বর্ষায় নাকি পাহাড়ে যেতে নেই। একথা পাহাড় পাগল লোকদের ক্ষেত্রে যে মোটেই খাটে না, এটা যারা জানে, তারা জানে। বর্ষায় পাহাড়ে যাওয়া ও থাকা, দুটোই করেছি আমি। বলা বাহুল্য, তাতে প্রাপ্তিযোগ যা হয়েছে, সেটা এক কথায় অনির্বচনীয়।
বেশ কয়েক বছর আগের কথা। তখনও পুরোমাত্রায় চাকরির যাঁতাকলে বাধা। ফলে পাহাড়, তথা উত্তরবঙ্গে আসার জন্য ছুটির অপেক্ষায় থাকতেই হতো। মনে পড়ছে, সেই সময় বছরের শুরুতেই আমার পাহাড়ে আসার ক্যালেন্ডার তৈরি হয়ে যেত ছুটির লাল রং হিসেবে। সেবার ক্যালেন্ডারে ১৫ আগস্টের ছুটিটা আমাদের ভাষায় একেবারে গুছিয়ে পড়েছিল। অর্থাৎ আগে পরে মিলিয়ে লম্বা দিন। এমন সুযোগ ছাড়ে কে? চলো যাই পাহাড়ে।
ডেস্টিনেশন দাওয়াই পানি। নামটা শুনেই মনে হয়েছিল, যেতেই হবে। পরিকল্পনা মতো সারাদিন অফিস করে রাতের ট্রেনে উঠেছি। ঘুম ভাঙতেই কিষেনগঞ্জ! অর্থাৎ অনেকটাই পৌঁছে গেছি। চা-ওয়ালা ভাই জানিয়ে দিয়ে গেল, ট্রেন আধ ঘন্টা লেট, লেট বাড়তে পারে, আকাশের অবস্থা ভালো নয়। বলতেই জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে চোখ রাখি। সত্যি তো, ঘড়ির কাঁটা মেনে এখন তো ঝলমলে রোদ থাকার কথা। কিন্তু না, আকাশের মুখ যথেষ্ট গম্ভীর!
নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে পৌঁছতে পৌঁছতে ঘড়ির কাঁটা অনেকটাই এগিয়ে গেল। ট্রেন কিষেনগঞ্জ ছাড়ার পর থেকেই চলছিল ঢিমেতালে। স্বাভাবিক, বাইরে মেঘের দামামা ও মুষলধারে বৃষ্টি। ড্রাইভারকে অতি সাবধানে সেই বাধা সরিয়ে ট্রেন চালাতে হচ্ছিল। ব্যাগপত্র নিয়ে কুলির সাহায্যে বাইরে এলাম স্টেশনের। এরপরের ইতিহাস অন্তহীন অপেক্ষা ও বিরক্তির। গাড়ি রিজার্ভ করাই ছিল। কিন্তু খারাপ আবহাওয়ার জন্য ড্রাইভার পৌঁছতে পারেনি, এখবর শুরুতেই। তারপর যতবারই ফোন করি, সে বলে, "আ রহা হু ম্যাডাম, রাস্তা বহুত খরাব হ্যায়।" বলতে বলতে ঘন্টা দুয়েক পরে সে যখন আমার সামনে এসে দাঁড়ায়, তখন তার হাল কী হতে পারে, বলার দরকার পড়ে না। আমার বেহাল দশার পুরো রাগ-বিরক্তি-অসহায়তা তার ওপর বজ্রবিদ্যুৎ সহযোগে বর্ষিত হলো।
আরও পড়ুন, খোশবাগ, বর্ণময় মুর্শিদাবাদের এক বেদনামুখর গাথাকাব্য
সবে তারুণ্যে পা রেখেছে, দেখে কিশোরই মনে হয়, ড্রাইভার ছেলেটি কয়েক সেকেন্ড কাঁচুমাচু মুখে আমার বকুনি শোনে। তারপর দ্রুতগতিতে মালপত্র গাড়িতে তোলে। আমিও আপাতত সব ভুলে গাড়িতে উঠি এবং আমাদের যাত্রা শুরু হয়। কিছুদূর যাবার পরই লক্ষ্য করি, আরে এটা তো কার্শিয়াং যাওয়ার পথ নয়। প্রসঙ্গত, দাওয়াই পানি ঘুম স্টেশনের কাছে। যেতে হয় কার্শিয়াং হয়েই। ওই পথে সুকনা জঙ্গল, তিস্তা সেখানে দর্শন দেয় না। এদিকে আমার সামনে ভরা শ্রাবণের টইটুম্বুর তিস্তা! আমার বিস্মিত অভিব্যক্তি লক্ষ্য করেই ড্রাইভার জানায়, "ওদিকে রাস্তা বন্ধ। আমাদের একটু ঘুরে এপথেই যেতে হবে। দেরি হবে একটু। কিন্তু রাগ করবেন না, আপনাকে আমি মংপুতে রবীন্দ্রনাথের বাড়ি দেখিয়ে নিয়ে যাব।" মুহূর্তে আমি গলে জল। রাগ, বিরক্তি উধাও। মন খুশিতে 'গার্ডেন গার্ডেন'। মংপুটা এভাবে দেখা হয়ে যাবে, ভাবাই যায় না!
বিস্ময়ের তখনও বাকি ছিল। আমার মুড বুঝেই ছেলেটি গল্প করতে শুরু করলো। "কলকাতা থেকে কত ট্যুরিস্টকে আমি মংপু নিয়ে গেছি। আপনিও কলকাতার, আর বাঙালি। আপনি মংপু দেখলে খুশি হবেন আমি জানতাম।" আমি খুশি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বভাবগতভাবে তাকে জ্ঞান দিতে শুরু করি, রবীন্দ্রনাথ শুধু বাঙালি নয়, সারা বিশ্বের মানুষের প্রিয়। তিনি একজন আন্তর্জাতিক খ্যাত কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক ও সমাজ সংস্কারক। আর গান, ওঁর লেখা ও সুরে গান আমাদের বাংলা শুধু নয়, ভারত তথা বিশ্ব সংগীতের সম্পদ। জবাবে সে যোগ করে, "হ্যাঁ। আমাদের জাতীয় সংগীত তো ওঁরই লেখা। শান্তিনিকেতনে একটা বড় কলেজও করেছেন উনি।" আমাদের কথাবার্তা হিন্দিতেই হচ্ছিল। আমার আজও মনে আছে ও কলেজই বলেছিল। সংশোধন করার চেষ্টা করিনি। কলকাতা থেকে অত দূরের স্কুলের গন্ডি পার করা এক নেপালি তরুণ রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে এইটুকু জানে, এটাই আমার যথেষ্ট মনে হয়েছিল।
নাহ, এখানেও শেষ নয়। এরপরই সে বলে, "আমি যে স্কুলে পড়তাম সেখানে আমাদের প্রেয়ার হতো ওঁর লেখা, 'হোয়ার দ্য মাইন্ড ইজ উইদাউট ফিয়ার...", চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির.... সে পুরোটাই ইংরেজিতে আবৃত্তি করলো। বাইরে অঝোর ধারায় বর্ষণ। গাড়ির সামনের কাঁচ ঝাপসা। আমার চোখও যে ঝাপসা হয়ে আসে। হে রবীন্দ্রনাথ, এখানেই তো তুমি বিরাজ করো, সব হারাদের মাঝে! বিস্ময়ের ধাক্কা সামলে তাকে প্রশংসা করে বলি, এত সুন্দর মনে রেখেছো সেই ছোটবেলায় স্কুলের প্রেয়ার? তার জবাব, "মনে রাখব না? বাবাকে হারিয়েছি খুব অল্প বয়সে। তখন থেকে সংসারের দায়িত্ব। স্কুলও ছাড়তে হলো। অনেক লড়াই করতে হয়েছে ম্যাডাম। যখনই চোখে অন্ধকার দেখেছি, এই কথাগুলো মনে মনে উচ্চারণ করেছি। শক্তি পেয়েছি।"
এইসব অমল ঘটনাক্রমের মাঝে গাড়ি চলছে নিজের গতিতে দুপাশের দৃশ্যপট পিছনে ফেলে। ভরা বর্ষা। তাই ঝরনারা যথেষ্ট লাগামছাড়া। উদ্দাম গতিতে আছড়ে পড়ছে তারা। জলধারাগুলি চলেছে নদীর দিকে। কেউ তিস্তা, কেউ রঙ্গিতে মিশবে। মেঘের সঙ্গে কুয়াশা মিলে বেশ রহস্যঘন এক আবহ তৈরি হয়েছে। বড় বড় গাছের ডালপালারা কখনও নুয়ে, কখনও নেচে তাল মেলাচ্ছে বৃষ্টির গানে। এইসব দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম মংপু।
আরও পড়ুন, চুইখিম গেছেন? বড় প্রাণময় তার হাতছানি
স্বাধীনতা দিবস। জাতীয় ছুটির দিন। অতএব মংপু রবীন্দ্রভবনের লোহার গেটে তালা। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে গেটের বাইরে। ছাতা উড়ে যেতে চাইছে ঝোড়ো বাতাসে। ড্রাইভার বারবার গাড়ির হর্ন বাজাতে বিরক্ত দারোয়ান গেট খোলেন। আমি বাক্য বিনিময় না করে ঢুকে পড়ি ভিতরে। "আজ ছুট্টি হ্যায়" বলে দারোয়ান পিছু পিছু। ভিতরে কেউ উদাত্ত কণ্ঠে 'আকাশ ভরা সূর্য তারা' গাইছে। মোহমুগ্ধের মতো এগিয়ে যাই দারোয়ানের বারণ না শুনেই। গান থামে, বোধহয় দারোয়ানের হইচই মগ্নতায় ব্যাঘাত ঘটায়। জানালা দিয়ে মুখ বাড়ান কেউ। তারপর আমার বৃষ্টি-বিপর্যস্ত অবস্থা ও কলকাতা থেকে আসছি শুনে ভিতরে ঢোকার অনুমতি মেলে। ইনিই এখানকার কেয়ারটেকার । সত্যি, গানে বিভোর এমন এক মানুষকেই মানায় এখানে। ঢোকার পর প্রথমেই রবীন্দ্রনাথের দেওয়াল জোড়া ছবি। দুচোখে অসীম ক্ষমা। তাকালে মনে হবে আপনাকেই দেখছেন উনি। সবকটি ঘর ও আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র দেখে বের হতে ঘন্টাখানেক লাগলো। বৃষ্টি থামেনি তখনও। বাতাস হিমেল ও ভেজা। গাড়ি রওনা দেয় দাওয়াই পানির পথে।
ডেস্টিনেশনে পৌঁছতে অনেকটা দেরি হলো। পাঠককেও বেশ কিছুটা ঘুরপথে নিয়ে যেতে বাধ্য হলাম। এই অমলিন স্মৃতিগুলি আমার দাওয়াই পানি যাত্রার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী জড়িত। পাঠকের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার লোভ ছাড়তে পারলাম না।
