আকাশ ঢেকেছে ঘন কালো মেঘে। সঙ্গে প্রবল বেগে বইছে ঝোড়ো বাতাস। গাড়ির জানালার কাচ ভেদ করে সেই বাদলমেঘ আর বাতাস ছুঁয়ে দিচ্ছে আমায়। উথালপাথাল এক প্লাবন টের পাচ্ছি অন্তরজগতে। এ তো হওয়ারই কথা। এই বেদনা, এই মহার্ঘ যন্ত্রনা বহন না করলে এই দেশের, ভারত ভূখণ্ডের অধিবাসী হওয়াটাই তো মিথ্যে হয়ে যাবে।
বহরমপুর থেকে ভাগীরথী পার হয়ে চলেছি খোশবাগ দর্শনে। নাহ, নদীপথে নয়। সে দিন গেছে। এখন এপার ওপার ফ্লাইওভারে নদী পারাপার, নাওয়ের বদলে চারচাকা গাড়িতে। খোশবাগ। এখানেই চিরশান্তির ঘুমে শুয়ে আছেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব। নবাব সিরাজৌদ্দল্লা। যেমন বর্ণময় জীবন, তেমনই মর্মান্তিক তাঁর অন্তিম পরিণতি। আমার মুর্শিদাবাদের প্রতি অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণের কেন্দ্রে শুরু থেকেই ছিলো খোশবাগ। তার কারণ নিঃসন্দেহে সিরাজের বিতর্কিত ও বহু বর্ণে রঞ্জিত জীবনগাথা। তাঁকে নিয়ে নিন্দার বিস্তর তথ্য রয়েছে ইতিহাসের পাতা জুড়ে। তবু এ সত্য ইতিহাসও অস্বীকার করতে পারবে না, যে তিনি ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধের পথিকৃৎ।
পাঠক স্মরণ করুন সেই লজ্জার ইতিহাস। বেনিয়া ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত ধরে ভারতে ব্রিটিশ শাসন কায়েম হওয়ার যুগসন্ধিক্ষণ। সেদিন পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজৌদ্দল্লার পরাজয়ের সঙ্গে সঙ্গে দুশো বছরের জন্য পরাধীন হয়েছিল এই উপমহাদেশ, স্বাধীনতা হারিয়েছিল একটি জাতি। বলা যায়, এই আবেগ, এই গুরুত্বই ভূমিকায় নিয়ে আসে খোশবাগকে। প্রসঙ্গত, এখানে, এই বর্ষণ মুখরিত দিনে আসাটা আমার দ্বিতীয়বার খোশবাগ তথা মুর্শিদাবাদ ভ্রমণ।
প্রথমবার যাই ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি। খোশবাগ তখন বসন্তের মিঠে রোদ্দুরে মাখামাখি। ভিতরের বাগানে গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়ে চুইয়ে পড়ছে রোদ, তাতে বেশ সুন্দর এক আলোছায়ার আলপনা তৈরি হয়েছে। খোশবাগ নবাব আলিবর্দী খাঁর পারিবারিক সমাধিস্থল। তাঁর পরিবারের প্রায় সকলেই শায়িত এখানে। কেন জানি না, গাইডের মুখে খোশবাগের ইতিহাস শুনতে শুনতেই মনে হচ্ছিল, এখানে একবার ভরা বর্ষায় আসতে হবে। অনুভব বলছিল, আকাশের কান্না আজও ধুয়ে দেয় খোশবাগে শায়িত সিরাজ, মেহেরুন্নেসার নশ্বর দেহ উপরিস্থিত সমাধি। দ্বিতীয়বার আসা সেই কান্নায় অবগাহনের জন্যই, শুরুতেই যা বলেছি।
রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়ায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল এই ঐতিহাসিক মহার্ঘ সম্পদ। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ দায়িত্ব নেওয়ার পর অবস্থা বদলেছে। দেশের অন্যান্য ঐতিহাসিক মূল্যবান স্মৃতিসৌধগুলির মতো করেই মুর্শিদাবাদের খোশবাগ, কাটরা মসজিদ, হাজারদুয়ারী, ইমামবড়া, মোতিঝিল, বাচ্চাওয়ালি তোপ ইত্যাদি রক্ষণাবেক্ষণ করছে এই বিভাগ। আর দফতরের পক্ষ থেকে প্রশিক্ষিত গাইডও রাখা হয়েছে প্রত্যেকটি কেন্দ্রে।
মুর্শিদাবাদ, বাংলা তথা ভারতের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় । ইতিহাস মানে ঐতিহ্য। ইতিহাস মানে হারিয়ে যাওয়া দিনের কথা। ইতিহাস হলো সময়ের দলিল। সেই সময়, যার ঝলক মেলে ঐতিহাসিক কেন্দ্রগুলিতে। মুর্শিদাবাদ সেখানে এক প্রথম সারির নাম। শিল্প ও স্থাপত্যকীর্তির উজ্জ্বল সমাবেশ ঘটেছে এখানে। এই বর্ণাঢ্য সময়কে দেখতেই মুর্শিদাবাদ ভ্রমণ।
দ্রষ্টব্যের অভাব নেই মুর্শিদাবাদে। একদা বাংলা-বিহার-ওড়িশার রাজধানী বলে কথা! ধ্বংস ও অবলুপ্তির পরও যা আছে, তা দেখার জন্য কমপক্ষে ৩/৪ দিন জরুরি। সমান জরুরি কিছুটা হোমওয়ার্ক করে যাওয়া। প্রচুর বইপত্র আছে। তবে, চটজলদি জানতে গুগলদাদুই ভরসা। সত্যি কথা স্বীকার করতে লজ্জা নেই, হোমওয়ার্ক করতে গিয়েই দেখলাম, মুর্শিদাবাদ সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানা নেই আমার। আর গিয়ে দেখলাম, পড়ে যা জেনেছি, তাও অসম্পূর্ণ। আমি দুবার গেছি, তাতেও বাকি থেকে গেছে অনেক।
খোশবাগ দিয়ে আমার যাত্রা শুরু। ভাগীরথীর তীরে এই গোলাপবাগান ছিল নবাব আলীবর্দী খাঁয়ের পারিবারিক অবকাশ যাপনের প্রিয় ক্ষেত্র। পরিবারের সবাইকে নিয়ে বজরায় করে এখানে আসতেন তিনি। গোলাপের খুশবু থেকেই খোশবাগ নামকরণ। বড় আনন্দের ছিল সেই দিন। আলীবর্দীর পেয়ারের নাতি সিরাজ। সিরাজ চাইলে আকাশের চাঁদ এনে দিতে পারেন তিনি। সেখানে মেহেরুন্নেসার প্রতি সিরাজের প্রেম মেনে নেবেন না? হোক না সে এক দাসীকন্যা! যদিও ইতিহাস বলে, দাসীকন্যা হলেও মেহের ছিল রূপ ও গুণে অনন্যা। ব্যক্তিত্বশালিনীও বটে। আর প্রেম? সিরাজ তাঁকে যত না, তার বহুগুণ মেহের ভালবেসেছিলেন সিরাজকে।
সিরাজের মৃত্যুর পরও বছর সাতেক বেঁচেছিলেন মেহের। ঢাকা থেকে ব্রিটিশ সরকার যখন তাঁকে মুর্শিদাবাদ নিয়ে আসে, তখন তাঁর একটাই প্রার্থনা, তাঁকে যেন খোশবাগে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়। ইংরেজ সরকার সদয় হয়েছিল তাঁর প্রতি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রোজ মৃত স্বামী ও কন্যার সমাধির উপর ধূপ ও প্রদীপ জ্বালিয়ে স্মরণ করেছেন এই অসাধারণ নারী। এছাড়া সম্পূর্ণ সমাধিক্ষেত্রই পরিষ্কার রাখা, দেখভাল করার দায়িত্বে ছিলেন তিনি। এ বাবদ মাসোহারাও পেতেন ইংরেজ সরকারের কাছ থেকে। মৃত্যুর পর সিরাজের সমাধির নিচেই রচিত হয় মেহেরের সমাধি, তাঁরই একান্ত ইচ্ছায়।
