সোমবার, ৯ মার্চ। তখন বেশ গরম। বাংলাদেশের আখাউরা সীমান্ত দিয়ে ত্রিপুরায় ঢুকে পড়লেন ইয়েসিনা হেরেরা ফেবলস। ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জের বাসিন্দা পেশায় নার্স এই স্প্যানিশ তরুণী অভিজ্ঞ এক সাইক্লিস্ট, যিনি দু চাকায় চেপে দেশ দেশান্তরে ঘুরে বেড়ান। গত তিন বছরে ইউরোপ ও এশিয়ার ১৮টি দেশে ঘুরেছেন। সাইকেলে চেপে তিনি দক্ষিণ এশিয়া সফর করছেন।
সে সময়ে নভেল করোনাভাইরাস খবরে এসেছে বটে, তবে খুব বেশি জায়গা নেয়নি। বাংলাদেশ ঘুরে ত্রিপুরা পরিদর্শনের পর, তাঁর পরিকল্পনা ছিল রাজ্যের উত্তর ভাগের জেলা কাঞ্চনপুর দিয়ে মিজোরামে গিয়ে সেখান থেকে মায়ানমার চলে যাবেন। আগরতলার আখাউরায় তাঁকে পরীক্ষা করে দেখা যায়, তাঁর ফ্লুয়ের মত কোনও উপসর্গ নেই। ফলে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
আগরতলায় ১০ দিন কাটাবার পর ইয়েসিনা তিন দিন ধরে সাইকেল চালিয়ে ১৬০ কিলোমিটার দূরের কাঞ্চনপুর পৌঁছন। সেখানে ত্রিপুরা-মিজোরাম রাজ্য সীমান্তে তাঁকে আটকানো হয় এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা তাঁকে জানান যে আগরতলায় তাঁর পরীক্ষা হবে। তাঁকে আগরতলায় ফিরিয়ে এনে ১৪ দিনের জন্য কোয়ারা্ন্টিন সেন্টারে রাখা হয়, সেখান থেকে ছেড়ে দেওযার পর ফের সরকার পরিচালিত ইয়ুথ হোস্টেলে পাঠানো হয় আরও ১৪ দিন কোয়ারান্টিনে রাখার জন্য।
“আমি স্তম্ভিত। আমার কোনও উপসর্গ নেই। আমি ১০ দিন ত্রিপুরায় থেকেছি, আমাকে ফের ১৪ দিনের জন্য কোয়ারান্টিন রাখার কোনও মানে হয় না। সেখান থেকে ছাড়া পাওয়ার পর আমি আগরতলার ভগৎ সিং ইয়ুথ হোস্টেলে যাই, সেখানে ওরা কোভিড-১৯ কেয়ার সেন্টার তৈরি করছিল। সেখানে আরও ১৪ দিন কোয়ারান্টিনের মত কাটাতে বাধ্য হই।”
স্প্যানিশ ও ইংরেজি বলায় দক্ষ ইয়েসেনিয়াকে সমস্যায় পড়তে হয় কর্তব্যরত সরকারি আধিকারিকদের সঙ্গে কথা বলতে, যাঁরা বাংলা ও হিন্দি ছাড়া আর কিছু জানেন না।
ইয়েসেনিয়ার কথায়, “এত ভুল তথ্য ও তথ্যর অভাব যে কহতব্য নয়। আমি স্প্যানিশ নাগরিক। ফলে আমি সবাইকে জিজ্ঞাসা করি যে বিদেশি নাগরিকরা কোথায় যাবে তথ্যের জন্য। কেউ কিছু জানে বলে মনে হল না।”
কয়েকদিন পর তাঁর সঙ্গে পশ্চিম ত্রিপুরা জেলার এক আধিকারিকের যোগাযোগ হয়, যিনি রাজ্য সরকারি নির্দেশাবলী ইয়েসেনিয়াকে জানান। হাতে তেমন টাকা নেই, যোগাযোগেরও তেমন কেউ নেই, এ অবস্থায় এক বন্ধুর পরামর্শে শহরের বাইরে অবস্থিত হোলি ক্রস ও মিশনারিজ অফ চ্যারিটি পরিচালিত কে
ও তিন সাইক্লিস্টের, যাঁরা টোকিওর ওলিম্পিক গেমস দেখার পথে রওনা দিয়েছেন। কোভিড-১৯-এর জন্য তাঁরাও বাংলাদেশ হয়ে ত্রিপুরায় ঢোকার পর আটকে যান।
হাসিব আহসান আগে সেলস্ একজিকিউটিভ ছিলেন, এখন সাইক্লিস্ট। তিনি জানালেন, “আমরা কেরালা, তামিলনাড়ু, কর্নাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, ওড়িশা, পাশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশ হয়ে ত্রিপুরা এসেছিষ ওরা আমাদের কোয়ারান্টিনে রেখেছে, কিন্তু টেস্ট করেনি।” অঙ্কের শিক্ষক ক্লিফিন জে ফ্রান্সিস এবং সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়র ডোনা অ্যান জেকব এই অভিযানে হাসিবের সঙ্গী। তাঁরাও আটকে পড়েছেন। গোটা দলটাই ২০২১-এর টোকিও ওলিম্পিক পিছিয়ে যাওয়ার খবরে স্তম্ভিত।
ডোনা বললেন, “দু মাস হল আমরা এখানে রয়েছি। আশা হোলি ক্রস আমাদের আশ্রয় দিয়েছে, সে আমাদের সৌভাগ্য। আমরা প্রতিদিন ট্রেনের খবর নিচ্ছি। বাড়ি ফেরার জন্য বড় বেশি অপেক্ষা করতে হচ্ছে।”
করোনাভাইরাস অতিমারী তাঁদের মত ভ্রমণার্থীদের জন্য যে দীর্ঘকালীন প্রভাব ফেলবে সে নিয়ে সকলেই একমত হলেন, কারণ এ ধরনের ভ্রমণের জন্য তাঁরা বেশি অর্থ খরচ করেন না।
হাসিব বললেন, “আমরা ঘুমোনোর জন্য অর্থব্যয় করি না। আমরা স্যাক, ম্যাট, স্লিপিং ব্যাগ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস সঙ্গে নিয়ে বেরোই, যেখানে সুযোগ পাই সেখানে, অথবা যদি কোনও হৃদয়বান মানুষ বাড়িতে থাকতে দেন, সেখানে ঘুমোই। কিন্তু এই কোভিডের জন্য মানুষ সম্ভবত বিদেশিদের আর বাড়িতে থাকতে দেবে না।”
সোমবার সন্ধেয় আগরতলার বদরঘাট স্টেন থেকে দিল্লির উদ্দেশে বিশেষ ট্রেন ছাড়ে। সেই ট্রেনে দিল্লি রওনা দিয়ে দিয়েছেন ইয়েসেনিয়া। তাঁর পরিকল্পনা ৩০ মে মাদ্রিদের উদ্দেশে এয়ার ইন্ডিয়ার ইভ্যাকুয়েশন ফ্লাইট ধরার। কিন্তু তাঁর অন্য বন্ধুরা এখনও অপেক্ষা করছেন।