রবীন্দ্রনাথের সাথে ত্রিপুরার রাজ পরিবার আর ত্রিপুরার মানুষের যোগাযোগ নিয়ে নতুন করে বোধহয় আর বিশেষ কিছু বলবার নেই। একদা তরুণ কবি রবীন্দ্রনাথের একটি কাব্যগ্রন্থ সদ্য পত্নীহারা এক শোকাহত ত্রিপুরা নরেশের হৃদয়কে দিয়েছিল অনাবিল শান্তির স্পর্শ। জোড়াসাঁকোর সেই তরুণ কবিকে নিজের রাজ দরবারের সভাকবি করার প্রস্তাব নিয়ে রাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যের প্রধানমন্ত্রী রাধারমণ ঘোষ হাজির হয়েছিলেন কবির বাড়িতে। রবীন্দ্রনাথ রাজি হন নি বটে, কিন্তু ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সঙ্গে তাঁর মিত্রতার সেই ছিল শুভারম্ভ।
এরপর বারবার রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরা গিয়েছেন রাজ অতিথি হয়ে। ১৮৮৭ সালে 'রাজর্ষি' উপন্যাস লিখলেন ত্রিপুরার রাজপরিবারকে পটভূমি করে। ১৮৯০ সালে সেই উপন্যাসকে রূপ দিলেন 'বিসর্জন' নামক এক নাটকে, যা আজও রক্তকরবীর পর রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ নাটক বলে বিবেচিত হয়।
ত্রিপুরায় একজন নয় - পরপর তিনজন মহারাজার ভালবাসা এবং আন্তরিক আনুগত্য জয় করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। প্রথমে বীরচন্দ্র মাণিক্য (১৮৬৯-১৮৯৯), তস্য পুত্র রাধাকিশোর মাণিক্য (১৮৯৯-১৯০৯) এবং শেষ পর্বে তাঁর পুত্র বীরবিক্রম কিশোর দেববর্মণের। এদেরই আমন্ত্রনে রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরায় এসে বাস করেছেন দুটি অনবদ্য স্থাপত্যকীর্তিতে। একটি আগরতলা শহরের জয়ন্ত প্রাসাদ। অন্যটি ১৯২১ সালে রুদ্রসাগরের মাঝে তৈরি হওয়া নীরমহল প্রাসাদ, যা রাজস্থানের উদয়পুর ছাড়া ভারতের একমাত্র লেক প্যালেস। এছাড়াও বীরচন্দ্র মাণিক্যের পুরোনো প্রাসাদেও কবি থেকেছেন কিছুদিন।
এখানেই রবীন্দ্রনাথ আর ত্রিপুরার রাজ পরিবারের ইতিহাসের ইতি নয়। অনেকরই হয়তো জানা নেই যে এই তিনটি রাজপ্রাসাদ ছাড়াও রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরা রাজপরিবারের আরও একটি বাসস্থানে একাধিকবার রাত কাটিয়েছেন এবং আজ সেই একই প্রাসাদে অর্থের বিনিময়ে আপনিও রাত কাটাতে পারবেন। যে রাজকীয় মেহগনি খাটে রবীন্দ্রনাথ শুয়েছেন, আপনিও পারবেন সেই খাটে গড়াগড়ি খেতে। যে লেখার টেবিলে বসে রবীন্দ্রনাথ লেখালিখি করেছেন, আপনিও পারবেন সেখানে বসে ল্যাপটপ চালাতে।
রবীন্দ্রনাথ বাদ দিন - আপনার যদি ইচ্ছে হয় মেসি বা মাইক টাইসনের স্পর্শমাখা কোনও পানশালায় বসে দুপাত্তর গলায় ঢালার, তারও ব্যবস্থা আছে এই একই স্থানে - ইতিহাস আর আধুনিকতার এহেন মিশ্রণ আজও আছে রাজ পরিবারের প্রাসাদে। যার নাম বড় আদর করে 'ত্রিপুরা ক্যাসেল' রেখেছিলেন বীরবিক্রম কিশোর দেববর্মণ সেই গত শতাব্দীর বিশের দশকে।
'ত্রিপুরা ক্যাসেল' - ত্রিপুরা রাজপরিবারের এই অমূল্য রত্নটি অবশ্য ত্রিপুরায় নয় - অবিভক্ত আসাম এবং অধুনা মেঘালয়ের রাজধানী শিলং শহরে। যে শিলংয়ের সাথে রবীন্দ্রনাথ চিরদিন জড়িয়ে থাকবেন তাঁর শেষ এবং অনবদ্য উপন্যাস 'শেষের কবিতার' সৌজন্যে।