গাইড ছেলেটি বলে যাচ্ছিলেন ইতিহাস। ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম খোশবাগ। গেটের মুখে গাড়ি থামিয়ে টিকেট কেটে ঢোকা, গাইড পেয়ে গেলাম সেখানেই। ইটের বাঁধানো পথ সোজা চলে গেছে। দুপাশে সবুজ গালিচার মতো নরম ঘাস। প্রাচীন গাছেরা দাঁড়িয়ে। বড় শান্ত ও নির্জন খোশবাগ। চারপাশ উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। একদিকের পাঁচিলের গায়ে কিছু চিহ্ন, এক আস্তানার আভাস। ওই ঘরেই থাকতেন একাকিনী মেহেরুন্নেসা। খোশবাগে সিরাজ, মেহের, তাঁদের কন্যা ছাড়াও আছেন সিরাজের এক প্রেমিকা। কথিত আছে, এই হিন্দু কন্যা যুদ্ধের সময় সিরাজের হয়ে গুপ্তচরের কাজ করতেন। ভিতরে একটি মসজিদও আছে। দিনের শেষে আলীবর্দী তাঁর পরিবারবর্গের সঙ্গে এখানেই বসে নমাজ পড়তেন।
খোশবাগে সমাধিস্থ আছেন নবাব আলীবর্দী, তাঁর বেগম, সিরাজের ছোট ভাই ও দুই মাসি, যার একজন ঘসেটি বেগম। ইনি ইতিহাসে কুখ্যাত সিরাজের বিরুদ্ধে অন্যতম ষড়যন্ত্রী হিসেবে। ইতিহাস অবশ্য তাঁকেও ক্ষমা করেনি। এছাড়াও এখানে সমাধিস্থ নবাব পরিবারের আত্মীয়স্বজন, ঘনিষ্ঠ সহচর, পারিষদ, খাস পরিচারক এক-দুজন। তাঁদেরই কেউ কেউ আবার ছিলেন সিরাজ হত্যার মূলে। খোশবাগের প্রায় ৩০/৩১টি সমাধির ক্ষেত্রে মাত্র দুজনের স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছিল - আলীবর্দী ও মেহেরুন্নেসা। বাকি সব অপঘাত। হত্যা, ষড়যন্ত্র, প্রতিহিংসা, লোভ ও লালসার ফসল। কালের নিয়মে ভাগীরথী সরে গেছে অনেক দূরে। পারাপার আজও চলছে। শত ইতিহাসের সাক্ষী ভাগীরথী বহতা আপন ছন্দে। কান পাতলে আজও শোনা যায় কান্না আর হাহাকার।
খোশবাগ ছেড়ে যেতে যেতে বলি, আবার আসবো। আসতেই হবে। ইতিহাস বড় জীবন্ত এখানে। অনুমতি পেলে কোনও এক পূর্ণিমা রাতে মুখোমুখি হব প্রেম ও অপ্রেমের সেই ইতিহাসের। সিরাজ ও মেহের। সিরাজ ও ঘসেটি। রাজত্বের লোভ শুধু নয়, সিরাজের প্রতি ঘসেটির বিরাগের ভিন্ন কারণও ছিল। কিছু কিছু ঐতিহাসিকের মতে, দীর্ঘদেহী, রূপবান ও বীর্যবান এবং চূড়ান্ত বেপরোয়া স্বভাবের বোনপোটির প্রতি ঘসেটির তীব্র অনুরাগ জন্মায়, যাতে সাড়া দেননি সিরাজ। এরপর ঘসেটির অনুরাগ বিরাগে পরিণত হতে দেরি হয়নি।
রূপসী, ব্যক্তিত্বময়ী ঘসেটির জীবনেও শান্তি ছিল না। আলীবর্দী সিরাজকে মসনদে বসানোর পর থেকেই ঘসেটির ষড়যন্ত্র প্রক্রিয়া শুরু। যেখানে তাঁর সহ কুচক্রীরা ছিলেন মীর জাফর ও জগৎ শেঠ। ষড়যন্ত্রের শেষ পলাশীর যুদ্ধে। তারপর একে একে পতন। শোনা যায়, নদীবক্ষে নৌকা থেকে ঠেলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল ঘসেটি বেগমকে। জলেই শেষ উচ্চাকাঙ্ক্ষী এই নারীর জীবন। অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। স্বামী নওয়াজিশ মুহম্মদ খান যথেষ্ট ভালবাসতেন ঘসেটিকে। পত্নীপ্রেমিক নওয়াজিশ ঘসেটির জন্য নির্মাণ করেন মোতিঝিল প্রাসাদ। মোতিঝিলের পিছনে প্রাসাদ, সেই নামেই নাম। পরবর্তীতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত হয় এই প্রাসাদ, সেই থেকে কোম্পানি বাগও বলা হয় একে।
