দিন কয়েক আগে রানাঘাট স্টেশনে যেন স্বয়ং ঈশ্বর এসে হাজির। শীতের রাতে বিয়ে বাড়ি থেকে হরেক রকম খাবার নিয়ে আসেন পাপিয়া কর। এতগুলো মানুষ না খেয়ে থাকবে না কি? তাই তো বিশেষ আয়োজন। যে কোনও রেল স্টেশনের রাতের ছবি মোটামুটি আমাদের সকলের চেনা। কেউ কেউ আধপেটা খেয়ে থাকে, তো কেউ কিছুই হয়তো খায়নি। কেউ কেউ নিত্যযাত্রীদের কাছে হাত পেতেও বিশেষ লাভ করতে পারেননি। হয়তো বা জঞ্জালের স্তূপ ঘেঁটে খাবার খোঁজার চেষ্টায় রয়েছেন কেউ। বাচ্চা থেকে বুড়ো, এমন হাজারো মুখ হামেশাই দেখা যায় রেল স্টেশন চত্বরে।
রাতের রানাঘাট স্টেশনও তার ব্যতিক্রম নয় যেখানে আধপেটা খেয়ে অথবা অভুক্ত মুখের সংখ্যাটাও নেহাত কম নয়। এমন মানুষদের কাছে ত্রাতা হয়ে সেদিন রাত্রে এসেছিলেন পাপিয়া কর, বেঁচে যাওয়া খাবার খাওয়াতে নয়, বরং সেই মানুষগুলোর জন্য আলাদা ভাবে ভাইয়ের বিয়ের খাবার তুলে রেখেছিলেন তিনি।
বিয়ের পর্ব মিটতেই বিয়ে বাড়ির পোশাকেই তড়িঘড়ি হাজির হন তিনি রাতের রানাঘাট স্টেশনে। কেবল সেই দিনের জন্য নয়, অভুক্ত মানুষগুলির কাছে পাপিয়া এক পরিচিত মুখ। সপ্তাহে ছয়দিন টোটো করে, খাবার নিয়ে বেরিয়ে অভুক্ত মানুষগুলির মুখে খাবার তুলে দেন তিনি, আর এই কাজ তিনি করছেন বিগত ১৩ বছর ধরে, তাঁর কথায়, ‘এমন কাজে শান্তি অনেক’। সেদিন ভাইয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান উপলক্ষে আয়োজন ছিল এলাহি, ফারাক বলতে শুধু এটুকুই।
ঠিক কী ঘটেছিল শুক্রবার রাতে? সেদিন তাঁর ভাইয়ের বৌভাত ছিল। এলাহি আয়োজন। ভুরিভোজের ব্যবস্থাও ছিল দেখার মতো। সকল আমন্ত্রিতদের খাওয়া দাওয়া শেষে দেখা যায়, প্রচুর খাবার বেঁচে গেছে। পরিবারের মধ্যেই সেই বাড়তি খাবার ভাগ করে নিতে পারতেন তাঁরা। কিন্তু একটু অন্যভাবে ভাবেন পাপিয়া। সমস্ত বাড়তি খাবার নিয়ে এসে পৌঁছন রানাঘাট স্টেশনে, রাত তখন প্রায় ১টা। ভাত, ডাল, সবজি, তরকারি, মাছ, মাংস, চাটনি, পাঁপড় সব নিয়ে এসে উপস্থিত হন পাপিয়া কর। পরনে তখনও বিয়েবাড়ির শাড়ি, মেকআপ। স্টেশন চত্ত্বরের পথশিশু ও অভুক্তদের জন্য পাপিয়া হাজির গোলাপী শাড়িতে।
পাপিয়া জানিয়েছেন, কোনওরকম প্রচারের আলোয় আসা তাঁর উদ্দেশ্যে ছিল না, এটাই তার রোজের রুটিন। আর সেই তাগিদেই রাতের রানাঘাট স্টেশনে ছুটে আসা। পাপিয়ার ফেসবুক প্রোফাইলেও রয়েছে এমন অজস্র ছবি। কেবল অভুক্ত মানুষদের মুখে খাবার তুলে দেওয়া নয়, সপ্তাহে একদিন রবিবার, কলকাতার রাস্তার পথশিশুদের পড়াশোনা এবং হাতের কাজের নানা প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন তিনি।
সময়টা ২০০৮ সাল। রানাঘাট স্টেশনে এক ভিখারি পাপিয়ার কাছে সামান্য কিছু খেতে চায়, সেই সময় তাঁর কাছে খাবার না থাকায় তিনি ওই অভুক্ত ভিখারিকে ১০ টাকা দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। সেই থেকে শুরু পথ চলা। সামান্য ১০ টাকা সেই মানুষটিকে যতটা খুশি করেছিল তা দেখে পাপিয়া স্থির করেন সমাজের পিছিয়ে পড়া শ্রেণির পাশে দাঁড়িয়ে কিছু করতেই হবে। ভাবনা অনুযায়ী তিনি নেমে পড়েন তাঁর লক্ষে। পাপিয়ার কথায়, এইকাজে তাঁকে সব সময় অনুপ্রেরণা দেন তাঁর স্বামী। পাপিয়ার এমন মহানুভবতাকে কুর্নিশ জানিয়েছেন সকলেই।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন