গরু। এই গৃহপালিত তৃণভোজী প্রাণীটি এ মুহূর্তে যত না তৃণভূমিতে বিচরণ করে, তার থেকে ঢের বেশি তার দেখা মেলে রাজনীতির আঙিনায়। তবে এখানে যে গরুর ছবি দেখছেন, তা নিতান্তই চিরাচরিত এবং অরাজনৈতিক। বর্ষার আগে কৃষিজমির উর্বরতা বাড়াতে আজও গ্রাম বাংলার বিভিন্ন এলাকায় পালিত হয় 'মইছাড়া' উৎসব, বকলমে গরুর দৌড়। তেমনই এক উৎসবের আসরে আটকে গেল ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-র ক্যামেরা। আর সেই ক্যামেরায় ধরা পড়ল একের পর এক অতি স্বাভাবিক কিন্তু অচেনা দৃশ্য।
এই গরুর দৌড় কয়েকশো বছর ধরে হয়ে আসছে গ্রাম বাংলায়। আগে পশ্চিমবঙ্গের অনেক গ্রামেগঞ্জেই এই খেলা দেখা যেত। সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে এই উৎসব এখন অনেকটাই অবলুপ্তির পথে। দৌড়ের মূল উদ্দেশ্য, বর্ষায় চাষবাস শুরুর আগে গরুর সামর্থ্য পরীক্ষা এবং জমির উর্বরতা বৃদ্ধি।
আজও প্রত্যেক বছর বর্ষার সময় এই উত্সবের আয়োজন করা হয় ক্যানিং-এর টাটপাড়ায়। এই গরুর দৌড়কে স্থানীয়রা বলেন 'মইছাড়া'। জুন মাসের শেষে কিংবা জুলাই মাসের শুরুতে এই গরুর দৌড় হয়। ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে সব কৃষকরাই এই উৎসবে শামিল হন।
আরও দেখুন: বল আগলে পাকা খেলোয়াড়ের মত ফুটবল খেলছে গরু
'মইছাড়া' আপাতভাবে কৃষিকাজের উন্নতির উদ্দেশ্যে প্রচলিত একটি প্রথা হলেও বিষয়টির মধ্যে আনন্দ সঞ্চার করতে এটিকে খেলা তথা উৎসবের চেহারা দেওয়া হয়েছে যুগ যুগ ধরে। সারা বছর ধরে গরুকে খাইয়ে শক্ত-সমর্থ করে তোলা হয় এই বিশেষ সময়ের জন্য। আর এরপর বর্ষা এলেই ধান চাষের আগে ক্ষেতে শুরু হয় গরুর দৌড়।
তিনদিন ধরে চলা মইছাড়া উৎসবে সব ধর্ম মিলেমিশে এক হয়ে যায়। শঙ্করের গরুর জয়ে এখানে চিত্কার করেন হাসান। সব মিলিয়ে গো-রাজনীতির থেকে শতহস্ত দূরে এ যেন এক ভিন্ন সংস্কৃতি। গরুর দৌড় দিয়েই মাঠে হাল চালনার শুরু হয়। ঠিক যেন দূর্গাপূজোর আগে খুঁটিপুজো।
আগে এই উৎসব এলাকারই গুটিকয়েক মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এখন এই দৌড় দেখতে ভিড় জমান অসংখ্য মানুষ। অতীতে খেলার প্রথম পুরস্কার হিসেবে বিজেতাকে গরু দেওয়া হতো। এখন পুরস্কারের ধরন বদলেছে। প্রথম পুরস্কার হিসেবে আজকাল দেওয়া হয় 'সাইকেল এবং আলমারি'।
ক্যানিং-এর মইছাড়া উত্সবের সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম মোল্লা জানান, "আমাদের এই তিনদিনের উত্সবে, ক্যানিং এর বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষজন অংশগ্রহণ করেন। আমাদের একটাই লক্ষ্য, সব রকম বিভেদ দূরে সরিয়ে আমরা চাষীরা যাতে ভালো ফসল ফলাতে পারি।" তিনি আরও জানান, এই মইছাড়া উত্সব শুধুই গরুর দৌড় নয়, এ যেন এক মিলন উত্সব। এখানে জাতি-ধর্ম মিলেমিশে এক হয়ে যায়।
টাটপাড়ার এই গো-উৎসবে কোথাও কোন রাজনীতির রং নেই, নেই হিংসা। ধর্ম-রং-মত, সব কিছুর ঊর্ধ্বে এখানে সবাই কৃষি সংস্কৃতির শরিক। এত দিন তো জেনেছেন, গল্পের গরু গাছে ওঠে। কিন্তু, বাস্তবের গরু তার চেয়েও আকর্ষণীয়, এবার তা মানবেন তো?