ঘোড়ার খুরের মতো আকৃতির মোতিঝিল এখানকার অন্যতম দ্রষ্টব্য, যা একদা বিখ্যাত ছিলো মুক্তো চাষের জন্য। নওয়াজিশ ও পরিবারের অন্যদের স্মৃতিসৌধ মোতিঝিল সংলগ্ন প্রাসাদ। আজ অবশ্য প্রাসাদ না বলে তাকে ধ্বংসস্তূপ বলাই ভালো। তবে ধ্বংসের মাঝেও উঁকি মারে নবাবী শান শহকৎ। অনেকটা ছড়ানো জায়গা জুড়ে প্রাসাদ ও ঝিল দাঁড়িয়ে অতীতের সাক্ষী হয়ে। মসনদে বসার পর থেকেই সিরাজের সঙ্গে ঘসেটির শত্রুতা। মোতিঝিল পরে সিরাজ অধিগ্রহণ করেন। এছাড়াও নিজের বসবাসের জন্য তিনি তৈরি করিয়েছিলেন হিরাঝিল। জাঁকজমকের চূড়ান্ত ছিলো এই প্রাসাদ। ভাগীরথীর এক পাড়ে মোতিঝিল, অন্য পাড়ে হিরাঝিল। মোতিঝিল দাঁড়িয়ে , হিরাঝিল তলিয়ে গেছে ভাগীরথীর গর্ভে।
সর্বত্রই ক্যামেরা নিয়ে যাবার অনুমতি আছে, দুটি জায়গা ছাড়া - হাজারদুয়ারী ও জগৎ শেঠের বাড়ি। হাজারদুয়ারীর মূল অংশে পৌঁছনোর আগে অনেকটা ধাপ সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়। এই সিঁড়ির ওপর থেকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করে গাইড দেখালেন, ওই ওখানে ছিল হিরাঝিল। ভাগীরথী শুনে যেন মুচকি হেসে বলল, সব যাবে কালের অতলে, আমি বয়ে যাবো চিরন্তন।
হাজারদুয়ারী প্রসঙ্গ এসেই গেল কথায় কথায়। প্রবেশদ্বারে নিরাপত্তার বাড়াবাড়ি। কারণও আছে তার। ব্রিটিশ আমল হোক বা স্বাধীনতা পরবর্তী ভারত, মূল্যবান ঐতিহাসিক নিদর্শন চুরি অব্যাহত। নামের উল্লেখে হাজার দুয়ার। সত্যি কি হাজারটি দ্বার অর্থাৎ দরজা রয়েছে এই প্রাসাদের? আসলে এর মধ্যে বেশ কয়েকটি দরজা চোখের ভ্রম তৈরি করে। দেওয়ালের গায়ে এমনভাবে ডিজাইন করা, মনে হবে দরজা, আসলে দেওয়ালেরই অংশ। শত্রুর চোখকে ফাঁকি দিতেই এই নির্মাণ, বুঝতে অসুবিধা হয় না। অবাক লাগে অত যুগ আগে স্থাপত্যের এই আধুনিক, বিজ্ঞানসম্মত কৌশল প্রয়োগ দেখলে।
আদতে এটি নবাবী আমলের একটি দুর্গপ্রাসাদ। পুরো চত্বরটাকে বলে নিজামত কিলা ক্যাম্পাস। তৈরি হয় নবাব নাজিম হুমায়ুন জাহের আমলে। বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারস-এর ডানকান ম্যাকলিওড ছিলেন এই অনবদ্য স্থাপত্যকলার রূপকার। হাজারদুয়ারী দেখার জন্য একটা দিন পুরো লেগে যায়। এই অসাধারণ ঐতিহাসিক সংগ্রহশালা শুধু মুর্শিদাবাদ বা বাংলা নয়, সমগ্র ভারতের এক বর্ণময় ইতিহাসের সাক্ষী। একাধিক নবাবী আমলের ব্যবহার্য মূল্যবান সামগ্রী সংরক্ষিত এখানে। স্থাপত্য মুগ্ধ করে দেয়। কয়েকটি তলা জুড়ে বিভিন্ন প্রকোষ্ঠে বড় সুন্দরভাবে রক্ষিত সামগ্রীগুলি দেখা ও ইতিহাসকে জানা মুর্শিদাবাদ ভ্রমণের অন্যতম সেরা অভিজ্ঞতা বলতে পারি।