দাওয়াই পানি পৌঁছতে বেলা গড়ায়। খুব দ্রুত ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চের অপেক্ষা করি। পৌঁছনোর পর একপ্রস্থ পরিচয় বিনিময় হয়ে গেছে। সবে খুলেছে এই হোম স্টে। নাম হামরো হোম। মালিক প্রভাত রাই। তবে তিনি এখানে থাকেন না। এখানকার দেখাশোনা করে প্রভাতজির আত্মীয়, এলাকারই একটি নেপালী পরিবার। নিতান্তই নিম্নমধ্যবিত্ত। পৈতৃক সামান্য জমি ও থাকার ছোট্ট ঘর। ঘরের অংশকেই কিছুটা পরিবর্ধন ও জরুরি আসবাবপত্রে সাজিয়ে দুটি ঘরের হোম স্টে বানিয়েছেন। দুটি ঘরের সঙ্গেই অ্যাটাচড বাথরুম আছে। আর আছে একটি লোভনীয় বারান্দা। এই বারান্দায় বসেই নাকি কাঞ্চনজঙ্ঘার দর্শন মেলে। 'নাকি' বললাম, কারণ আমার ভাগ্যে এই ট্রিপে মুখ ফিরিয়েই ছিলেন তিনি। দাওয়াই পানির তিনটি দিন শুধু মেঘ, কুয়াশা আর বৃষ্টি দেখেছি। নাহ, আমার অন্তত তাতে কোনও আক্ষেপ নেই। সেও এক অতুলনীয় রূপ পাহাড়ের।
লাঞ্চে গরমাগরম ডাল, আলুভাজা আর চিকেন। রান্নার ধরনটা আমাদের মতো নয়। কিন্তু সুস্বাদু। আর লম্বা যাত্রাপথের শেষে, প্রবল খিদের মুখে সেটাই অমৃত। বাড়ির গিন্নি সলজ্জ মুখে বলেন, "খেতে কষ্ট হলো, না? আমরা তো আপনাদের শহরের লোকদের মতো রান্না করতে পারি না!" আমি তাঁর অস্বস্তি দূর করে বলি, শহরের সবাই যে ভালো রান্না করে তা নয়। আমি নিজেই তো পারি না। রান্নায় স্বাদ ব্যাপারটা নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ। তবে তার থেকেও জরুরি পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা। এছাড়া এই যে আন্তরিক ভাবে, সুন্দর করে খাবার পরিবেশন - এটাও কি কম?" পরের কয়েকটি দিন আমাদের মধ্যে এই সংক্রান্ত আলোচনা প্রায়ই হতো। নতুন খুলেছেন হোম স্টে। ফলে কিছুটা অভিজ্ঞতার অভাব ছিলই। যতটা সম্ভব গাইড করেছিলাম ওঁদের অনুরোধে, আর তাতেই কি যে আপ্লুত! বলা বাহুল্য, আমার কাছে সবটাই ছিল পরম প্রাপ্তি।
তিস্তা বাজার, জোড়বাংলো হয়ে যেতে হয় দাওয়াই পানি। দার্জিলিং খুব কাছে, মাত্র ২০ কিমি। ম্যালে দাঁড়িয়ে দাওয়াই পানির ভিউ পাওয়া যায়। উল্টো ভাবে দাওয়াই পানি থেকে দার্জিলিংয়ের তুষারপাত দেখা যায়। এছাড়া কাছাকাছি আছে লামাহাটা। আধঘন্টায় পৌঁছনো যায়। অঞ্চলটি এখনও সেভাবে ট্যুরিস্ট রাডারে আসেনি। ফলে নির্জনতা দাওয়াই পানির শরীর জুড়ে। জঙ্গল কেটে গ্রাম। তাই চারপাশের পরিবেশে সবুজের প্রাচুর্য চোখে পড়ে। উচ্চতা ৬,০০০ ফুট। আবহাওয়া সবসময়ই ঠান্ডা। ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে খুব বেশি। দূষণ একেবারেই নেই। পানীয় জল স্বাস্থ্যগুণসম্পন্ন। খুব তাড়াতাড়ি খাবার হজম হয়ে খিদে পেয়ে যায়।
