‘প্রফেশন’কে পিছনে ফেলে কর্ণিয়া সংগ্রহের ‘মিশনে’ প্রাণপাত করছেন টোটো চালক আশীষ। মরনোত্তোর চক্ষুদান আন্দোলনকে এক অন্যমাত্রায় নিজে যেতে দীর্ঘ বছর ধরেই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন আশীষবাবু। দিন হোক অথবা মাঝরাত, মরনোত্তোর চক্ষুদানে অঙ্গীকার করা কারুর মৃত্যু সংবাদ পেলেই ছুটে আসেন তাঁর বাড়ি। সংগ্রহ করেন তার মূল্যবান কর্ণিয়া। জমা দেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে। তারপর বাড়ি ফেরেন।
সংগ্রহ করে ফেলেছে প্রায় সাড়ে তিনশো’র বেশি কর্ণিয়া। এর জন্য অবশ্য তিনি একটাকাও পারিশ্রমিক নেন না। উল্টে যে সময় তিনি কর্ণিয়া সংগ্রহের কাজ করেন সেই সময় টোটো চালানো পুরোপুরি বন্ধ। তার জন্য অবশ্য ‘খেদ’ নেই আশীষবাবুর। তার সংগ্রহ করা কর্ণিয়া দৃষ্টি ফেরাবে কোন এক অন্ধজনের, এটা ভেবেই তৃপ্তি।
নেহাত ইচ্ছার বশেই কর্ণিয়া সংগ্রহ অভিযানে নামেন টোটোচালক আশীষ। কিছুদিন পরে তিনি উপলব্ধি করেন কত মানুষ আছেন যারা দেখতে পান না, একটা কর্ণিয়া আলোকিত করতে পারে তাদের জীবন। মেডিক্যাল কলেজে কর্ণিয়ার চাহিদা দেখে কর্ণিয়া সংগ্রহকে ‘মিশন’ করেন আশীষ।
তিনি বলেন, “আমার সংগ্রহ করা একটা কর্ণিয়া যখন একটা মানুষের দৃষ্টি ফিরিয়ে দেয়, একটা পরিবারকে বাঁচায় তার থেকে আনন্দের আর কিছুই হতে পারেনা। আমি চাই, মরনোত্তোর চক্ষুদান আন্দোলনকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে। তরুণ প্রজন্মকে এই কাজে সামিল করা আমার একটা লক্ষ্য। অন্ধজনে আলো দানের ব্যবস্থার মত মহৎ ব্রত কে সকলেই মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চাই”।
ছোট দোকানই ছিল পরিবারের উপার্জনের মাধ্যম। মায়ের চিকিৎসার কারণে সেটাও বিক্রি করতে হয়েছে। টাকার জোগাড় করার জন্য। তার পর থেকে টোটো চালিয়ে সংসার সামলান তিনি। বাড়িতে বৃদ্ধা মা, ছেলে এবং স্ত্রী। মেডিক্যাল কলেজ থেকে কর্ণিয়া সংগ্রহ হাতে কলমে শিখে এখন পর্যন্ত সাড়ে তিনশোর বেশি কর্ণিয়া সংগ্রহ করে ফেলেছেন তিনি। এমনকী করোনা মহামারী কালেও ছেদ পড়েনি ‘মিশনে’। করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃতের কাছ থেকেও সংগ্রহ করেছে ‘দুর্মূল্য কর্ণিয়া’।
বালি-উত্তরপাড়া, কোন্নগর, শ্রীরামপুরের বিস্তীর্ণ অংশে তিনি কর্ণিয়া সংগ্রহের কাজ করেন। যুক্ত রয়েছেন কোন্নগর আই ব্যাঙ্ক সোসাইটির সঙ্গে। সংস্থার সম্পাদক অরিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘আশীষ দীর্ঘদিন ধরেই আমাদের সঙ্গে যুক্ত। ও ওঁর লক্ষ্যে অবিচল। আমাদের উদ্যোগেই মেডিক্যাল কলেজ থেকে হাতে কলমে পাঠ নেওয়ার পরে কর্ণিয়া সংগ্রহ অভিযানে নেমে পড়েন আশীষ। রাত হোক অথবা দিন কখনও কর্ণিয়া সংগ্রহের কাজে কোন বিরক্তি নেই আশীষের। ও এখন আমাদের মরনোত্তোর চক্ষুদান আন্দোলনের এক প্রধান স্তম্ভ’।
এই কাজে বহু মানুষের ভালবাসা ও সহযোগিতা পেয়েছেন আশীষ। টোটোর সামনে এবং পিছনে মরনোত্তোর চক্ষুদানে সামিল হওয়ার ব্যানার টানানো। টোটো চালিয়ে কমবেশি রোজ ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা উপার্জন। দুর্মূল্যের এই বাজারে কর্ণিয়া সংগ্রহের কারণে মাঝে মধ্যেই বন্ধ রাখতে হয় টোটো। কোপ পড়ে উপার্জনে। তাতে কোন আক্ষেপ নেই আশীষের।
তিনি বলেন, “আমি এবং আমার পরিবার খুব অল্পেতেই খুশি। প্রথম থেকেই আমি আমার পরিবারের সহযোগিতা পেয়ে এসেছি। আজও পাচ্ছি আর সাধারণ মানুষের ভালবাসা, এটা আমাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। সরকারের কাছে আশীষের অনুরোধ, যে সকল গরীব মানুষ মরনোত্তোর চক্ষুদানে সামিল হবেন তাদের দাহটুকু যাতে বিনামূল্যে হয় তার ব্যবস্থা করা। তাতে আরও বেশি মানুষ বিশেষ করে সমাজের গরীব শ্রেণীর মানুষ এই আন্দোলনে সামিল হতে এগিয়ে আসবেন। আরও বেশি মানুষ আলোর সন্ধান পাবেন”।