হাজারদুয়ারীর পাশেই ইমামবড়া। এরও ঐতিহাসিক গুরুত্ব অসীম। ঈদ উৎসবে দরজা খুলে দেওয়া হয় নমাজ পড়ার জন্য। এছাড়া অবশ্য এর ভিতরে প্রবেশের সুযোগ নেই। যদিও সাদা ধবধবে রঙের দামি পাথরে তৈরি এই সৌধ বাইরে থেকে দেখতেও বেশ ভালো লাগে।
জগৎ শেঠের বাড়িও এখন সংগ্রহশালা। জগৎ শেঠ ছিলেন সেই সময় মুর্শিদাবাদের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ এক নাম। প্রায় নিয়ামক বলা যায়। তাঁর এই প্রভাব প্রতিপত্তি ব্রিটিশ আমলেও বহাল ছিলো। এই সংগ্রহশালায় প্রবেশের পর প্রথম যেটা মনে এলো, নবাবী শান সৌকর্যের সঙ্গে শেঠ পরিবারের রুচির তফাৎ। অর্থানুকূল্য এখানেও কিছু কম নেই। তবে ওই যে, শিল্প ও সৌন্দর্যবোধ , সে তো শুধু টাকায় হয় না। এখানে দেখা তিনটি জিনিষ বিশেষ ভাবে মনে আছে। একটি মসলিন শাড়ি, যা কিনা একটি দেশলাই বাক্সে ভরে ফেলা যায়। একটি খাবারের প্লেট, দেখতে অতি সাধারণ, যদিও বিশেষত্ব মারাত্মক। খাবারে বিষ মেশানো হয়েছে কিনা, সেটা এই প্লেটে রাখলেই ধরা পড়ে যাবে, বদলে যাবে খাবারের রং। যুগটা তখন সর্বার্থেই যে ষড়যন্ত্রকারীদের দখলে, বুঝতে অসুবিধা হয়না। এরই সঙ্গে কুর্নিশ জানাতে হয় সেই নাম না জানা রসায়নবিদকে, যিনি এর স্রষ্টা। তৃতীয়টি একটি সুড়ঙ্গ পথ, যা স্থলপথ হয়ে , তারপর ভাগীরথীর মাধ্যমে চলে গেছে কাঠগোলাপ বাগ পর্যন্ত।
এই কাঠগোলাপ বাগও দেখার মতো। বিশাল এলাকা জুড়ে কাঠগোলাপ ফুলের বাগান। নির্মাতা ধনী অভিজাত জমিদার, রায় বাহাদুর লক্ষীপত সিং দুগার। মুর্শিদাবাদের আর্থিক ক্ষেত্রে ইনিও এক গুরুত্বপূর্ণ নাম। অবকাশ উদযাপনে ওঁরা সপরিবারে বা সপারিষদ আসতেন এখানে। বাগানের উঁচু কারুকার্যখচিত গেট থেকে সোজা রাস্তা চলে গেছে বাগানের মাঝ বরাবর। ভিতরে খুব সুন্দর একটি মন্দিরও আছে। সালঙ্কারা দেবীমূর্তির গঠন ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য বস্তু মনে করিয়ে দেয় সেকালের ধনসম্পদের প্রাচুর্য্যকথা। তারপরের ইতিহাস লুঠের।মুর্শিদাবাদ থেকে বহুল পরিমান সম্পদ লুঠ করেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। সে সম্পদ এখন লন্ডনের মিউজিয়াম আলো করছে।
সাল ১৭০৪। সম্রাট ঔরংজেব ঢাকা থেকে বাংলার রাজধানী স্থানান্তরিত করলেন ভাগীরথী তীরে। তখনও মুর্শিদাবাদ নামকরণ হয়নি। বাংলার দেওয়ান তখন মুর্শিদ কুলি খাঁ। তিনিই নিজের নামে বাংলার রাজধানীর নামকরণ করলেন মুর্শিদাবাদ। ১৭১৬ খ্রিস্টাব্দে নবাব খেতাব পেলেন মুর্শিদ কুলি খাঁ। বাংলার প্রথম নবাব। বাংলার সীমানা তখন বিহার ও ওড়িশা পর্যন্ত বিস্তৃত। সেই বিশাল অঞ্চলের রাজধানী মুর্শিদাবাদ। শোনা যায় নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ অত্যন্ত বিচক্ষণ, উদার ও কীর্তিমান ছিলেন। তাঁর সুশাসনে শান্তি বজায় ছিল সর্বত্র, যা দৃষ্টান্তস্বরূপ।