আরও পড়ুন, ঈশ্বরের ঘর-বাড়ি
এখানকার জল কত ভালো, তার একটা সুন্দর গল্প আছে। আর সেই গল্পের সূত্রেই গ্রামের নাম। বহু বছর আগের কথা। তখন এদেশে ব্রিটিশ শাসন। উত্তরবঙ্গের এই অঞ্চলটিতে চা বাগান, সিঙ্কোনা চাষ হয়। সবই সাহেবদের তত্ত্বাবধানে। সাহেবরা ঘোড়ায় করে কাজকর্ম দেখাশোনা করতেন। এমনই একদিন এক সাহেব বেরিয়েছেন। ঘুরতে ঘুরতে বেলা বাড়ে। রোদ্দুরের তেজও তীব্র হয়। ক্লান্ত সাহেব গাছের নিচে বসে বিশ্রাম করছেন। তাঁর পায়ে কোনও কারণে একটি ক্ষত হয়েছিল। যেখানে বসেছেন, তার সামনেই ছিল এক প্রাকৃতিক জলধারা। সাহেব ওই জলে পা ধোয়ার কিছু পরেই নাকি তাঁর ক্ষতের নিরাময় হয়ে যায়। অর্থাৎ জলের মধ্যে ওষুধ, মানে 'পানিতে দাওয়াই' মিশে আছে প্রাকৃতিকভাবে। সেই থেকে গ্রামের নাম হয়ে গেল দাওয়াই পানি।
প্রথম দিনটা ঘরেই কাটলো। লাঞ্চের পর কম্বলের নিচে ঢুকেছিলাম। ঘুম ভাঙতেই দেখি চারপাশ নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। বৃষ্টি থামলেও মেঘ সরেনি। গরম জামাকাপড় জড়িয়ে বাইরে আসি। দূরে দু'একটি বাড়িতে মিটিমিটি আলো জ্বলছে। বাকি সব অন্ধকার। কিছুক্ষণ সেই অন্ধকার ও নির্জনতা উপভোগ করে ঘরে আসি। ঠান্ডা হাওয়ার দাপট বাড়ছে ক্রমশ। একটু পরেই চা এলো। চায়ের সঙ্গে পকোড়া। জমে গেল নির্জন পাহাড়ী সন্ধ্যা। রাতে রুটি-সবজি খেয়ে কিছুক্ষণ গল্পের বই পড়ে পালাই ঘুমের দেশে।
পরদিন ঘুম ভাঙ্গে অনেক সকালে। বাইরে একটু একটু আলো ফুটছে। পাখিদের কিচিরমিচির শুনলাম, সে যেন কোন অতীত থেকে ভেসে আসা। কলকাতায় আজকাল মুষ্টিমেয় কিছু অঞ্চলে ক্বচিৎ ওদের কলকাকলি শোনা যায়। এখানে তো রীতিমতো মিটিং-মিছিল। গাছের ডালে, আকাশের উপরে, নিচে সর্বত্র নানা রঙের পাখির ওড়া, কোলাহল দেখি ও শুনি কিছুক্ষণ লোভীর মতো। বৃষ্টি থামলেও রোদ ওঠেনি। আকাশ রাগী বালিকার মতো মুখ ফুলিয়ে রেখেছে।
ব্রেকফাস্ট সেরে গ্রামে হাঁটতে বের হই। ছোট ছোট ঘরবাড়ি, লাল-সবুজ রং করা কাঠ ও টিনের, সামনে ফুলের বাগান - এককথায় প্রকৃতির ক্যানভাসে দারুন রঙ্গীন এক ছবি। গ্রামের লোকজনের সঙ্গে কথা হয়। কেউ ঘরের কাজে ব্যস্ত। কেউ বা জঙ্গল থেকে ডালপাতা কেটে বাজারে যাচ্ছেন বিক্রি করতে। চড়াই-উৎরাই পার হয়ে প্রতিদিনের কষ্টকর জীবনধারণ। বাচ্চাগুলো পর্যন্ত স্কুলে যায় এভাবেই, দু-তিন ঘন্টার রাস্তা পার করে। তবু আবালবৃদ্ধবনিতার মুখে একমুখ হাসি, গ্রামে আগত অতিথিকে দেখে যা একরাশ ফুলের মতো ফুটে ওঠে।