শিলংয়ের প্রেমে বীররিক্রম কিশোর প্রথম পড়েন যৌবনে যখন এখানে আসেন সামরিক শিক্ষার জন্য, যেসময় পঞ্জাব, সিন্ধ, কাশ্মীর আর উত্তর ভারতের রাজপরিবাররা সিমলায় এবং বর্ধমান, কোচবিহার, বিহার এবং নেপালের রাজপরিবাররা দার্জিলিংয়ে একের পর এক প্রমোদ প্রাসাদ বানিয়ে চলেছেন। সেই একই সময়ে শিলং সেজে উঠছিল আসাম, নেপাল এবং ত্রিপুরার ধনীদের প্রাসাদে।
উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে হিমালয়ের আনাচে কানাচে একের পর এক শৈল শহরের পত্তন শুরু করে দেয় ইংরেজরা। শিবালিক, কুমাওন, পীরপাঞ্জাল, গাড়োয়াল সহ আরও নানা হিমালয় অঞ্চল জুড়ে একে একে গড়ে উঠতে থাকে নৈনীতাল, মুসৌরী, ডালহৌসী, ল্যান্সডাউন, রাণীক্ষেত সহ বহু অসাধারণ শৈল শহর। এদের মধ্যে সিমলা আর দার্জিলিংকে রীতিমতো 'লিটল ইংল্যান্ড' বানিয়ে তোলার উদ্যোগ শুরু হয়ে যায় কিছু বছরের মধ্যে। পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রযুক্তির প্রয়োগে সিমলা আর দার্জিলিংকে সমতলের সঙ্গে জুড়ে ফেলা হয় ন্যারো গেজ রেললাইন দিয়ে। কোম্পানির গর্ভনর জেনারেল স্বয়ং সমতলের প্যাচপ্যাচে গরম থেকে বাঁচতে ঘনঘন আশ্রয় নিতে শুরু করেন এই দুটি নতুন শৈল শহরে।
পূর্বভারতের আসামে তখন শুরু হয়েছে ব্রিটিশ আগ্রাসন। ১৮২৯ সালে ডেভিড স্কট নামক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর এক কর্তা খাসি, জয়ন্তীয়া আর গারো পাহাড়ের কোলে প্রথম চেষ্টা করেন শৈলাবাস গড়ে তোলার। সে চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর ১৮৩৫ সালে চেরাপুঞ্জিতে চেষ্টা করা হয় আবার। সেটাও ব্যর্থ হওয়ায় ১৮৬৪ সালে স্থানীয় খাসি নেতাদের থেকে হঠাৎ এমন একটা জায়গার হদিশ পাওয়া যায়, যার সঙ্গে নাকি হুবহু মিল স্কটল্যান্ডের পল্লী অঞ্চলের - এভাবেই উপনিবেশিক শৈল শহরের মানচিত্রে যোগ হয়ে যায় আসামের (তখনও অবিভক্ত আসাম - আসাম ভেঙে মেঘালয় হতে তখনও অনেক দেরি) শিলং। শিলংকে ছোট স্কটল্যান্ড বানানোর স্বপ্নটা এতটাই জোরালো ছিল যে সুদূর অস্ট্রেলিয়া আর ইউরোপ থেকে ফল ফুলের চারা এনে লাগানো হয় এখানে। ভারতীয়দের প্রথম দিকে বেশ কিছু এলাকায় জমিও কিনতে দেওয়া হত না - পরে অবশ্য নিয়মটা উঠে যায়।
ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে চার্চ, ক্লাব, বেকারি, কনভেন্ট স্কুল, গল্ফ কোর্স আর একের পর এক রাজ পরিবারের প্রমোদ দুর্গ। 'ত্রিপুরা ক্যাসেল' অবশ্য কোনো প্রথাগত দুর্গ নয় - এক বিলাসবহুল শৈল প্রাসাদ মাত্র, যা গড়ে উঠেছে ইউরোপীয় ও মেঘালয় স্থাপত্যরীতির মেলবন্ধনে। এই ধরণের স্থাপত্য রীতির নাম 'পাইনাস খাসিয়ানা'। দামি বর্মা টিক কাঠ ছাড়াও এর পাথর এসেছিল চেরাপুঞ্জি থেকে। সে পাথরের নাম চেরাস্টোন।
