বাখহুইটের রুটি আপনি কোথায় খেয়েছেন? চট করে জবাব দিতে পারবেন, যদি খেয়ে থাকেন। তার কারণ এ অভিজ্ঞতা এ দেশে সচরাচর জোটে না। সিকিমের থাসায় যদি যান, যদি থাকেন সেখানকার কোনও হোম স্টে-তে তাহলে পরেরবার উত্তর দেওয়া সহজতর হবে। সত্যজিৎ রায়ের কাঞ্চনজঙ্ঘা ছবির সেই শিশুর কণ্ঠে গান আপনার সামনে সজীব হয়ে উঠতেও পারে।
কামেরের মত এখানেও পাবেন নিজেদের ক্ষেতের জৈব পদ্ধতিতে ফলানো ফসল ও সবজি দিয়ে তৈরি খাবার। এবং চমৎকার থাকার বন্দোবস্ত। কোনও রকমে চৌকির ওপর হতদরিদ্র রঙের চাদর দিয়ে ঢাকা একটি শয্যা, ও ন্যূনতম সুবিধা সমেত একটি ঘর- হোম স্টে-র এই চেনা ছবির বাইরে প্রিমিয়াম থাকার ব্যবস্থা।
থাসাকে আপনি না খুঁজেও পেতে পারেন। থাসা পুরনো নাম। মানচিত্রে এখন খামদং। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এ জায়গার উচ্চতা ৫৫০০ ফুট। একটা ছোট্ট গ্রাম বলতে আপনি কী বুঝবেন? কত লোক? এখানে শ পাঁচেক মানুষ থাকেন। এঁদের মূল জীবিকা জৈব চাষ।
বাগডোগরা থেকে সরাসরি যদি থাসা ওরফে খামদংয়ে যেতে চান, তাহলে দূরত্ব ১১০ কিলোমিটার, সময় লাগবে সাড়ে তিন থেকে চার ঘণ্টা। যদি কোনও কারণে যেতে চান গ্যাংটক থেকে তবে দূরত্ব পড়বে ৪০ কিলোমিটারের কাছাকাছি, সময় লাগবে দেড় ঘণ্টার কাছাকাছি। পাকিয়ং বিমানবন্দর থেকে খামদংয়ের দূরত্ব ৫০ কিলোমিটারের কিছু কম। সময় লাগবে দু ঘণ্টার কিছু কম।
থাসায় সদ্য শুরু হয়েছে ইকো টুরিজম। এবং এলাকার মানুষজনের দায়িত্ববোধ দেখে অত্যন্ত উৎসাহী টুরিজম ডিপার্টমেন্টের কর্তারা। থাসার ইকো টুরিজম শুরুই হয়েছে সিকিমের পর্যটন দফতরের অবসরপ্রাপ্ত এক সচিব পর্যায়ের অফিসারের নিজের বাড়ি থেকে, জানালেন দফতরের আধিকারিক মনোজ ছেত্রী। মনোজবাবুর বিশ্বাস, পর্যটনের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এই আধিকারিকের মনোযোগের ফলে থাসার পর্যটনবিন্দু হওয়ার কারও কারণবৃদ্ধি ঘটবে। মনোজ ছেত্রীর কথায়, ‘‘থাসার যাঁরা দায়িত্ববান মানুষ তাঁরা তো বটেই, এমনকি ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাও ইকো টুরিজমে উৎসাহী হয়ে উঠেছে, তারাও বুঝেছে এর সম্ভাবনা, আর তারা বুঝেছে সরকারও আরও বেশি করে সে সম্ভাবনাকে উৎসাহ দিতে আগ্রহী হয়েছে।’’
মঁ ভয়াজের কর্ণধার স্বাতী রায় আমাদের জানিয়েছিলেন, সালামথাং ইকো টুরিজম ডেভেলপমন্ট বোর্ড তৈরির কথা। এ সব স্বপ্নসন্ধান শুরু হয়েছিল সালামথাং থেকেই। যেখানে হোম স্টে টুরিজম প্রবর্তন করে সমাজবৈজ্ঞানিক বদল ঘটিয়ে দিয়েছিলেন অমৃত শর্মা। যিনি আর্বান মাইগ্রেশনের অভিমুখ উল্টো পথে হাঁটিয়ে দিয়েছিলেন। এবং সেখান থেকেই সম্ভাব্য আরও টুরিস্ট স্পট বেছে নিয়ে সিকিম সরকারের সহযোগিতায় সেখানে হোম স্টে বানানো, যার ভিত্তিই হবে ইকো টুরিজম। কামারে এবং থাসা সেই প্রকল্পেরই অন্তর্ভুক্ত।