দিনের বাকি সময়টা রুটিন মেনেই কাটে। খানা, বিশ্রাম আর বই পড়া। মাঝে মাঝে মেঘেদের উত্তাল কান্ডকারখানা দেখা। দুপুরে রাই শাক, স্কোয়াশের তরকারি আর ডিম কারি খেয়েছি। মাছ পাওয়া যায় না এখানে। ডিম, চিকেন, শাকসবজি, ডাল। রান্না হয় মূলত কাঠের আগুনে।
পরের দিনও ঘুম ভাঙ্গে পাখির ডাকে। আজ সামান্য পরিষ্কার আকাশ। যতটুকু মেঘ আছে, তাতে প্রথম আলোর চরণধ্বনি শোনা যায়। কী মন ভালো করা এক সকাল। ঘুরতে বেরোই ব্রেকফাস্ট সেরে। কাল পুরি-সবজি, আজ রুটি-আলুভাজা। মাঝে মাঝে অতি সাধারণ খাবারও অমৃত মনে হয়। পাহাড়ে এলেই এটা হয় দেখেছি। কাল একজনকে কথা দিয়েছিলাম, আজ তাঁর দোকানে গিয়ে বসবো। গ্রামের একমাত্র দোকান। পাক্কা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। চাল-ডাল-তেল থেকে ফুলঝাড়ু, শাকসবজি-ডিম, গায়ে মাখার সাবান-মাথার তেল থেকে বালতি মগ তোয়ালে, গামছা, কী নেই? দোকানি একজন বয়স্ক মহিলা, দেখে বোঝা যায় না। চটপটে ও নিপুণ হাতে সামলাচ্ছেন সব। দোকানে বসে নানা গল্প, লজেন্স-বিস্কুটে আপ্যায়িত হয়ে, ছবি তুলে যখন হোম স্টে-তে ফিরি, তখন আবার ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়েছে।
দাওয়াই পানিতে আজই শেষ দিন আমার। লাঞ্চের পর তাই আর কিছু নয়, বারান্দায় বসে শুধু প্রকৃতির রূপসুধা পান। মেঘেরা এখন পুরো দামাল ছেলের দল। যেন কোনও বাধাই মানবে না। কালো আর ধূসরের বিভিন্ন শেড, এপ্রান্ত-ওপ্রান্ত জুড়ে নানামাত্রিক ছবি তৈরি করছে। বিভোর হয়ে এইসব দেখতে দেখতে সন্ধ্যা নামে। তারপর একটু বিষন্ন অনুভূতির সঙ্গে রাত গভীর হয়।
ফেরার পথে ঘুম স্টেশন হয়ে যাব, ড্রাইভারকে বলাই ছিল। দুষ্টু বাদল মেঘ পিছু ছাড়ছে না কিছুতেই। আবহাওয়ার গুনেই ঘুমও যেন ঘুমিয়ে। কুয়াশায় মাখামাখি স্টেশন, খেলনা ট্রেনের লাইন। তার ওপর দিয়েই ছাতা মাথায় কাজেকম্মে চলেছেন মানুষ। এইসব দেখতে দেখতে এগিয়ে চলি। গাড়ি রোহিণী হয়ে ক্রমশ সমতলমুখী। পার হই বালাসন নদী। জলের প্রাচুর্যে মাতোয়ারা সে। কিছু পরে সুকনার জঙ্গল। গাছপালা বেজায় খুশি বৃষ্টিতে ভিজে। শিলিগুড়ি শহর পেরিয়ে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন। বিদায় পাহাড়। ফিরতে হবে কাজের দুনিয়ায়।