মুর্শিদ কুলি খাঁ প্রতিষ্ঠিত কাটরা মসজিদ দেখতে আসেন সারা বিশ্বের পর্যটক। অসাধারণ এই সৌধটির স্থাপত্য দেখে একই সঙ্গে মুগ্ধ ও বিস্মিত হলাম। ছোট ছোট বিশেষ আকারের লাল রঙের ইট দিয়ে নির্মিত এই অতি বৃহৎ সৌধ। গাইড জানালেন, এই ইঁটগুলি শুধু এই মসজিদ বানানোর জন্যই তৈরি। অপরূপ এক ফুলের বাগানে ঘেরা এই মসজিদের খোলা ও বিস্তৃত ছাদে এক সঙ্গে বহু মানুষ বসে নামাজ পড়তে পারেন। এই মসজিদের ভিতরেই রয়েছে মুর্শিদ কুলি খাঁর সমাধি, যেখানে শ্রদ্ধায় মাথা নোয়ান সব ধর্মের মানুষ।
ভাগীরথীর দুই তীরে নবাবী থেকে ব্রিটিশ আমল, নানা ধর্ম ও জাতির মানুষের সমাবেশ ঘটেছে। পুরো মুর্শিদাবাদ জুড়ে তাই অসংখ্য প্রাসাদ, মসজিদ, সমাধিক্ষেত্র, স্মৃতিসৌধ, মিউজিয়াম। দেখার মতোই লিখে শেষ করা কঠিন। তারই মধ্যে আরও কয়েকটি না ভোলা স্মৃতি দিয়ে ইতিহাসে ইতি টানবো।
মুর্শিদ কুলি খাঁর দুই কন্যাকে বিয়ে করেন সুজাউদ্দিন মহম্মদ খাঁ। অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিলেন ইনিও। মুর্শিদ কুলির মৃত্যুর পর বাংলার মসনদে বসলেন জামাই সুজাউদ্দিন। বিলাসী ও জাঁকজমকপূর্ণ মানুষটি দুহাতে টাকা ওড়াতেন। তবে সে শুধু নিজের জন্য নয়। উৎসবে, পার্বণে প্রজারাও পেতেন অর্থ ও সামগ্রী। সুজাউদ্দিনের সময় আর্থিকভাবেও যথেষ্ট সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল মুর্শিদাবাদ। রোশনিবাগে তাঁর সমাধি সন্নিকটস্থ মসজিদে উৎসব উপলক্ষ্যে জ্বলে উঠত অসংখ্য আতসবাজি। রোশনাই দেখতে জড়ো হতেন দূরদূরান্ত থেকে আগত মানুষ। এই মসজিদ ও সমাধি দেখতে আজও ভিড় করেন উৎসাহীর দল। অনেকটা ছড়ানো গাছগাছালিতে ঘেরা সুপরিকল্পিতভাবে প্রস্তুত এই মসজিদ ও সমাধির রক্ষণাবেক্ষণ এখন কেন্দ্রীয় সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের দায়িত্বে।
সুজাউদ্দিনের বেগম, মুর্শিদ কুলির কন্যা আজিমুন্নিসা। তাঁর কথা না বললে মুর্শিদাবাদের ইতিহাস অসমাপ্ত থেকে যাবে। নবাবী বিচার ব্যবস্থার এক নিষ্ঠুর ও কঠিন রূপের দেখা মেলে এক্ষেত্রে। তবে অপরাধের মাত্রাও কিছু কম ছিল না, উল্লেখ প্রয়োজন সেটাও। মুর্শিদাবাদ এলে গাইড আপনাকে নিয়ে যাবেনই আজিমুন্নিসা বেগমের সমাধি ও তৎসংলগ্ন মসজিদ দেখাতে। মসজিদ এখন ধ্বংসস্তূপ। তবে সমাধির কিছু বিশেষত্ব আছে। শোনা যায়, তাঁকে জীবন্ত সমাধি দেওয়া হয়েছিলো। শুধু তাই নয়, এই সমাধি হলো মসজিদে যাওয়ার যে পথ, তার নিচে। পথটির ওই বিশেষ অংশ, যার নিচে চিরনিদ্রায় আজিমুন্নিসা, সেটি লোহার জালে তৈরি। অর্থাৎ প্রত্যেকটি মানুষ, যাঁরা ওই পথে যাবেন, তাঁদের পায়ের ধুলো পড়বে আজিমুন্নিসার সমাধির ওপর। আজ এই এত বছর পরও আজিমুন্নিসা বেগমের শাস্তি শেষ হয়নি।