শিলং যদি হয় প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড তবে সেই নামকে স্বার্থক করেছে 'ত্রিপুরা ক্যাসেলের' স্থাপত্য নকশা। লন্বা টানা বারান্দার ধার ধরে একের পর এক অতিথি নিবাস, যার দরজা-জানলা এবং আসবাবপত্র ভীষণভাবে ইউরোপীয়। তবে ব্যতিক্রম রুম নং ৩০২ এর খাট। এই সেই ঘর যেখানে একাধিকবার রাত কাটিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। এ ঘরে আজও সযত্নে রাখা আছে তাঁর ব্যবহৃত খাট এবং লেখার টেবিল। লেখার টেবিলটি উনবিংশ শতকের ইউরোপীয় আসবাবের ঘরানার অনবদ্য নিদর্শন। যেখানে অসংখ্য ছোট দেরাজ ছাড়াও রয়েছে আটটি ছোট ছোট খোপ।
টেবিলের পাশে স্বগর্বে অধিষ্ঠিত একটি ঘোষণাপত্র। যা মনে করায় ত্রিপুরার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘ সম্পর্ক ও মাণিক্য রাজবংশের পটভূমিতে লেখা তাঁর দুটি স্মরণীয় সৃষ্টি, 'মুকুট' ও 'রাজর্ষি'। বলে রাখা ভাল, প্রাসাদে রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত দুটি পালঙ্ক আছে। যদিও সে দুটি রয়েছে প্রাসাদের নতুন অংশে, যেটি রবীন্দ্রনাথের সময় তৈরি হয়নি।
'ত্রিপুরা ক্যাসেল'-এ আজও আছে যুদ্ধের সময় আশ্রয় নেওয়ার জন্য বাঙ্কার এবং সুড়ঙ্গপথ। এখানে দেওয়াল জুড়ে রয়েছে অসংখ্য বিরল সাদাকালো ছবি, তৈলচিত্র, বাহারি বাতিদান, পুরোনো আমলের রেডিও, গ্রামোফোন, টেলিফোন যন্ত্র, আরও অনেক কিছু। ২০০৩ সাল থেকে 'ত্রিপুরা ক্যাসেলের' একাংশ উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রথম হেরিটেজ হোটেলের স্বীকৃতি পায়। 'হেরিটেজ'-এর যাবতীয় চিহ্ন পরিষ্কার বোঝা যায় এ প্রাসাদের ডাইনিং হলে ঢুকলে। দেওয়াল জোড়া অসংখ্য ছবির সাথে তাল মিলিয়ে তৈরি করা হয়েছে 'রাইস কোর্ট' নামক এই বিলাসি ভোজনালয়। এখানেই চেখে দেখা যাবে মেঘালয়ের বিখ্যাত খাবার দোজখিলি আর তুংটাপ - একটা শূয়োরের মাংস, অন্যটা শুঁটকি মাছের পদ।
রবীন্দ্রনাথ অবশ্য থেমে থাকেননি ক্লিভ কলোনীর এই হেরিটেজ হোটেলে। ত্রিপুরার বর্তমান রাজা প্রদ্যুৎ বিক্রম মানিক্য দেববর্মণ খেলা পাগল মানুষ। শিলংয়ের সেন্ট অ্যান্টনি কলেজের স্নাতক তরুণ প্রদ্যুৎ বিক্রমকে বলা হয় উত্তরপূর্ব ভারতের সবথেকে 'এলিজিবল ব্যাচেলর'। শিলংয়ের লাজং ফুটবল ক্লাবের অংশীদার প্রদ্যুৎ সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ান খেলা দেখার জন্য। 'ত্রিপুরা ক্যাসেলের' ভিতর এক নতুন অংশে তাঁর তৈরি পানশালা 'ক্যাফে হেরিটেজ'-এর দেওয়ালে দেওয়ালে ছড়িয়ে আছে চমকে ওঠার মতন স্মৃতি স্মারক। রয়েছে ওয়েন রুনির সই করা ফুটবল বুট, মাইক টাইসনের সই করা বক্সিং গ্লাভস।
তবে যে স্মারকটি দেখলে কয়েক মূহুর্তের জন্য বুকের ভিতরটা ছলাৎ করে উঠবে, সেটা হল বার্সিলোনা ফুটবল ক্লাবের একটা দশ নম্বর জার্সি, যার নীচে পরিষ্কার লেখা আছে -"Personally signed by Lionel Messi - F.C. Barcelona."
রবীন্দ্রনাথ থেকে মেসি - ঐতিহ্যের মিছিল বুকে নিয়ে 'ত্রিপুরা ক্যাসেল' আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে প্রাচ্যের স্কটল্যান্ডের বুকে।