কামেরের ভূতের গল্পটা বলা বাকি রয়ে গিয়েছিল আগের পর্বে। ভূত নেই। লোক কথা আছে। অন্ধ বিশ্বাসও যে নেই, তা নয়। ভূতের ক্ষেতের গল্পটা হল, কোনও এক সময়ে এক পরিবারের উপর ভার পড়েছিল পুরো বন কেটে সাফ করে ক্ষেত বানানোর। সে দায়িত্ব পাওয়ার পর রাতারাতি নাকি তৈর হয়েছিল বিশাল এলাকা জুড়ে ক্ষেত। এক রাতে অতটা জায়গা জুড়ে ক্ষেত বানানো মানুষের পক্ষে অসম্ভব। ফলে চালু হয়ে গেল কথা- যে এ ক্ষেত নিশ্চিত ভূতেরই।
যদি কেউ একটা গোটা ভ্রমণপরিকল্পনার মধ্যে থাসা ও কামেরে দুটোকেই ঢুকিয়ে ফেলতে চান, তাহলে কামেরে দিয়ে শুরু করতে পারেন। কামেরের অর্গানিক ফার্মিং ও কৃষিপরিবারের ন্যূন ব্যবহার্য জীবনের আস্বাদ গ্রহণের পর সিংতাম হয়ে পাড়ি দেবেন থাসার রাস্তায়। যেখানেই যাবেন, পেশাদার হোটেলের কর্মীদের পেশাদারি হাস্যমুখ নয়, বরণ করে নেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে থাকবেন গ্রামের বা পরিবারের মহিলা এবং খুদেরা।
সিকিমের কামেরে গ্রামে এক অনুষ্ঠানে বিদেশি ও সরকারি অতিথিদের সামনে খুদে বাসিন্দাদের অনুষ্ঠান pic.twitter.com/pt84tF2qoF
— IE Bangla (@ieBangla) October 20, 2018
কামেরের জীবন থেকে সম্পূর্ণ পৃথক স্বাদের জীবনযাত্রার শরিক হবেন থাসাতে। সেখানে গিজার থেকে মনোলোভা শয্যা ও আহারের বন্দোবস্ত আপনাকে আয়েসি করে তুলতে চাইবে। তবে হাতে সময় কম থাকলে আয়েসের সুযোগ নেই। অজস্র হাতছানি। মাছ ধরা কিংবা ট্রেকিং- এ দুয়েরই বিশেষ ব্যবস্থা থাকবে। থাকবে লোকগানের আসর সন্ধেবেলা, চাইলে স্থানীয় পানীয় সহযোগে। জৈব চাষে যদি উৎসাহ নিয়ে যান কিংবা উৎসাহিত হয়ে পড়েন সেখানে গিয়ে, সে চাষে অংশ নেওয়ার বিশেষ বন্দোবস্তও থাকবে। ৩০০বছরের পুরনো এক বাড়ি আছে সেখানে। পাথরের সে বাড়ি এখনও দিব্য আছে। সেখানে মানুষজন বসবাস করেন। এরকম হেরিটেজ হাউস অবশ্য একটিই নেই, রয়েছে বেশ কয়েকটি। কামেরা বা থাসার পর্যটনকে জনপ্রিয় করার দায়িত্ব নিয়েছেন যিনি, সেই মঁ ভয়াজের স্বাতী রায় জানালেন, ‘‘কিছুদিনের মধ্যেই আরও বেশ কয়েকটা বাড়িতে হেম স্টে-র বন্দোবস্ত করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে সিকিম সরকারের পর্যটন বিভাগের সঙ্গে আমাদের কথা বার্তা প্রায় সারা।’’
কামেরে-থাসা-সালামথাংয়ের দিন রাত গুলো কাটিয়ে আসার পর, দৈনন্দিন জীবনযাত্রা যখন পুরোদমে ফের শুরু হয়ে যাবে- তখন কোনও এক আলোকোজ্জ্বল শহুরে দিনে বা রাতে হঠাৎ মনে পড়ে যাবে সেই পাহাড়িয়া সুরের কথা। যা ফেলে আসা হয়েছে এক তেলেনাপোতার মতই। সে মনে পড়াটা ট্র্যাজেডি বটে- কিন্তু তফাৎ হল পুনরাবিষ্কারের জন্য থাসা-কামেরে রয়ে যাবে- তেলেনাপোতার মত চিরতরে হারিয়ে যাবে না।