয় ওষুধ সঙ্গে রাখা দরকার।
এই মুহূর্তে গোটা পাঁচেক হোমস্টে আছে। ব্যবস্থাদি যথোপযুক্ত। খরচও নাগালের মধ্যে। ১০০০/১২০০-র মধ্যে দিনপ্রতি জনপ্রতি থাকা ও খাওয়া (ব্রেকফাস্ট থেকে ডিনার)। তাজা ও সুস্বাদু শাকসবজি, ভাত, রুটি, পুরি, ডাল, মোমো, পকোড়া, চিকেন ও ডিম পাবেন ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ ও ডিনারে। আর উৎসবের মরসুমে গেলে সেল রুটি খেতেই হবে আপনাকে।
গাড়ি ভাড়ার ক্ষেত্রে মাথায় রাখতে হবে টাটা সুমো, টাটা গোল্ড, মাহিন্দ্রার বড় ও শক্তিশালী গাড়ির কথা। ছোট গাড়ি যায় না। টর্চ, মোমবাতি-দেশলাই, মুড়ি ও বিস্কুট, কফি ও টি ব্যাগ, গরম জলের ফ্লাস্ক ইত্যাদি সঙ্গে রাখুন। চাইলেই এসব পাবেন না। কারণ, কোনও দোকান নেই।
আরও পড়ুন: সাংগ্রেং—বাংলাদেশের সাগরপারের আদি রাখাইন উৎসব
ফুল ও অর্কিডের শোভা এখন চুইখিমের শরীর জুড়ে। প্রজাপতিরাও মেলেছে রঙিন ডানা। আছে মৌমাছির দল। মধু সংগ্রহে ব্যস্ত হবে তারা বসন্ত এলেই। তার থেকেই মৌচাক ও মধু আহরণ গ্রামবাসীর। প্রকৃতিরানি এখানে সৌন্দর্যের আলপনা এঁকেই ক্ষান্ত নন। মানুষের বেঁচে থাকার আয়োজনও তাঁর ঝুলিতে। বর্ষায় জল উপচে পড়ে ঝর্ণাগুলিতে, সেই জল গড়িয়ে যায় ফসলের খেতে। মাথার উপর নীল আকাশের সামিয়ানা, দূরদূরান্ত পর্যন্ত পাহাড়ের অহংকারী ঊর্ধ্বমুখ। এই ক্যানভাসেই প্রতিদিন লেখা হয় চুইখিমের মানুষের সুখদুঃখের গাথা। পর্যটকদের আগমনে সেই গাথায় বাড়তি রং লাগে।
সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ নিশ্চিন্তে যাওয়া যেতে পারে চুইখিম। আর যাঁরা চ্যালেঞ্জ ভালোবাসেন তাঁরা বর্ষাতেও যেতে পারেন। গাছপালারা তখন স্নানসুখে ঝলমলে। মেঘ আর কুয়াশায় রহস্যঘন আকাশ-বাতাস। সারাদিন ধরে বাজে বৃষ্টির গান।
চুইখিমের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা এক বসন্ত দিনে। মুগ্ধ হয়েছিলাম তার কুমারী সৌন্দর্যে। তারপর গাঢ় হয়েছে আত্মীয়তা। পর্যটকরাও পাবেন সেই অদেখা মায়াময় রূপের ছোঁয়া। চুইখিম থেকে প্রথম দেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে আমার ফেরা একই পথে। তার আগে স্থায়ী ঠিকানা নির্দিষ্ট হওয়া। আসা-যাওয়া ও থাকা শুরু। সে গল্প অন্য কোনও দিন।