এবার তাঁর অপরাধের কাহিনি। ইতিহাস তাঁকে 'কলজেখাকী' বলে চিহ্নিত করেছে। একবার কঠিন অসুখ হয়েছিল আজিমুন্নিসার। হাকিম নিদান দিয়েছিলেন, খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে খেতে হবে শিশুর কলজে। অসুখ সারল, কিন্তু নেশা ছাড়ল না বেগমের। রোজই তাঁর শিশুর কলজে চাই। খবর গেলো নবাবের দরবারে। তারপরই ওই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। এই শাস্তি নিয়ে কিছু মতভেদ আছে। স্বামী সুজাউদ্দিন না বাবা মুর্শিদ কুলি খাঁ, নাকি দুজনে মিলেই এই বিচার ও শাস্তি প্রক্রিয়া সংগঠিত করেন, মতভেদ তা নিয়েই।
বিতর্ক, মতভেদ ইতিহাসের চিরন্তন অঙ্গ। মুর্শিদাবাদ ভ্রমণে এই ব্যাপারটা বারবার অনুভব করেছি। সব তথ্যেরই দুটি/তিনটি মত আছে। তবে যাঁকে নিয়ে কোনও মতভেদ নেই, তিনি মীর জাফর আলী খান বাহাদুর। ইতিহাসে তিনি বিশ্বাসঘাতক মীর জাফর হিসেবে কুখ্যাত। পার হয়েছে কয়েকশো বছর, বদনাম ঘোচেনি মীর জাফরের। তাঁর প্রাসাদের সামনে দাঁড়িয়ে অনুভব করেছিলাম, ইতিহাসের চাবুক কতখানি শক্তিশালী। লোকমুখে ওঁর প্রাসাদের নাম 'নিমকহারাম দেউড়ি'। অত্যন্ত ভগ্নদশা প্রাসাদের। শুনলাম, কেন্দ্রীয় সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ রক্ষণাবেক্ষণ করতে চাইলেও রাজি হন নি মীরজাফরের বংশধররা।
ভাঙা বিশাল গেট হাঁ করে খোলা। দোতলার ছোট একটি জানালায় ছেঁড়া পর্দা ঝুলছে। সিরাজের সেনাদলের প্রধান। পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সিরাজকে পরাজিত করেছিলেন। ধূর্ত ইংরেজ তাঁকে ব্যবহার করেছে, এটা বুঝতে অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছিল। জাফরগঞ্জে মীর জাফরের পারিবারিক সমাধিক্ষেত্র। দৈন্যদশা তারও। পরিবার নিয়ে এখানেই চিরঘুমে তিনি। বাংলার মসনদে বসেছিলেন মীর জাফর। তবে সে আর কদিন? স্বপ্ন ভেসেছে ভাগীরথীর জলে। মৃত্যু তাঁকে শান্তি দিতে পেরেছিল কী না কে জানে!
কলকাতা বা অন্য যে কোনও প্রান্ত থেকে পৌঁছে যেতে হবে বহরমপুর। এখান থেকেই যেতে হবে মুর্শিদাবাদ। বহরমপুরে প্রচুর ভালো হোটেল আছে। সকলেই দ্রষ্টব্যগুলি দেখার ব্যবস্থা করে। গাড়ি ভাড়া পাওয়া যায়। বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে কেন্দ্রগুলি। তবে সবটাই মুর্শিদাবাদ শহর ও শহরতলি ঘিরে, ভাগীরথীর এপারে, ওপারে। একটা সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে যেতে পারলে ভালো। হোটেল থেকেও এ ব্যাপারে যথাযথ গাইডেন্স মেলে। প্রবল গ্রীষ্ম বাদ দিয়ে যে কোনও সময়ই যাওয়া যায় মুর্শিদাবাদ। তবে, শীতে ঘোরাঘুরি করতে সুবিধা হয় নিঃসন্দেহে।